বোরখা পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনের পোশাকি চেহারা
আফরোজ ন্যান্সি ।। আমার বাবা প্রচন্ড রকম আধুনিক মানুষ ছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হওয়া একজন পুরুষ হিসেবে কিছু সীমাবদ্ধতা তারও ছিল, কিন্তু চিন্তা ও মননে আপাদমস্তক আধুনিক একজন মানুষ ছিল। আব্বু তার পছন্দ- অপছন্দগুলি কখনোই আমার মায়ের সাজ-পোশাক-চলাফেরার উপর আরোপ করতে চায় নাই। তবে আব্বুর শখ ছিল আম্মুকে একটু আধুনিক পোশাকে দেখার। বহুবার তার পছন্দের স্কার্ট, লেডিস শার্ট, প্যান্ট, স্লিভলেস ম্যাক্সি কিনে আনতো কখনো যদি আম্মু একবার হলেও শখ করে পরে। হয়তো মিনমিন করে দুই-একবার বলতো একবার পরে দেখার জন্য; কিন্তু কখনোই জোর করে নাই, চাপায়ে দেয় নাই। আফসোস ওইগুলি ওইভাবেই পরে থেকে থেকে নষ্ট হইছে। আম্মু কোনোদিন ছুঁয়েও দেখে নাই ওগুলি।
একদিন হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম, আম্মু থ্রি-পিস রাইখা বোরখা পরা শুরু করলো। তার কপালের উপর সুন্দর করে কাটা কোকড়ানো চুলগুলি সে ক্লিপ দিয়ে আটকায়া রাখতে শুরু করলো। আব্বু সেদিনও তার ইচ্ছাকে সম্মান করছে। কখনোই বলে নাই, বোরখা পইরো না। আম্মু থ্রি-পিস পরুক কিংবা বোরখা, আব্বু হাসিমুখে তার সম্মান করে গেছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে বোরখা আমার মায়ের ব্যক্তিগত চয়েজ। কিন্তু এইটার পিছনে আমাদের দেশের ক্রমবর্ধমান পোশাকের রাজনীতি প্রবলভাবে উপস্থিত। আমার মায়ের মতো অসংখ্য নারী আছেন যারা নিজেকে ভালো নারী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য বোরখা পরেন। ব্যতিক্রমও আছে। আমার এক ফুপু শুধুমাত্র বাইরে যাওয়ার সময় জামা পাল্টানোর আলসেমির কারণে বোরখা পরে।
আমার পর্যবেক্ষণ হইলো এই দেশের নারীরা তিন কারণে বোরখা পরেন –
প্রথমত, পরিবার ও সমাজের চাপে। গ্রাম, মফস্বল কিংবা শহরের বেশিরভাগ নারীই হয় বাপের বাড়ি অথবা শ্বশুরবাড়ি অথবা সামাজিক চাপে বোরখা পরতে বাধ্য হন। এখন বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়িতে যে উপহার যায় তার মধ্যে এক পিস বোরখা থাকে। এ যেন কিছু না বলেও বলে দেওয়া যে, বিয়ের পরে বোরখা পরতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এই যে একটা বিশাল সংখ্যক নারীরা পারিবারিক ও সামাজিক চাপে বোরখা পরতেছেন, ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাকি নারীদের উপর একটা অদৃশ্য চাপ সৃষ্টি হইতেছে বোরখা পরার। এতো বোরখা পরিহিত নারীদের মধ্যে বোরখা না পরা নারীদেরকে সমাজ অসতী, বেহায়া নারী হিসেবে গন্য করে। ফলে সমাজে নিজেকে সতী, ভদ্র ও ভালো নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মোক্ষম উপায় হইলো গায়ে বোরখা চরায়ে নেওয়া। যে সমাজে নারীর পায়ে পায়ে দোষ সেই সমাজে শরীর দেখায়ে চলা (পড়ুন বোরখা না পরা) জঘন্য অপরাধের সামিল। যে নারী বোরখা পরেন না, সে মানুষ হিসেবে যত ভালোই হোক, সমাজের চোখে সে বেহায়া অসভ্য নারী হিসেবেই গন্য হবে।
তৃতীয়ত, বিবিধ কারণ আছে বোরখা পরার, যেমন বাইরের যাওয়ার সময় পোশাক পাল্টানোর আলসেমি, প্রেম করতে গিয়া পরিবারের চোখ এড়ানোর উদ্দেশ্যে, আবার ক্রাইম করার উদ্দেশ্যে তো পুরুষরাও বোরখা পরে থাকেন অনেক সময়। আজকাল আবার নতুন ট্রেন্ড চালু হইছে, মেয়েদের শরীর থেকে কাপড় টেনে খুলে নেওয়া। যে সামান্য সংখ্যক নারী এখনো বোরখা পরছেন না, কিছুদিনের মধ্যে এরাও বোরখা পরা শুরু করবেন এই ভয়ে যে, বোরখা ছাড়া বাইরে গেলে কাপড় টেনে ছিঁড়ে খুলে নেবে এই সমাজ।
তো এতো কথা বলার কারণ হইলো, তাসকিনের স্ত্রীর একটা ছবি কাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতেছে। যেখানে তাসকিন হাফপ্যান্ট পরা হলেও তাসকিনের স্ত্রী বোরখাবন্দি। কেউ সমালোচনা করতেছেন এই বইলা যে, জামাই হাফপ্যান্ট পরা কিন্তু বৌ বস্তাবন্দি। অনেকে বলতেছেন এইটা তাদের পারসোনাল চয়েজ।
বোরখারে অবশ্যই আমি ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে নারাজ। বোরখা হিজাব এগুলি কখনোই ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে পারে না। এর পিছনে থাকে শক্তপোক্ত রাজনীতি। আমিতো মনে করি, কোনো পোশাকই আসলে নিছক ব্যক্তিস্বাধীনতা না। এর পিছনে অনেকগুলি আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক উপাদান কাজ করে। ঠিক যে কারণে গুলশানের রাস্তায় আপনি যে পোশাক পরে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারবেন, যাত্রাবাড়ীর রাস্তায় তা পারবেন না। ঠিক যে কারণে একই রকম ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার পরেও ফিনল্যান্ডের নারী প্রধানমন্ত্রী যে পোশাক পরে পার্লামেন্টে যেতে পারেন তা আমাদের দেশে সম্ভব না।
যেহেতু তাসকিন-পত্নী এই সমাজেই বাস করছেন, তার চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করছে এই আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অবস্থা। অতএব, কেবল তাসকিন-পত্নীর সমালোচনা না করে সমস্যার শেকড় নিয়ে কথা বলাই বেশি জরুরি। তার বোরখা ততক্ষন অব্দি আমার মাথাব্যথার কারণ হবে না যতক্ষন তা অন্যের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। যেমন ধরেন কিছুদিন আগে তিনি বোরখা পরেই সুইমিংপুলে নামছিলেন। সেটার সমালোচনা করে আমি লম্বা লেখা লিখছিলাম যেহেতু তিনি সুইমিং পুলের স্বাভাবিক রুল ব্রেক করে তা করছিলেন। শুধুমাত্র তাসকিন-পত্নী বলেই তিনি এই রুল ব্রেক করতে পারছিলেন অথবা বোরখা পরিহিত ছিলেন বলেই তিনি রুল ব্রেক করার অসীম ক্ষমতা অর্জন করছিলেন। কেননা হোটেল কর্তৃপক্ষ “বোরখা পরে সুইমিং পুলে নামা যাবেনা” বললে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনুভূতি আহত হয়ে যাইতে পারতো। বোরখা নারীকে এই ধরনের অন্যায্য প্রিভিলেজ দেয়। যে কারণে আপনি দেখবেন, বোরখা পরা নারীরা অন্যের সুবিধা-অসুবিধা, স্বাভাবিক নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। এরা রাস্তা পারাপারের নিয়ম মানেন না, এরা বাজার করতে গেলে অন্য নারীদের ধাক্কায়ে চলাফেরা করেন, এরা বাসে ওঠা-নামার সময়েও একই রকম আচরণ করেন, মোটকথা এরা কান্ডজ্ঞান বাসায় রেখে বাইরে বের হন। এদের মধ্যে নিজেকে মহান এবং বোরখাহীন নারীকে নর্দমার কীট মনে করার এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা কাজ করে। এরা “মাই হিজাব মাই চয়েজ” বলে শ্লোগান দিলেও অন্য নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে পোশাকের জন্য হেনস্থা করতে দ্বিধা করেনা। যদি বোরখা কেবলমাত্র একটা পোশাকই হবে, তাহলে এই পোশাক পরিহিতরা এতো দম্ভ কীভাবে অর্জন করলেন! কীভাবে এরা অন্য নারীর পোশাক টেনে ছিঁড়ে নেওয়ার মতো আগ্রাসী হয়ে ওঠেন! কারণ এরা জানেন, তাদের গায়ে পুরুষতন্ত্রের ইউনিফর্ম চাপানো আছে এবং তাই অন্য নারীর পোশাক ছিঁড়ে নিলেও তারা সমাজের কাছ থেকে বাহবা পাবেন।
জীবনে আমি আমার পছন্দের পোশাক পরার জন্য যাদের দ্বারা নিগৃহীত হইছি তার মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল বোরখা এবং হিজাব পরিহিত নারী। বোরখা গায়ে জড়ানোর পরে এরা গায়ে মানে না আপনি পুলিশ হয়ে ওঠে এবং অন্য নারীর কী পরা উচিৎ, কীভাবে চলা উচিৎ, গলার স্বর কতটা নিচু রাখা উচিৎ ইত্যাদি বিষয়ে পুলিশি তৎপরতা চালাতে নেমে পড়েন। কোনো শাড়ি কিংবা থ্রি-পিস কিংবা ওয়েস্টার্ন পরা নারীকে আপনি দেখবেন না অন্য নারীকে তার মতো পোশাক পরার আহ্বান জানাতে। কিন্তু বোরখা পরিহিতারা এটাই করেন। নিজে বোরখা পরার পাশাপাশি অন্য নারীদের এরা বোরখা পরানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেন। এটাই সমাজে বোরখা বৃদ্ধির সবচাইতে বাজে দিক। বোরখা হইলো সেই প্ল্যাটফর্ম যেখানে দাঁড়ায়ে একজন নারী, একজন পুরুষতান্ত্রিক পুরুষের মতো হিংস্র এবং নারীবিদ্বেষী আচরণ করেন। বোরখা সেই পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসন যা এক নারীকে অন্য নারীর উপর শারিরীক এবং মানসিক আক্রমণ চালাতে উৎসাহ আর সাহস দিতেছে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]