November 3, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

“এই মেয়ে, ওড়না ঠিক করে পরতে পারো না?”

সাদিয়া আক্তার।। “এই মেয়ে এই, এদিকে আসো, ওড়না ঠিক করে পরতে পারো না? এভাবে পরেছো কেন? সবকিছু দেখা যাচ্ছে। বেয়াদপ, অসভ্য মেয়ে, এভাবে কেউ রাস্তায় বের হয়?”

কথাগুলো আওড়াচ্ছিলেন একজন মহিলা। সেদিন আমাকে এতো এতো কথা শুনিয়ে সে রাস্তার অন্য মানুষদের থেকে অনেক বাহবা পেয়েছিলেন। আমাকে এতো কথা শুনানোর পর তাকে খুব উৎফুল্ল মনে হচ্ছিলো কারণ সে একটা মেয়েকে রাস্তায় বসে হেনস্থা করতে পেরেছে তার চলাফেরার জন্য।

মাঝে মাঝে আমার গায়ে কাঁটা দেয় এটা ভেবে যে কিভাবে একটা নারী কেন অন্য নারীর সাথে এমন বাজে ব্যবহার করে তার চলাফেরার জন্য? সেদিন তার কথাগুলো আমার কাছে ততটাই বিরক্তিকর লাগছিল যতটা লাগছিল আমার নিজের ওড়নাটাকে।

সমাজে এমন মানুষ আমাদের চারপাশেই সর্বদাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব, পরিচিত – অপরিচিত অনেকেই পোষাক নিয়ে শুধু জ্ঞান দিতেই থাকবে আমাকে। কিন্তু এসব লোকদের আমার খুব টক্সিক লাগে। তাই তাদের এই টক্সিক থিওরিগুলোও আমি নিতে পারিনা। আমি ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী হয়েও সায়েন্সের অনেক থিওরি বুঝার ক্ষমতা রাখি কিন্তু এই মৌলবাদী থিওরিগুলো কেন যেন আমার মাথায়ই ঢোকেনা।

সেদিন তার সাথে তাল মিলিয়ে আরেকজন বলে উঠলেন, “ওড়না ঠিক করবে কি, মা*গীদের মতো একটা টিপ তো কপালে আছেই। এ্যাগো জন্যেই তো দ্যাশটার আইজ এই অবস্থা”।

আমার সাজ, পোষাক পরিচ্ছদ যদি সমাজের জন্য দুর্দশা হয়ে থাকে তবে আমিও সেই সমাজের নোংরা মন-মানসিকতার প্রত্যেকটা মানুষকে বলতে চাই, আমি ঠিক সেইভাবেই চলবো যেভাবে আমি কমফোর্ট ফিল করি, আমি সেইভাবেই সাজবো যেভাবে আমার চোখে আমাকে সুন্দর লাগবে। আমি ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়তে ভালোবাসি, আমি পছন্দ করি শাড়ির সাথে বড় গলার হাতা কাটা ব্লাউজ পড়তে, গরমের দিনে হালকা সুতি কাপড়ের ছোট ড্রেস পড়তে। সাজতে গেলে টিপ আমার আগে চাই। শুনেছি টিপ নাকি বে*শ্যার প্রতীক! টিপ নাকি পুরুষকে খুব আকর্ষিত করে! নোংরা মন-মানসিকতার মানুষ যদি এমনটাই ভাবে তাহলে আমাদেরও উচিত তাদের এড়িয়ে চলা।

সেদিন বাসে বসে হেলপার যখন ভাড়া নিতে আসলো তখন আমার থেকে বিশ টাকা কম রেখে আশি টাকা ফেরৎ দিল। কারণ তার পরিপূর্ণ মনোযোগ ছিল আমার বুকের উপর।একটু ক্লিভেজ দেখার আশায় বেচারা তার বিশ টাকা লস করে দিল। রাস্তাঘাটে চলার সময় কিভাবে একটা মেয়ের বুকের সাইজটা দেখা যায়, কিভাবে একটু শরীরে চাপ দেয়া যায়, কোমর কিভাবে দুলছে , কতটুকু ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে সেটা দেখতে দেখতেই কিছু কুলাঙ্গার কাপুরুষ তাদের নড়বড়ে পুরুষাঙ্গটা দাড় করিয়ে দিতে পারে। এতে যে তারাই লজ্জার মুখে পড়ে কাপুরুষগুলো সেটা বুঝতেই পারে না।

