September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সন্তান প্রসব করে এসে পরীক্ষায় বসা!

প্রিয়া দেব ।। “পরীক্ষার আগের দিন সন্তান প্রসব করে সকালে এসএসসি পরিক্ষা দিলেন অমুক”। কিংবা “সন্তান প্রসবের ঘণ্টাখানেক পরেই পরীক্ষায় বসলেন তমুক”।

এইসব খবরকে পত্রিকার হেডলাইন বানিয়ে একজন মানুষের অমানুষিক কষ্টকে গ্লোরিফাই করা বন্ধ করা খুব জরুরি। এইসব খবর ছাপিয়ে, এরপর কমেন্ট সেকশনে মানুষের বাহবা না দেখে আসলে  প্রশ্ন করা উচিত যে, একজন ষোলো সতেরো বছরের কিশোরী বাচ্চা জন্মদানের মতো ব্যাপারটার মাঝখান দিয়ে কেন যাচ্ছেন তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে?

তাও আবার এই বয়সে?

এইসব জিনিসকে প্রমোট করা, গ্লোরিফাই করা খুবই খারাপ একটা চর্চা, কারণ এইসব উদাহরণ দেখিয়েই এই সমাজের একটা শ্রেণি ক্রমাগত মেয়েদের দিকে আঙুল তুলে, এরা যেকোনো কিছুতে বলে “অমুক তো বাচ্চা জন্মাইয়াও পরীক্ষা দিতে পারছে, তুমি কেন পারবা না?” এরা মেয়েদের আজীবন করে আসা স্ট্রাগলগুলোকে নর্মালাইজ করার চেষ্টাতে সবসময় বদ্ধপরিকর।

আমি নিজে যখন এইচএসসি দেই তখন আমার আশেপাশের বহু মেয়েকে দেখেছি বিয়ে নামক ব্যাপারটার মাঝখান দিয়ে যেতে, এক বাচ্চা মেয়ের কথা মনে আছে যে কিনা গায়ে হলুদের দিক সকালে কিছু না খেয়ে, পরিসংখ্যান পরিক্ষা দিয়ে, দৌড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরেছিলো,কারণ বিয়ের কনে দেরি করলে খুব সমস্যা হয়ে যেতো। কিন্তু ওই মেয়ের ভাইয়ের যখন এসএসসি পরিক্ষা হয়, তখন মেয়ের বাপ নিজের ছেলের জন্য গাড়ি ভাড়া করেছিল যাতে বাড়ির কাছে কেন্দ্রে যেতে কোনো অসুবিধা না হয় এবং মা নিজের ছেলেকে রোজ যত্ন করে খাওয়াতেন সামনে বসে।

শুধু এই ঘটনা নয়, আমি এমন অসংখ্য মেয়েকে দেখেছি যারা কিনা মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। যে ছেলের মা বাবা নিজের ষোলো-সতেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকেন কারণ তার ছেলে কিচ্ছু জানে না, বুঝে না দুনিয়ার, সেই ছেলের মা বাবাই ভাবেন তাদের একই বয়সের মেয়েকে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিলে বাচ্চা মেয়ে সেটা খুব ভালো সামলে নেবে! আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওইসব বাবা মা আসলে ওইটাও ভাবেন না, উনারা শুধু মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলেই শান্তি পান। কারণ বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব মেয়ে মারা যায়, তাদের মৃতদেহের সামনে কাঁদতে থাকা বাবা মায়েদের কাছ থেকে সত্যি খবর বার করতে পারলে জানা যেতো যে, তাদের মৃত মেয়ে বহুবার তাদেরকে নির্যাতনের ব্যাপারে বলেছে, তারাই বুঝিয়েছেন মেয়েকে সংসার না ভাঙার জন্য, কারণ এই শিক্ষিতদের সমাজে দাঁড়িয়েও আমরা এই বিশ্বাসে বেঁচে থাকি যে “মেয়ে মানুষের সংসারই সব”।

এই সমাজে টিকে থাকতে হলে যেসব বেসিক স্কিল একজন মানুষের জানা থাকতে হয়,সেসব বেসিক স্কিল একজন ছেলে যখন শিখতে যায় তখন তার জন্য একটা স্বর্গীয় পরিবেশ বানিয়ে রাখা হয়। সেটা পরিক্ষাই হোক কিংবা রান্নাঘরে মাকে সাহায্য করা। কিন্তু এই একই জায়গায় একটা মেয়ে থাকলে ধরেই নেওয়া হয় এইসব কাজ মেয়েকে শিখতেই হবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কোনো ডিগ্রি নিতে গেলে বয়স্ক ছেলেটিকে ঠিকই মা যত্নে ভাত রান্না করে খাওয়ান কিন্তু মেয়েটি আরো পাঁচজনের জন্য রান্না করে তারপর পড়বে – এটাই স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়। অনেক পরিবারে তো শর্তই থাকে যদি বিয়ের পর পড়াশুনা করতে হয় তবে সংসার সামলে করতে হবে, এই নিয়ম না মানলে মেয়ের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। এবং এতোকিছুর পর একটা মেয়ে পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে তার মাথাতেই ঢুকে যায় যে নিজের স্ট্রাগলকে এখন গ্লোরিফাই করতে হবে, সেও তখন আরেকটা মেয়েকে বলে “বাচ্চাকাচ্চা জন্মায়েই তো আমরা পরীক্ষা দিতে গিয়েছি, তুমি কেন পারবা না”।

আমার ক্লাসে চেনা একজন বড় আপু আছেন,যিনি প্রতিটা ক্লাসে এসে শোনান তিনি বাচ্চা সামলিয়ে ক্লাসে আসেন, প্রতি পরিক্ষায় খাতা জমা দেওয়ার সময় টিচারকে বলেন তিনি বাচ্চা সামলিয়ে ক্লাসে এসেছেন, যেন বাচ্চা সামলিয়ে ক্লাস করে উনি অনেক মহান একটা কাজ করছেন এবং তার এই মহানুভবতার সামনে আমরা বাকি স্টুডেন্টরা রীতিমতো তুচ্ছ। এই কথাগুলার জন্য দায়ী এই সমাজ আর সমাজের কার্যকলাপ। আজকে একটা মেয়ে বাচ্চা জন্ম দিয়ে এত কষ্ট করে নিজের অদম্য ইচ্ছায় পরীক্ষা দিতে এসেছে, এদেশের পত্রিকা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই কাজগুলোকে এমনভাবে দেখায় যেন একটা মেয়ের এই কষ্ট করাটাই স্বাভাবিক। আর এজন্যই এইসব সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।

গ্লোরিফাই তো অনেক হলো, এবার উচিত আমাদের প্রশ্ন তোলা কেন একটা মেয়েকে এই বিষয়টার মাঝখান দিয়ে যেতে হবে, কেন এসএসসির গণ্ডি পেরোনোর আগেই একটা মেয়েকে এত কম বয়সে বাচ্চা জন্ম দিতে হবে, এবং এইসব কাজকে মহান কিছু বানানোর চেষ্টাকে বন্ধ করতে হবে। মেয়েদের জন্য এই পৃথিবী এমনিই কঠিন, এটাকে কঠিনতর বানানোর জন্য এসব মহান বানানোর মুখোশ পড়া প্রচেষ্টাকে এবার থামাতে হবে, সেজন্য আওয়াজ তোলা খুব জরুরি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *