November 2, 2024
কলামফিচার ৩

মা কেন সন্তানের অভিভাবক নয়?

ড. মুসলিমা জাহান ময়নামতি ।। প্রশ্নটা বড়ই অদ্ভূত। আর এ প্রশ্ন নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিলতায় পড়ে মায়েরাই। বিশেষ করে যখন বাবা-মায়ের আলাদা হবার প্রশ্ন আসে।

সন্তান জন্ম দেয় কে? মা। দশ মাস গর্ভে টেনে নিজের শরীরের রক্ত খাইয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যথা সহ্যের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করে সন্তানকে দুনিয়ায় আনে কে? মা। তারপর আবার বুকের সাদা রক্ত খাইয়ে, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে বছরের প্রতিটা সেকেন্ড তৎপর থেকে বাচ্চা বড় করে কে? সেও মা। সন্তান জন্ম দিতে মায়েরা নাইওর যায়। কেন যায় জানেন? বাচ্চা জন্ম দেবার পর বাচ্চার সাথে সাথে বাচ্চার পরিচর্যা যাতে ঠিকমত হয় সেজন্য। কখনো ভেবে দেখেছেন যে সন্তানের অভিভাবক পুরুষ তার জন্মে, তার পরিচর্যায় বাবাদের ভূমিকা কতখানি গৌণ, সেটা এই নাইওর সংস্কৃতি থেকে সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব। বাঘা-ব্যবসায়ী বাবারা কখন ঘরে ফেরেন? যখন তারা সুযোগ পান তখন। চাকরিজীবী বাবারা যদি আগে আগে অফিস থেকে বের হতে পারেন, কোথায় যান? ক্লাবে নিশ্চয়? খুচরা ব্যবসায়ী বাবারা কখন ঘরে ফেরেন? রাত বারোটা। আমাদের দেশে মুদি দোকান বন্ধ হয় রাত এগারোটার পরে। সরকার যখন সকাল সকাল দোকান বন্ধের আইন করেন তখন এরা মিডিয়াতে কান্নাকাটি শুরু করে এই বলে যে তারা ঘরে ফিরে কী করবে? প্রাইমারী স্কুলের সামনে প্রচুর ‘মা ছাউনি’ তৈরি হয়েছে। ‘বাবা ছাউনি’ হয়নি কেন? কারণ, বাচ্চাদের লেখাপড়ার দায়িত্ব পুরাটাই মায়েদের কাঁধে থাকে। আমি প্রায় ক্লাসেই ছাত্রদের জিজ্ঞেস করি তাদের বাবাদের সাথে কী কী স্মৃতি রয়েছে? ছাত্রদের কোনো উত্তর থাকে না। কারণ, বাবাদের সাথে তাদের সময় কাটানো বিষয়টা সমাজ একেবারেই বাতিলের তালিকায় রেখে দিয়েছে। বাসায় কে রান্না করে বা কার রান্না খেয়ে বাচ্চারা বড় হয়, তার উত্তরও মা।

বাবারা তাহলে সংসারে কী দেয়? এই উত্তরটা খুব সোজা। বাবা রোজগার করে। তারা সংসারে টাকা দেয়। মা’র চব্বিশ ঘণ্টা নন-স্টপ চাকরির জন্য কোনো বেতন নেই। তাই বলে সমাজ কি স্থবির হয়ে বসে রয়েছে? মায়েরা এগিয়ে গিয়েছে অনেক। তার ব্যবসা, চাকরি, রাজনীতি, সমাজসেবা সবই করছে এখন। তার মানে বহু মায়েদের সংসারের পাশাপাশি চাকরি আছে, রোজগার আছে। তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। আইন কিন্তু তার পুরাতন ছক থেকে এখনো বের হতে পারেনি। বের হতে পারেনি সমাজও। তাই আজও একজন নারী ডাক্তারও একজন নারী রোগীকে প্রথম যে প্রশ্নটি করে তা হলো, আপনার স্বামী কী করেন?

এক তালাক মিটিং-এ আমার থাকার সুযোগ হয়েছিল। মহিলা বলছে যে সে বাচ্চা রাখবে না। বাচ্চারা তার বাবার সাথে যাক। উপস্থিত পুরুষরাই মহিলাকে বোঝাতে শুরু করলো এই বলে যে, বাপ কখনোই বাচ্চা মানুষ করতে পারবেনা। তাছাড়া বাচ্চাদের দাদীও বেঁচে নেই (সেও কিন্তু আরেকজন মা)। আর বাবা তো বিয়ের জন্য মেয়ে ঠিক করেই রেখেছে। সুতরাং দাবি-দাওয়া যা পেশ করার কর। কিন্তু বাচ্চারা মায়ের তত্বাবধানে থাকুক – এগুলো পুরুষদেরই মন্তব্য। আমার ধারণা যারা এ লেখা পড়ছেন তারাও সবাই প্রায় একই মত দেবেন যে বাচ্চা ‘মানুষ করা’ বাপের কাজ নয়। তা হলে ডিভোর্সের সময় পুরুষরা বাচ্চা নিয়ে এইরকম ‘তামাশা’ কেন করে? তারা একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই করে। কারণ, জানে যে সন্তান হচ্ছে এই দুনিয়ার যে কোনো মায়ের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। সন্তান একটা মায়ের শরীর থেকে বের হয়। তার জন্য যে কোন ত্যাগ কেবল মা-ই করতে পারে বা করবে। এটা নিয়ে তারা খেলে। এটা নিয়ে ব্লাকমেইলিং করা, মায়ের তালাক পরবর্তী জীবনটাকে যন্ত্রণাদায়ক করার একটা মোক্ষম অস্ত্র। তাই তারা সন্তান নিয়ে ‘নাটক’ করে। ভালবাসার ভান দেখায়। ছেলে সন্তান হলে তো কথাই নেই।

কিন্তু আমাদের আইন মানতে হবে। ঠিক। কোন আইন? সংবিধান বলছে আমাদের রাষ্ট্রে নারী-পুরুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান (২৮(২)) । আর তাই আমরা স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে শিক্ষালাভের সুযোগ পাই। চাকরীর ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতে পারি। রাজনীতিতে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করি। আমরা শুধু প্রধানমন্ত্রী নই, মন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, অধ্যাপক, ম্যাজিষ্ট্রেট, পাইলট, সেনা অফিসার, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হতে পারি। এটা বাংলাদেশের আইন বলে সম্ভব। কিন্তু পরিবার সংক্রান্ত যে কোনো জটিলতায় সে আইন কোথায় যায়? পরিবার নিয়ে তো আমরা বাংলাদেশেই বাস করি। তাহলে তখন কেন আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না? এর অবশ্য প্রধান দুটি কারণ আছে। প্রথমত আমরা তখন আমাদের পরিবার সংক্রান্ত জটিলতায় মুসলিম আইনে চলে যাই। আর দ্বিতীয়ত আমাদের সংস্কৃতি সেই আইনকে ঘিরেই চলে আসছে।

একটা বিষয়ে আপনার সবাই অবগত আছেন যে ব্যবসায় ও শিল্প আইনের অনেক কিছুতেই এখনো ব্রিটিশ আইনের প্রচলন আছে আমাদের দেশে। আমাদের দেশের জমির খাজনা সংক্রান্ত বা ট্রেনে ‘চেইন টানলে দুইশো টাকা জরিমানা’ – সেও কিন্তু স্বাধীনতা লাভের বহু আগের তৈরি আইন। সময় সাপেক্ষে ব্যাংকিং ও মুদ্রানীতির অনেক কিছুই বদল করতে হচ্ছে প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের কারণে। কিন্তু পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে আমরা এর আধুনিকীকরনে মনোযোগী নয় বিশেষ করে সেটা যদি নারী সংক্রান্ত কিছু হয়।

আমি যদি হই মুসলিম আইনের পক্ষে, তাহলে সেটা সার্বজনীন না হলে তাতে আমার ঘোর আপত্তি আছে। ইসলামে সুদ হারাম। আল-কোরআনের কথা। ঘুষ হারাম। প্রয়োগ করুন। ব্যাংকিং-এ সুদ নিষিদ্ধ করুন। চুরির শাস্তি হাত কেটে ফেলা – চোর ধরা পড়লে হাত কেটে ফেলুন। প্রত্যেকটা নারীকে পিতার সম্পত্তির যা প্রাপ্য – পুরোটা দিন। পরিবার সংস্কৃতিতে পুরোপুরি ইসলামের আদর্শ মেনে চলুন। বিয়ের আগে বা পরে – প্রেম করে বা ব্যভিচার করে ধরা পড়লে পাথর মেরে হত্যা করুন। মুসলিম আইন নারী নেতৃত্ব মানে না। যত নারী নেতৃত্বে আছেন; সরকারি বা বেসরকারি – সকলকে তাদের পদ থেকে সরিয়ে দিন। সিনেমা হল, টিভি, নাটক-গান-বাজনা, ইউটিউব- সব বন্ধ করে দিন। মুসলিম আইনে সেগুলোও হারাম। আমরা জীবন-যাপন করবো বাংলাদেশ আইনে, শিল্প-ব্যবসা করবো ব্রিটিশ আইনে আর পারিবারিক যে কোনো জটিলতায় মুসলিম আইন নিয়ে এসে নারীর জীবন নরক করে ফেলব – বিচারকরা সে আইন দিয়ে একজন স্বাবলম্বী, সম্মানিত, পদধারী নারীকে তার স্বামীর অর্ধেক, একজন পুরুষের অর্ধেক হিসেবে রায় দেবে তা কেন মেনে নেবো? এক দেশে তিন আইন চললে যা হবার তাই তো হচ্ছে এ দেশে। প্রবাদ আছে যে ‘যেদিকে বৃষ্টির ছাট, সেদিকে ছাতা ধরো’ – তার মানে কি এই যে বিপদে পড়লে আমরা আমাদের সুবিধাজনক আইনের আশ্রয় নিচ্ছি। আর তাতেই তো এত অবিচার চারদিকে! দুনিয়ার কোনো দেশই এরকম তিন সংস্কৃতির তিন-রকম আইন দিয়ে দেশ চালায় না। আমাদের আইনপ্রণেতারা, রাজনীতিবিদ বা আমলারা কেন এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ বোধ করেন না? ফেঁসে যাবার ভয়ে? বা নিজেদের হাত কাটা পড়বে, এই ভয়ে?

একজন মা সুদূর জাপান থেকে এদেশে এসেছেন তার দুই সন্তানকে ফেরত নিতে। আদালত এখনো কোনো রায় দিচ্ছেন না। কেন? মায়ের পক্ষে যাবে, তাই? যাবেই তো। সেদিন ‘কেজিএফ’ নামে এক সিনেমায় দেখলাম নায়কের সংলাপ – ভগবানের পরে যদি কোনো ভগবান থাকে, সে হলো মা। ইসলাম কি তাই বলেনি? বিশ্বনবী কি বলেননি যে মায়ের অধিকার প্রথম তিন ধাপে, চতুর্থ ধাপে গিয়ে তারপর স্থান পাবে বাবা? তাহলে আইন এত গরিমসি করছে কেন? ডিভোর্সী হলেও প্রথম মা-ই সিদ্ধান্ত নেবে সন্তান কার কাছে থাকবে। মা যদি অস্বীকৃতি জানায় তখন না হয় আমরা বাবাদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি যে সন্তানের তিন বেলা খাওয়ানো, স্কুলে আনা-নেয়া, অসুখে রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে সেবা করা, প্রতি সন্ধ্যায় সন্তানদের পড়তে বসানো – এসব বাবারা ঠিকমত করবে কি না? কোনো কোনো বাবারা করে হয়ত। তবে তা লাখে কয়জন আপনারা ভালো জানেন। আমার চোখে তারা পড়ে না। ঢাকা শহরে হাজারো নারী আছেন যারা সংসার, সন্তান সবকিছু তাদের আয়েই চালান, শাশুড়ির সন্তানটিসহ যে কিনা সন্তানের বাবা। প্রচুর মা আছেন ডিভোর্সী। সন্তান তাদের কাছে থাকে। আর সেই অধিকারধারী বাবারা ফুলবাবু হয়ে বেড়াচ্ছেন বা সন্তান নিয়ে জটিলতা তৈরি করে যাচ্ছেন। যে দু-একজন বাবা সন্তানের দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের কয়েকজনকে আমি জিজ্ঞেস করেছি তাদের সন্তানের ব্যাপারে। তারা সহজেই বলেছেন, দাদীর কাছে, ফুপির কাছে বা চাচীর কাছে তারা ‘মানুষ’ হচ্ছে। তাহলে আপনারারই বলুন সন্তান কার কাছে থাকবে? সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ব্যক্তিই হচ্ছে পর্যায়ক্রমে মা, মা এবং মা। বাবার অবস্থান অবশ্যই চতুর্থ। সন্তানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে, মানুষ হবার ব্যাপারে আপনারা কোনো ছাড় দেবেন না। মায়েদের পক্ষে রায় দিন।

আর যদি তা না দিতে পারেন তাহলে সংবিধানের ২৮(২) ধারা মিথ্যা। বাংলাদেশের নারী প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য নারী মন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, নারী স্পিকার, নারী বিচারক, নারী পরিচালক, সংগঠনের নারী প্রেসিডেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী ভাইস-চ্যান্সেলর, নারী সেনা কর্মকর্তা, নারী পাইলট – সব মিথ্যা। এরা কেবল পুরাতন, বাস্তবতা-বিবর্জিত আইনের প্রতিভূ। জনস্বার্থে নয়, কোটি কোটি নারী বা মায়েদের স্বার্থে নয়, তারা কেবল নিজেদের স্বার্থে এইসব আইন আর সংস্কৃতির বদল ঘটান নি। ক্ষমতাবলে তারা সুবিধাদি আদায় করে নিতে পারবেন। কিন্তু কোটি কোটি মায়ের প্রতিনিধি হিসেবে মায়েদের ভোগান্তি নিরসনে এই প্রযুক্তির যুগে, চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসেও তাদের আইন অন্ধই থেকে যাবে। শুধু শিক্ষা সনদে মায়ের নাম সংযোজন করলেই তো চলবে না। এসব জটিলতাগুলোকেও সহজ করতে হবে। নির্ভরশীল মায়েদের কথা কথা তো বলাই বাহুল্য, শিক্ষিত, স্বাবলম্বী এবং স্বচ্ছল মা হয়েও কেবল যুগের অনুপযোগী আইনের কারণে অসহায় আর নিঃস্ব হিসেবে সমাজ তাদের নিগৃহিত করে যাবে। সংখ্যালঘু করে রাখবে। একজন মা একটি রাষ্ট্রের অভিভাবক হয়েও সন্তানের অভিভাবক হতে পারবে না। মানা যায়?

মা-ই হোক সন্তানের প্রথম অভিভাবক। একক আইনগত অভিভাবক।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *