November 24, 2024
কলামফিচার ৩

পিতৃতন্ত্রের সাথে পরিচয় – শৈশবে দেখা কিছু বিবাহ অনুষ্ঠান

অপর্ণা হাওলাদার ।। লিখছি কিছুটা মেমোয়ের বা স্মৃতিচারণমূলক লেখার ধাঁচে। এইসব ঘটনা ঘটে যাওয়া আমি নারীবাদী কোনো বই পড়ার বহু আগে। যা কিছু দেখে শিখেছি, পরবর্তী জীবনে  পড়ে আসা অনেক বইয়ের চেয়ে তা অনেক বেশি।

বিবাহ অনুষ্ঠান ১

আমি শৈশবে অনেকটাই কাটিয়েছি বরিশালে। বড় সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে মনে পড়ে একটিই বিয়ে। পাশের বাসার এক মাসির বড় মেয়ের। দিদি কলেজে পড়তেন তখন, ২২/২৩ বছর বয়স হবে। এই বিয়েটার সবকটি ফাংশনই অ্যাটেন্ড করেছি, কাছে থেকে দেখেছি। আমার বয়স ৬/৭।  বিয়েটা যে একটা মেয়ের জন্য খুব সম্মানের কোনো অনুষ্ঠান না, সেটা সেই থেকে  মাথায় থেকে গেছে। প্রথমে বাহিনী সহকারে তাকে দেখতে আসা হলো, সেই দেখতে আসার বিবিধ ব্যবস্থায় ছেলে’র দাদা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবে?”। ফালতু প্রশ্ন, ছেলে টিএনও তখন, পরে বরিশালেরই ডিসি হয়েছেন। গ্রামে গিয়ে থাকা বউ এর লাগে নাই, কিন্তু শান্তসমাহিত কন্যা কোনো কথা বললো না। তখন ছেলের দাদা বললেন, “আচ্ছা, তাহলে তুমি লিখে দাও কেমন লাগবে?” কাগজ দেয়া হলো, মেয়ে কিছু লিখলো না। আমি দিদির পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কতো আগের কথা।

তো, এই পরীক্ষা পাস করে দিদি’র বিয়ে ঠিক হলো। বিয়ের এক মাস আগে থেকে উনি সারা দিনরাত বিছানায় শুয়ে কাঁদতেন। মানে, কান্নারও সীমা আছে। এমনও না যে ছেলে পছন্দ না বা কিছু। “মন খারাপ” এই পরীক্ষায় পাশের জন্য এই কান্নাকাটি। এরপর গায়ে হলুদ, বিয়ে, বাসি বিয়ে, মেয়ে বিদায় পর্যন্ত মেয়েটা কেঁদেই গেল। মানুষের এক্সপেকটেশন মেটাতে। না কাঁদলে লোকে কী বলবে! বিয়ের মেইন অনুষ্ঠান বাড়িতেই হলো, আমাদের মাঠে। বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়ের পরিবারের সবাই ছোট হয়ে থাকে, খাবার নিয়ে বরপক্ষের ছোটলোকামি শেষ হয় না। এই মেয়েটির গায়ের রঙ ফরসা হওয়ার কারণে এক যাত্রাতেই পার পেয়ে যায়। অন্য মেয়ে দেখেছি, গায়ের রঙ শ্যামলা/কালো হওয়ার কারণে মেয়ে দেখতে আসা গণ্ডগ্রামের লোকজন বড় বড় মিষ্টি খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছে। দফায় দফায় একই মেয়েকে দেখতে এসে হাজার প্রশ্নের ইন্টার্ভিউ চলেছে, সাথে খাওয়া।

বিবাহ অনুষ্ঠান ২

বিয়েতে বর এবং কনের মধ্যে সামাজিক মর্যাদার পার্থক্যও চোখে লাগে শিশু বয়সেও। বর নিয়ে মাতামাতি হয়, মেয়ের বাড়ির লোকে চরম অপমানের মধ্যে কয়েক দিন কাটান। পান থেকে চুন খসলেই পাত্রপক্ষের গুণ্ডামি। এরকমই প্রতিবেশি আরেকটি মেয়ের বিয়েতে বরপক্ষ আমাদের পরিচিত। তারা এলো। গেট ধরা হলো, ভেতরে ঢুকলো। মেয়েটি তেমন ধনী পরিবারের নয়, তাদের সাধ্যমত আপ্যায়ন ছিল। কিন্তু বরপক্ষের সাথেই বসে পুরো সময়টি আমি দেখলাম কীভাবে বরের ভাই জিনিসপত্রে লাত্থি দিচ্ছে, প্রচণ্ড বেয়াদবি মাস্তানি করে যাচ্ছে কনেপক্ষের সবার সাথে।

আর কন্যাপক্ষের লোকেরা সবাই মাথা নত করে মেনে নিচ্ছে। এই সম্পর্কের কার্যকারণ বুঝতে আরও বড় হওয়া লাগলেও, কনে হওয়াটি যে কোনো সম্মানের বিষয় নয়, তা বুঝতে বাকি ছিলো না।

বিবাহ অনুষ্ঠান ৩

এবার অন্য পক্ষে। আমার বাবা’র ঘনিষ্ঠ কিছুটা জুনিয়র বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তখন। সেই কাকার বিয়ের সময় আমি ক্লাস থ্রি’তে পড়ি। তো, আমরা বরপক্ষ গেলাম রাজশাহী কাকা’র বিয়ে দিতে। সে তো মহা জমজমাট ব্যবস্থা। পাত্রপক্ষে আমি একাই ছোটো, সেই সূত্রেও আলাদা খাতির।

বিয়ের দিন কাকীর রুমে ছিলাম কাকী “কবুল” বলার সময়। তো, “কবুল” বলার সময় আসা মাত্রই মেয়ে এবং মেয়ের আশেপাশের সব নারী একত্রে কাঁদতে শুরু করে দিলো। আমি এটা দেখলাম। আবার দেখলাম কাকা’কে কীভাবে সবাই কনগ্র্যাচুলেট করছে। উনি কাঁদছেন না।

বিয়েটা যে মেয়েদের জন্য কান্নার বিষয় এবং পুরুষের জন্য আনন্দের – এটা জানতেও বই পড়া লাগলো না।

বিবাহ অনুষ্ঠান ৪

আমি তখন ঢাকায় উদয়ন স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ি। এর মধ্যে আমার ছোট কাকার বিয়ে ঠিক হয়। ওনার নিজের পছন্দে। আমাদের গ্রামের বাড়িসূত্রে প্রতিবেশি একজনের সাথে – যে কিনা হলে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো, এবং আমি তাকে “পিসী” বলে ডাকতাম।

কাকা’র বিয়ে ব্যাপারটা নতুন ছিল আমার জন্য। কেনাকাটা করা, বিয়েতে বরযাত্রী যাওয়া, সবই – এই প্রথম নিজের বাড়ির বিয়ে! কাকা’র বিয়ে উপলক্ষেই জানলাম যে, বাসর রাতে মেয়ের চুল দিয়ে ছেলের পা মুছে দিতে হয়। কাকী তার লম্বা চুল খুলে মাটিতে বসা। কাকা বিছানার উপর পা দুলিয়ে। কাকীর চুল দিয়ে আস্তে আস্তে কাকা’র পা মুছিয়ে দেওয়া হলো। এই দৃশ্য স্বচক্ষে দেখা বোধকরি আমার জীবনে “বিবাহ” সম্বন্ধীয় ভীতির মূল স্থাপন করে। অন্তত ব্যাপারটা যে মেয়েদের জন্য চূড়ান্তভাবে অসম্মানজনক, তা বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু আবার খেয়াল করি যে, আমার কাকা’র নিজেরও এই নিয়ে সংকোচই আছে। সে পা বাড়িয়ে এভাবে খুশি হয়ে বসে নেই।  বাড়িতে মেয়েরাই জোর করে এই ব্যবস্থা করেন – পুরুষদের কারো আগ্রহ বা জোর কিছু ছিল না।

পুরুষতান্ত্রিকতা টিকিয়ে রাখতে নারীর অবদান বুঝতেও বই পড়তে লাগেনি। এইসব অভিজ্ঞতা একসূত্রে গেঁথে তাতে নাম দেওয়ার ক্ষেত্রে বইপত্রের অবদান নিশ্চয়ই ছিল।

শেষকথা –

আমি বিবাহ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বা বিপক্ষে কিছুতেই নই। কেউ করে ভালো থাকলে থাকুক। কিন্তু বিবাহ অনুষ্ঠান, সামাজিকতা – বিশেষত হিন্দুবাড়িতে যেভাবে আজো উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত মেয়েকেও  নাজেহাল করে “সমর্পণ” করা হয় পিতা থেকে পতির হাতে, তাতে আমার লজ্জা লাগে। এই আচার থেকে মেয়েদের মুক্তি আদৌ কি নেই!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *