লড়াই শুধু মাঠের নয়, মেয়ে-জীবনেরও
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল নেপালের দলটিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়া নারীদের চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি জিতেছে। আমি জাতীয় ফুটবল দল হিসবেই দলটাকে উল্লেখ করলাম বটে, কিন্তু প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ওরা সব সময়ই এই দলটিকে নারী ফুটবল দল হিসাবে চিহ্নিত করে। পুরুষদের দলটিকে বলা হয় জাতীয় দল আর নারীদের দলটিকে নারী জাতীয় দল। এই প্রথাটা ভাঙা দরকার। আপনার যদি নারী দল আর পুরুষ দল আলাদা করে বুঝাতে হয়, তাইলে পুরুষ দলটিকে পুরুষ দল বলবেন আর নারীদের দলটিকে নারী দল। একটাকে বলবেন শুধু জাতীয় দল, আরেকটাকে নারী জাতীয় দল – এটাও এক প্রকার বৈষম্য। কেননা আমরা নারীর প্রতি বৈষম্যে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আমাদের ভাষা, আমাদের সাহিত্য, আমাদের সঙ্গীত, আমাদের ধর্ম, আমাদের আইন, আমাদের রাজনীতি সবকিছুই পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে অধম বিবেচনা করে, সেইজন্যে এইটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। হাওয়ার মধ্যে থাকি বলে আমরা যেমন অক্সিজেন বা নাইট্রোজেনের উপস্থিতি টের পাইনা, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।
বাংলাদেশের মেয়েদের আজকের এই জয়টা নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। একটা তো আছে খেলার দিক, বাংলাদেশ দল প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার শিরোপা জিতেছে, ফাইনালে আসার পথে আমরা অনায়াসে হারিয়েছি পাকিস্তান, ভারত ও ভুটানকে বড় বড় ব্যবধানে। ফাইনালে নেপালকে হারানো – সেটাও বড় ঘটনা, কেননা এর আগে নেপালের বিপক্ষে মেয়েদের ফুটবলে আমাদের জাতীয় দল কখনো জেতেনি। আর পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দল ফাইনালের ঐ একটা গোল ছাড়া আর কোনো গোল খায়নি। এরকমটা তো কোনো খেলাতেই খুব একটা হয় না আরকি। বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে আজকের এই জয় – সে তো একটা বিশাল মাইল ফলক। শুদ্ধ ক্রীড়ার দৃষ্টিতেও আজ আমাদের হয়েছে এক বিশাল অর্জন। কিন্তু কেবল খেলার দিক ছাড়াও আজকের এই জয়ের একটা রাজনৈতিক দিকও আছে এবং, সবিনয়ে বলি, নারী খেলোয়াড়দের বিজয়ের এই রাজনৈতিক দিকটা ক্রীড়াঙ্গনের অর্জনের চেয়ে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক দিকটা বলি। রাজনীতি মানে আওয়ামী লীগ বিএনপি সিপিবি জামাত ইত্যাদি নয় – দলাদলি নয়। নারী ও পুরুষের হাজার বছরের পুরনো ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যেটা, সেই রাজনীতি। ধনী ও গরীবের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সেই রাজনীতি। আমাদের এই দলটার বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই জন্ম নিয়েছে নিতান্ত দরিদ্র পরিবারে। দরিদ্র পরিবারে কন্যা শিশু হয়ে জন্মানো মানে প্রতিবেলা খাবার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়া। অনাদরে অবহেলায় বড় হওয়া দরিদ্র ঘরের কন্যা শিশুদের সাধারণ গন্তব্য হচ্ছে শৈশবেই বিবাহ হয়ে সন্তান জন্ম দেওয়া আর উচ্ছবৃত্তি করা আর অসুখে অপুষ্টিতে মৃত্যুবরণ করা। এই মেয়েগুলি ফুটবলকে করেছে ওদের লড়াইয়ের হাতিয়ার। লড়াই তো ওদেরকে করতে হয় নারী হিসাবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আবার দারিদ্রের বিরুদ্ধেও। এই দুই লড়াইয়েই ওরা লড়েছে ফুটবলকে খেলাটিকে হাতিয়ার করে। আমাদের জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন যেরকমটা বলেছেন, স্পষ্ট করেই বলেছেন, জীবনযুদ্ধে আমাদের দলের প্রতিটা সদস্য লড়াই করে অভ্যস্ত।
এবং সেই লড়াই তো আমরা দেখেছি। আমাদের এখানে মেয়েদের জন্যে ফুটবল খেলা যখন শুরু হয়, তখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় লোকে মিছিল করেছে মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করার জন্যে। যেসব মেয়েরা ফুটবল খেলতে এসেছে ওদেরকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মোকাবেলা করতে হয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। আমরা আজকে পনের জনের জাতীয় দলকে দেখছি বটে, কিন্তু ফুটবল খেলতে এসেও কত শত মেয়ে যে শেষ পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যেতে পারেনি, সেই হিসাব তো আমরা জানিনা। সামাজিক বাধার জন্যে খেলা চালিয়ে যেতে পারেনি, কৈশোরেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে বলে আর খেলতে পারেনি এইরকম অসংখ্য উদাহরণ পাবেন। আজ আমরা যাদেরকে দেখলাম কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে জাতির জন্যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে, ওরা হচ্ছে সেইসব সাহসী যোদ্ধারা যারা শেষ পর্যন্ত বিজয়ের ক্ষণটি দেখতে পেয়েছে বটে, কিন্তু সেই পর্যন্ত আসতে আসতে হারিয়েছে অসংখ্য সহযোদ্ধাকে। আমাদের দলের ক্যাপ্টেন সেটা সম্পর্কেও সচেতন বলেই তিনি বলেছেন, ওদের আজকের জয় হয়তো আগামী দিনের আরও অনেক মেয়েদের জন্যে বিকাশের পথ সুগম করে দেবে।
যারা মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া থামিয়ে দিতে চায় ওদেরকে নিতান্ত তুচ্ছ ভাববেন না। হেফাজতে ইসলামের তের দফা আপানদের মনে আছে? সেই তের দফার অংশ ছিল মেয়েদের অবাধে বাইরে আসা নিষিদ্ধ করার দাবি। ওদের সেইসব দাবির পক্ষে যারা আছে, ওরা সংখ্যায় বা শক্তিতে নিতান্ত কম নয়। আজ আমাদের দেশের পথেঘাটে, পরিবহনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এমনকি আদালতেও নারীকে পোশাক নিয়ে যে বৈরিতা মোকাবেলা করতে হয়, সেটাও হচ্ছে ঐ একই বদ মতলবের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই বদ মতলবের পক্ষে ওরা ব্যবহার করে প্রবল শক্তিশালী এক হাতিয়ার – ধর্ম। সেই হাতিয়ার এতো শক্তিশালী যে, এমন কি প্রবল ক্ষমতাধর যে রাষ্ট্রযন্ত্র, সেই রাস্ট্রযন্ত্রও ধর্মের কাছে অসহায়। এই ছোট ছোট মেয়েগুলিকে লড়তে হয়েছে সেইসব শক্তির বিরুদ্ধে। আর সেই লড়াইয়ে ওরা যে ক্রমাগত জিতেই এসেছে দুরন্ত সাহসের সাথে, তারই প্রতীকী প্রকাশ হচ্ছে আজকের এই জয়।
না, বিরাট কোন বিপ্লব ওরা করে ফেলেনি বটে। কিন্তু নিতান্ত ছোট কান্ডও ওরা করেনি। এই দলটি ওদের মতো করে একরকম সচেতনতা সবসময়ই বহন করেছে। আপনি যদি ওদের প্রতিটা খেলা দেখে থাকেন তাইলে দেখবেন, খেলাগুলির সময় মাঠে ওদের আনন্দ উল্লাসের সময়ও ওদের আচরণে প্রকাশ পেয়েছে নানান বার্তা। পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলায় গোল উদাযপনের সময় গুলি করার ভঙ্গি, মিলিটারি কায়দায় স্যালুট দেওয়া – সেগুলি অর্থহীন ছিল না। ভুটানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়ার্ধে ওরা খেলতে নেমেছে গাঢ় করে লাল লিপস্টিক পরে। দ্বিতীয়ার্ধে চারটি গোল করেছে, প্রতিবার গোলের পর সকলে জটলা করে এক জায়গায় হয়েছে আর ঠোঁটের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে লিপস্টিকের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রতিটা খেলায়ই ওরা ওদের নিজেদের মতো করে নিজেদের প্রকাশ করতে চেয়েছে যেটা শুধু ফুটবলে সীমাবদ্ধ ছিল না। আর ফাইনালের আগের দিন দলের ক্যাপ্টেন ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছে – লড়াইয়ের কথা বলেছে যে লড়াই কেবল ফুটবল খেলায় জেতার লড়াই নয়।
এই ফুটবল দলটির প্রতি আমার ব্যক্তিগত একটা টান ছিল প্রথম থেকেই। এই দলটাকে দেখেই আমার মনে পড়তো আমার সেইসব বন্ধুদের কথা যাদেরকে আমি প্রাইমার স্কুলেই হারিয়েছি। না, মরে যায়নি ওরা। মেয়ে বলে ওদের পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। অতি শৈশবে আমি দেখেছি লেখাপড়ায় মেধাবী হওয়ার পরও, এমনকি পিতামাতার সামর্থ্য থাকার পরেও কেবল মেয়ে বলেই আমার অনেক বন্ধুকে আর পড়তে দেওয়া হয়নি। ঐ হুজুরটার কথা মনে আছে না আপনাদের? যিনি বলেছিলেন যে মেয়েদেরকে চার পাঁচ ক্লাসের বেশি পড়ানোর দরকার নাই। আমি যে এলাকায় প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি সেখানে এইসব হুজুরদের ছিল প্রবল দাপট। আমার অনেক বন্ধুকে ঝরে পড়তে দেখেছি শুধু দারিদ্র্যের জন্যে। এই দলটি যখন ফুটবল খেলতে নামে, আমি যেন আমার সেইসব হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের দেখি। না, আমার বন্ধুরা করতে পারেনি, কিন্তু আমাদের এই মেয়েরা, ওরা ঠিকই লড়াইটা করে যাচ্ছে।
আশাবাদী হই। অনেক আশাবাদী হই। আশা করি যে ফুটবল মাঠে আমাদের নারীদের এই লড়াই – এই লড়াইটা কেবল খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আর কেবল কয়েকজনের ব্যক্তিগত সংগ্রামেও সীমাবদ্ধ থাকবে না। আমাদের প্লেয়াররা, সাঞ্জিদা, রুপনা, আঁখি, সাবিনা, তহুরা মারিয়া, শামসুন্নাহার, মাসুরা, স্বপ্না, কৃষ্ণা, শিউলি, ঋতুপর্না আর আনুচিংএর জন্যে এটা কেবল একটা ফুটবল খেলা বা মাঠের লড়াই ছিল না – এটা ছিল ওদের জীবনের লড়াইয়েরই অংশ। আমাদের সকল নারীর জীবনেও নিশ্চয়ই একদিন এই লড়াইয়ের চেতনাটা ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মেয়েরা জিতে নেবে জীবন, জয় করে নেবে নিজেদের অধিকার – সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, সে তো অজস্র অর্জনের সূচনা মাত্র।