একবার এক মৌলবাদী লোক মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “তেঁতুল ঝুলাইও না , তেঁতুল দেখলে লালা তো ঝড়তেই পারে।” কথাটা কত নোংরা ছিল একবার ভেবে দেখুন। নিজেকে সংযত করতে না বলে সে খুব আরামসে একটা মেয়েকে অসম্মান করে গেল। মাঝে মাঝে ভাবি তার জীবদ্দশায় সে কতশত তেঁতুল দেখে না জানি লালা ঝড়িয়েছেন। সমাজের পুরুষদেরকে আশকারা দিয়ে গিয়েছেন খুব এই কথা বলে। এখন মেয়েদের শরীর দেখে তাদের লালা তো ঝড়তেই পারে কারণ সব দোষ তো মেয়েদের পোশাকের, মেয়েরা হলো তেঁতুল।

মেয়েদের পোশাকেরই যদি দোষ হতো তাহলে কি কোনো বৃদ্ধা বা শিশু নির্যাতিত হতো? সমাজের মানুষের নেতিবাচক মনোভাব আমাদের কতটা নিচে নামিয়ে দেয়! একটু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সব কিছু সুন্দর করে তুলতে পারে। আসুন আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করি, তবেই গড়ে উঠবে একটা সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর সমাজ।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

One thought on ““এই মেয়ে, ওড়না ঠিক করে পরতে পারো না?”

  • Muhaimin

    “মেয়েদের পোশাকেরই যদি দোষ হতো তাহলে কি কোনো বৃদ্ধা বা শিশু নির্যাতিত হতো?”
    এই কথার বিপক্ষে তারা অবশ্য একটা যুক্তি দেখায়। তারা বলতেছে, রাস্তাঘাটে, শপিং মলে, টিভিতে এখানে সেখানে মেয়েদের উল*ঙ্গ অবস্থায় দেখে দেখে তাদের বা*ড়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঐসব মেয়েদের তারা যেহেতু কাছে পায় না তাই সময় সুযোগ বুঝে যারে কাছে পায় তারেই রে*প করে ফেলে। এজন্যেই শিশু, বৃদ্ধা, বোরকা পরিহিতদের রেপ হতে দেখা যায়। ঘুরে ফিরে পোশাকেরই দোষ টানতে হবে! এখানে তারা নিজেদের কোনো দোষ দেখে না। আত্মনিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই সেখানে নাই। ধর্মের আইনকানুন সেখানে বাকহীন।
    এখানে উল্লেখ্য যে, মধ্যপ্রাচের মুসলিম দেশগুলোতে, যেখানে পোশাক নিয়ে কোনো ঝামেলা নাই, ইসলামী আইন খুব কঠোর, সেখানেও প্রচুর ধর্ষ*ণ হয়। সেখানে কীসের দোষে এমনটা হয়? এই যে প্রতি বছর বাংলাদেশী নারী কর্মীরা বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে প্রেগন্যান্সী নিয়ে দেশে ফেরে এর দায় কীসের? তাদের নির্যাতনের ধরণও অমানবিক। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি পালাক্রমে বাবা, ছেলে এবং চাচাদের দ্বারা ধর্ষ*ণের স্বীকার হয়েছেন এরকম ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ জানা যায় ভুক্তিভোগী নারীদের কাছ থেকে। এসব ধর্ষণের ঘটনা কেন ঘটে? ঐসব ধর্ষ*কের শিথিল শিশ্নগুলো কীসের প্রভাবে উড্ডীন হয়েছিল!?
    এখন কথা হলো, যদি নারী সমাজ অভিযোগ তুলে বসে, বডি বিল্ডার, সিক্সপ্যাকওয়ালা, টাইট-ফিট টিশার্ট পরা ছেলেদের দেখে তাদের মনেও কুবাসনা জাগ্রত হয়। শুধু দৈহিক শক্তিতে পেরে উঠতে পারে না বলে নিজেদের নিবৃত করে, তখন সমাজের পুরুষদের বোরকা পরে রাস্তায় বের হতে কে বাধ্য করবে?

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *