November 22, 2024
মুক্তমত

আপনারা কীভাবে না দেখার ভান ধরে আছেন?

তানজিয়া রহমান ।। আপনার আমার স্বাধীনতা একটু একটু করে যে কেড়ে নেয়া হচ্ছে এই বিষয়টা কি আপনারা মোটেও অনুধাবন করতে পারছেন না? আমাদের পোশাক পরার স্বাধীনতাটা পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হচ্ছে খুব সূক্ষ্মভাবে। আপনি ওয়েস্টার্ন পরলে আপনার পোশাক টেনে ছিড়ে নিতে চাচ্ছে। আপনাকে ওড়নায় মুড়াচ্ছে। আপনি বাঙালি পোশাক পরলে সেই পোশাকেরও সমস্যা খোঁজা হচ্ছে। এবার আপনি মধ্ প্রাচ্যের পোশাক পরলে তাতেও ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না। পোশাকে পুরুত্ব কতটা, ঢোলা কতটা, সেটা সহীহ হলো নাকি, কত কি! এর পরের যে দাবি তা হলো, তুমি ঘর থেকেই বের হইও না। পঞ্চম শ্রেণি অব্দি পড়ে ঘর সংসার করো। আর বাচ্চা জন্মের মেশিন হও।

ছোটবেলায় দেখতাম বিভিন্ন এনজিও’র হয়ে বিদেশিরা আসত গ্রামে। বিদেশি মেয়েরা গরমের মধ্যে শর্ট প্যান্ট আর হালকা রঙের পাতলা নরম শার্ট পরত। তারা সাইকেলিং করতো। বাজারে যেত। গ্রামের কেউ তাদের কখন বলত না এই সব পরা যাবে না। তোমার জামায় ব্রা দেখা যায়। তোমার ঠ্যাং দেখা যায়। কেউ বলত না এসব, কেউ না। এখনকার বিদেশি ভ্লগারদের দেখবেন তারা প্যান্ট, টিশার্ট সাথে আবার স্কার্ফও পরে। তারাও জানে, বুঝে, আপনাদের খারাপ নজর, খারাপ মানসিকতা সম্পর্কে। আপনাদের কাছে তারা নিরাপদ না। আপনারা যা-তা করতে পারেন।

আমরা যারা ওয়েস্টার্ন পরি তারা খুব ভালো করে জানি আমাদের কত উপদেশ শুনতে হয়। আমাদের বুঝানো হয় ভালো মেয়েরা এসব পরে না। পথে ঘাটে, অনলাইনে মানুষ কি পরিমাণ যে হ্যারাস করে। তারা হিজাব পরার পরামর্শ দেয়। ওয়েস্টার্ন ড্রেসের সাথে আড়াই হাত ওড়না পরার পরামর্শ দেয়।

আচ্ছা যারা হিজাব করেন তারা বলেন তো, আপনাদের বোরখা পরার পরামর্শ দেয় না? আমি একটা ঘটনা বলি। একজন হিজাব করেন। উনি ভোরে হাঁটতে গেলে উনাকে এক লোক রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পর পর তিনদিন বোরখা পরার জ্ঞান দেয়। পরের দিন তাকে পথ পাল্টাতে হয়েছে। যেন ওই লোকের সাথে আর দেখা না হয়। এই যে অপরিচিত লোকদের ধরে ধরে জ্ঞান বিতরণ করে একটা বাজে, বিরক্তিকর পরিবেশ তৈরি করা, এটা কেন? আপনারা কি হীনমন্যতায় ভোগেন? আপনারা নারীরা যারা এমন পরাধীন, অনিচ্ছায় আলখাল্লায় আবৃত, আর অন্য একজন নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী আরাম মতো পোশাক পরে বলে সেটা সহ্য করতে না পেরে হামলায়া পড়েন? আর যে বেটাগুলো হামলায়া পড়েন তারা কী চিন্তা করেন? ‘হায় হায়! এই মেয়েরে দেখে যদি কালকে আমার বাড়ির মেয়েরা আমার দিকে আঙুল তোলে। আমার ক্ষনে ক্ষনে চোখ রাঙানোকে যদি আর তোয়াক্কা না করে!’ – এই ভয় পান?

আর কিছু বোনেরা আছেন যারা প্রেমিককে, জামাইকে খুশি করতে হিজাব পরেন। গরমে সিদ্ধ হয়ে যাবে। ঘামে চুল সব পড়ে যাবে। গা থেকে বিশ্রী গন্ধ আসবে। গরমে ঘেমে ডিহাইড্রেশন হয়ে ধপাস করে মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। তাও তারা হিজাব পরবেন। কারণ “ও” খুশি হয়। তারপর উনারা গলা ফাটায়ে বলবেন “হিজাব ইজ মাই চয়েজ”। হাস্যকর। আপনাদের কাজকর্ম অত্যন্ত হাস্যকর।

আচ্ছা আপনাদের কি কখনো মনে প্রশ্ন জাগে না? কেন সব নিয়ম, সব আদেশ নারীদের জন্য? কেন নারীকে শুধু পোশাকে মোড়াতে হবে? কেন তাদের নির্দিষ্ট পোশাকের  আদেশ আছে, কেন তাদের চুল ইচ্ছেমতো বাধা যাবে না, কেন তাদের সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না? কেন বাইরে গেলে কারো সাথে বের হতে হবে? একা কেন নয়? প্রাণ খুলে কথা বলা, অট্টহাসি হাসা যাবে না? কেন? কেন নিজের ইচ্ছা মতো সাজা যাবে না? এত মানা, এত বিধি নিষেধ কেন শুধু একটা লিঙ্গের জন্য?

পুরুষরা যখন গরমে হাফপ্যান্ট আর ম্যাগি হাতার গেঞ্জি পরে থাকে আর আপনি বিশাল সাইজের একটা পোশাকের সাথে হাত, পা, নাক, কান, চোখ, মুখ ঢেকে বাইরে যান। একজন আরামসে হাওয়া খায়। আর আপনি গরমে সিদ্ধ হন তখনও প্রশ্ন জাগে না? কেন পর্দা শুধু এক পক্ষের? বাইরে খেতে গিয়ে যখন একজন আয়েস করে খায়, তারপর আপনার নিকাবের কোণা হালকা তুলে ধরলে যে আপনি লোকালয়ে খেতে পারেন! এইসব বিনা প্রশ্নেই করে যাচ্ছেন? কেন আপনারা এসব বিনা প্রশ্নে করে যাচ্ছেন। আবার আশেপাশের সবাইকে সুযোগ পেলেই আপনার মতো উদ্ভট জীবন যাপনের দাওয়াত দিচ্ছেন। এটা কোনো সভ্য লোকের কাজ না।

বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও লেখা নাই পোশাক পরিধানের নিয়ম সম্পর্কে। লেখা থাকা উচিতও না। এটা একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার কে কী পরবে আর না পরবে। তাহলে আপনারা কোন আইনে এইসব করে বেড়ান। এইভাবে হ্যারাস করার জন্য যে আপনার নামে মামলা হতে পারে তা কি জানেন? একজন ব্যাক্তি যখন যা ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা পরতে পারে। কেউ তাকে জোর করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পোশাক চাপাতেও পারবে না, কেউ খুলে নিতেও পারবে না।

আর আপনারা যারা এত ভালোমানুষী করছেন। দেশে যা খুশি হয়ে যাচ্ছে- না দেখার ভান করছেন। একজনের জামা টেনে খুলে নিলেও কোনো কথা বলছেন না। আপনাদের দিকে যে দুইদিন পর আঙুল উঠবে না, আপনার গায়ে বা আপনার পরিবারের গায়ে যে তারা হাত দেবে না এটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে? দেশে দুইদিন পর শরীয়া আইন চালু হলে আপনারা কই লুকাবেন। পারবেন তো টিকতে? আফগানিস্তানের অবস্থা জানেন তো? না জানলে গুগল করুন দয়া করে। দেখুন কি হবে তখন অবস্থাটা। এখন যে মুখ বন্ধ করে বসে আছেন না, তখন পারমানেন্ট মুখ বন্ধ করে দেবে। চাইলেও তখন কিছু বলার বা করার থাকবে না।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *