স্বীকৃতি ও মর্যাদাহীন নারীর ঘরের কাজ
রনি হক ।। শ্রমের মূল্য বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে পড়েনি আর সামাজিক আলোচনা শোনেনি এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। শ্রমশক্তি যখন থেকে পণ্য হয়েছে তখন থেকে শুধু মূল্য নয়, শ্রমের দাম আলোচনায় এসেছে এবং শ্রমশক্তির দাম অর্থাৎ মজুরি পাওয়া ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন গড়ে উঠেছে পৃথিবীর দেশে দেশে। মে দিবস এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। ১৮৮৬ সালের ১ মে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার আগে ১৮৫৭ সালে আমেরিকার সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের কর্মঘণ্টা, মজুরি বৈষম্য, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে এবং ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে রাজপথে নামে। পুলিশি নিষ্ঠুর আক্রমণে গুড়িয়ে দেয়া হয় সেই প্রতিবাদ ও দাবির আন্দোলনকে। কিন্তু আন্দোলন শেষ হয়নি, বরং নতুন রূপ নিয়েছে, নতুন দাবি সংযোজিত হয়েছে। তেমনি এক দাবি গৃহকর্মের স্বীকৃতি ও নারীর গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের দাবি।
পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যার ফলাফল নেই। কাজ সেটা ছোট হোক বা বড় হোক তার প্রভাব পড়বেই। কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে যে কাজের ফলাফল ছাড়া দৈনন্দিন জীবন অচল হয়ে পড়ে। মানুষের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক জীবন বিকশিত হওয়া তো দূরের কথা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে কিন্তু সে কাজ হলো এমন ধরনের কাজ যার কোনো স্বীকৃতি নেই, যে কাজের মর্যাদা নেই এমনকি যে কাজকে তাচ্ছিল্য করা হয় সবসময় আর যারা এই কাজ করেন তাদের কোনো পারিশ্রমিক নেই। এই স্বীকৃতিবিহীন, মর্যাদাহীন, মজুরিবিহীন কাজের নাম গৃহস্থালি কাজ। এসব কাজের ৮০ ভাগের বেশি করেন নারী। উদয়াস্ত ক্লান্তিকর এই গৃহস্থালি কাজ ছাড়া সমাজ ও পরিবার টিকে থাকা অসম্ভব।
নারীর কাজ শুনলেই মনের চোখে ভেসে ওঠে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছবি। কিন্তু ইট ভাঙা, মাটি কাটা, কৃষিকাজ করা, শিল্প কারখানায় কাজ করা, শিক্ষকতা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, গবেষক, পাইলট, ড্রাইভার, চা দোকানদার থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারী, পুলিশ-আর্মি এমন বহু পেশায় নারী আসছেন এগিয়ে। কিন্তু সব পেশায় থেকেও বা কোনো পেশায় না থেকেও যে কাজ তারা নীরবে করে যান তা হলো গৃহস্থালি কাজ। জীবন নিংড়ে নেয়া এ কাজে না আছে স্বীকৃতি আর না আছে সম্মান।
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, মজুরিবিহীন কাজে পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ দিনে ৬.৪৬ ঘণ্টা বেশি। ২০১২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর টাইম ইউজড সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৫ বছরের বেশি কর্মজীবীদের মধ্যে ঘরের বিভিন্ন কাজে পুরুষ দৈনিক ১.৪ ঘণ্টা এবং নারী ব্যয় করেন ৩.৬ ঘণ্টা। কর্মজীবী না হলে গড়ে নারীরা দিনে ৬.২ ঘণ্টা এবং পুরুষ ১.২ ঘণ্টা এ ধরনের কাজে ব্যয় করেন। এর পরের রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও নিশ্চয়ই এর খুব একটা তারতম্য হবে না।
যেকোনো শিশুকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার বাবা কী করেন? সে হয়তো বলবে, কৃষিকাজ করেন, ব্যবসা বা চাকরি করেন ইত্যাদি। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার মা কী করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তর হবে- কিছু করে না, ঘরের কাজ করেন।
শিশুরা এটা শিখেছে আর বড়রা এসব শিখিয়েছেন যুগ যুগ ধরে। কিন্তু বহুদিন ধরে একটা চিন্তা সমাজে থাকলেই তা সত্যি হয়ে যায় না। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে এবং উত্তর খোঁজা হচ্ছে, নারীরা ঘরে যে কাজ করে তা কি জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে না? যদি জাতীয় উৎপাদনে এর প্রভাব থাকে তবে গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি নেই কেন? এর আর্থিক মূল্য কি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়?
নারীর কাজের অর্থনৈতিক অবদান প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, মজুরির বিনিময়ে কাজ এবং টাকা উপার্জনের জন্য স্বনিয়োজিত কাজ, যা জিডিপির হিসাবে যুক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, নারীর মজুরিবিহীন কিছু পারিবারিক কাজ যেমন হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে বিক্রি করা ইত্যাদি। এর আর্থিক মূল্য জিডিপিতে যুক্ত হয়। তৃতীয়ত, নারীর গৃহস্থালি কাজ, যার বাজারমূল্য বা বিনিময়মূল্য নেই, যা বাজারজাত করা যায় না তা জিডিপিতে যুক্ত হয় না এমনকি শ্রমশক্তির হিসাবেও গণ্য হয় না। এসব অবৈতনিক কাজের মূল্যের একটা ছায়া হিসাব করেছিল গবেষণা সংস্থা সানেম। তাদের তথ্য অনুযায়ী যদি গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য হিসাব করা যায় তাহলে তা দাঁড়াবে নারীর ক্ষেত্রে জিডিপির ৩৯.৫৫ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ।
সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে যে, নারীর কাজের ৭৮-৮৭ শতাংশই অর্থনৈতিক হিসাবে আসে না। যেমন, কাপড় ধোয়া, রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যদি। ঘরে-বাইরে নারী যে কাজ করে তার পুরোটা হিসাবে আনলে এবং আর্থিক মূল্য বিবেচনা করলে জিডিপিতে নারী-পুরুষের অবদান সমান হবে। তখন আর কেউ বলতে পারবে না যে নারীরা কোনো কাজ করে না।
আমরা যখন আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে সবসময় ডিজিটালাইজেশনের কথা বলি তখন অর্থনৈতিক সব কিছুরই তো হিসাব করা সম্ভব। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ, নৈতিক অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা, নারীর অধিকার ও সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে তো বটেই সামাজিক ন্যায্যতার কারণেও নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকার।
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকাশিত ‘কেয়ার ওয়ার্ক অ্যান্ড কেয়ার জবস ফর দ্য ফিউচার ডিসেন্ট ওয়ার্ক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারীরা পুরুষের তুলনায় চার গুণের বেশি সময় গৃহস্থালি ও বেতনবিহীন কাজে ব্যয় করছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশে পুরুষ জনসংখ্যা ৮৭শতাংশ আয়মূলক কাজে জড়িত। কিন্তু অর্থ উপার্জনকারী কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৩৬ শতাংশ। গৃহস্থালির কাজে বাকি যে ৬৪ শতাংশ নিয়োজিত নারীর শ্রমশক্তি তাকে হিসাবে ধরা হয় না। নারীর শ্রমে সংসারে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার মূল্য না ধরায় জিডিপিতেও উঠে আসছে না নারীর অবদানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র। জিডিপিতে এ কাজ অন্তর্ভুক্তির কোনো গ্রহণযোগ্যপদ্ধতি না থাকায় শ্রমের অবদান আছে, তার ফল ভোগ করছে সমাজ ও পরিবার কিন্তু নেই কোনো স্বীকৃতি।
সারা বিশ্বে বর্তমানে নারীর মজুরিবিহীন গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। ভারত, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, নেপালসহ বেশ কিছু দেশ এ ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে আছে। তারা হিসাববিহীন নারীর শ্রমকে কীভাবে অর্থনৈতিক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেটার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে নারী ও পুরুষ উভয়ই মজুরিবিহীন কাজে নিয়োজিত থাকলেও এ কাজ সবচেয়ে বেশি করছেন নারীরা। এসব কাজ হিসাবে আনা হলে মোট দেশজ উত্পাদন (জিডিপি) বাড়ত প্রায় ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
নারীর মজুরিবিহীন এই গৃহস্থালি কাজের আর্থিকমূল্য নিরূপণের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বের করা দরকার তা না হলে নারীর ঘরের কাজ থাকবে উপেক্ষিত, পাবে না স্বীকৃতি ও মর্যাদা।
পাশাপাশি দেশের শ্রমশক্তি গড়ে তোলা, ঘর ও সমাজে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা মানুষেরা যখন বয়স্ক হয়ে অসহায় হয়ে পড়ে তখন সেই বয়স্ক নারীদের জন্য দুঃস্থ ভাতা নয়, তাদের পুনর্বাসনকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
বাজেট ক্রমাগত বড় হচ্ছে, বাড়ছে ট্যাক্স আদায়ের পরিমাণ। জিডিপির আকার বড় হচ্ছে আর বাড়ছে মাথাপিছু আয়। এই বাজেট বড় হওয়া আর জিডিপি বাড়ার পিছনে যাদের অবদান তারা কি আড়ালেই থাকবে? মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা কি বাড়বে না? বিশাল বাজেটের পাশে ক্ষুদ্র পারিবারিক বাজেট হয়তো চোখে পড়বে না কিন্তু এই বাজেট ছাড়া জীবন তো চলে না। ফলে বাজেট প্রণয়নের সময় নারীর হারিয়ে যাওয়া শ্রম ও সময়কে যেন বিবেচনায় রাখা হয়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]