সহোদর: জন্ম না নেওয়া এক আজন্ম প্রতিদ্বন্দ্বী
অপর্ণা হাওলাদার ।। জন্মাবধি তুলনা শুনে আসছি। “ভাই”দের সাথে।
“ভাই নাই?”
“আহারে একটা ছেলে নাই”
“ভাই” থাকলে আমার বাবা-মায়ের জীবনে আনন্দ থাকতো, সমাজে সম্মান থাকতো – তাও জেনেছি অন্য কিছু জানার আগেই। সমাজ বোঝার আগেই। আমার মামা-কাকা সবারই ছেলে আছে, মায়ের একার নাই। ছেলে যে নাই, এটা যে অতি কষ্টের ব্যাপার – এই কথা ছেলে আর মেয়ের পার্থক্য বোঝার আগে থেকেই আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছি, ছোট হয়ে থাকতে হবে – নিজের কোনো দাবিদাওয়া থাকবে না, অন্যকে দিয়েই সুখ পেতে হবে, অন্য কোনও জ্ঞান হওয়ার আগে এটাও জেনেছি। কপালের গুণে মা-দিদিমা এমন জুটেছিল যে, মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছি, পড়াশোনা ছাড়া এই কপাল আর কিছু দিয়ে ফেরানো যাবে না – সে কথা তারা বারবার বলতেন। পড়াশোনা না করলে অন্যের ঘরে লাথি-গুতা খেয়ে থাকতে হবে, এটা শুনতে শিশুবয়সে কারোরই পুলক লাগার কথা না, কিন্তু আমার ব্যক্তিজীবনে একাডেমিক ধারায় এই ভবিষ্যৎ লাত্থি-গুতার চেয়ে বড় কোনো ইন্সপায়ারেশন কোনোদিন ছিল না।
ক্লাস টু’তে পড়ার সময় একটি অতি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে আমার জীবনে – সেপ্টেম্বর মাসে। বলা নাই কওয়া নাই, কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া, আমি দায়িত্ববান “জননীর প্রতিনিধি অতি ছোটো দিদি” তে পরিণত হই। আমার মা’য়ের প্যারেন্টিংয়ের আরেকটি ভুল হলো, আমাকে কোনোভাবে না জানিয়েই তিনি দশ মাস পার করেন। আমিও বোকাসোকা হওয়ায় কিংবা মা একটু ভারি শরীরের কারণে কোনোকিছু চোখেও পড়েনি বা বুঝিনি। আসলে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন, কিন্তু আমার মা যে এক্সপেক্ট করছেন – এই নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। ২৫শে সেপ্টেম্বর সকালে মা’র শরীর খারাপ করে, আমরা স্কুলে যাই, দিদিমা আর আমার এক নার্স মামী তাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। ফিরে এসে মা-দিদিমাকে না দেখে একটু নার্ভাস লাগলেও বলা হলো – ব্যাপার না, চলে আসবে। রাত সাড়ে দশটার দিকে খবর এলো, ইট’স এ গার্ল।
প্রতিবেশী মেসো বললেন আমাকে, “এত লাফালাফি করার কী আছে? মেয়ে-ই তো আরেকটা”। সেই শুরু হলো এক পরত উপরের অপমানের ধারা। এক মেয়ের জন্য টিটকারির বদলে এখন দুইটাই মেয়ে। পরে শুনেছি মা’র কাছে, জ্ঞান ফেরার পর, নার্স মাসি (আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই এই প্রফেশনে) দিদিমা’কে আস্তে করে বলছিলেন, “ওকে এখনি বোলো না, আবার মেয়ে শুনলে কষ্ট পাবে।”
আমার মা’র কি ছেলেসন্তানের আকাঙ্ক্ষা ছিল? ছিল হয়তো, থাকাটা অস্বাভাবিক না। আমার মা’য়ের গায়ের রঙ ফরসা, দিদিমা তো অপূর্ব সুন্দরী। আমি, আমার বোন বড় হতে থাকি বাবা’র গায়ের রং নিয়ে, ‘ময়লা’ গায়ের রঙ, আদর করেও সুন্দরী বলে চালানো যায় না। তার উপরে “ভাই নাই!” ভাই যে নাই – এটা উঠতে বসতে শুনতে শুনতে মোটামুটি ভাই না থাকাটা যে আমারই কোনো একটা দোষের মতো, এটা আমি স্বীকার করে নেই। আমার কাকাতো বোন তার ছোটো ভাইয়ের জন্মের পর “মায়ের পুত্রসন্তান হয়েছে” – এই কথা ঘুরে ঘুরে বলতো। তিন বছরের বাচ্চা মায়ের মুখে পুত্রসন্তানের আকুতি শুনে শুনে নিজের মুখে বুলি তুলে নিয়েছিল। ওই দশা, ভাগ্যগুণেই, আমার হয়নি। কিন্তু আমার কাজিন এক ভাইকে হোস্টেলে পাঠানোর সময় বাবা বলেন, “আমার তো ছেলে নাই – কপাল! আপনার আছে, তাকে দূরে পাঠাবেন কেন?” এই কথা শুনে জানি যে ছেলে না থাকার হতাশা কত নির্মম।
আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে “ছেলে”র অনেক মূল্য। তারা জন্ম নিলেই হয়, সবাই ধন্য ধন্য করে – এর আরও এক ধাপ প্রমাণ পাই কিশোর বয়সে। ২০০০ সালের প্রথম দিকে, আমি নাইনে পড়ার সময়, আমরা সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গ যাই। আমার মায়ের বড় দুই বোন অনেক আগে থেকে ভারতে থাকেন। একজন ১৯৬৫ তে, আরেকজন ১৯৭১ থেকে। দিদিমা’র ভাইদের কাছে বড় হওয়া, সেখানে বিয়ে করে সেটেলড। একজন বেহালা আরেকজন ব্যারাকপুর। কোলকাতায় আর্ট মিউজিয়াম, সায়েন্স সিটি, রাস্তা, এগরোল, পুরাকীর্তি ইত্যাদি আমার ভালো লাগে। ব্যারাকপুরে সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম দিকের কিছু নিদর্শন আছে, তাও ভালো লাগে। যেটা ভালো লাগে না, তা হোলো, ঘুমের ঘোরে আবিষ্কার করা কেউ আমার বুকে চাপ দিচ্ছে পুরো হাতের তালু বসিয়ে। অনেকটা যেন মাপতে চাচ্ছে কিছু। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে তাকিয়ে দেখি কাজিন ভাই পাশে শোয়া, সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। এক রুমেই বাবাও আছে কাছে – এই ভরসা আসে না আমার মধ্যে। ছেলে’র প্রতি সবার আনত মনোভাব আমি জানি, জানি যে মা’র এই ছেলেদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। আমি প্রতিটাদিন কোনো দোষ না করে চোরের মত ঘুরি। নির্জীবের মত ভিক্ষা চাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু নিরাপত্তা। আমি জানি এই ছেলের নামে নালিশ করা বৃথা।
এরপর আরও দেখা হয় অনেক আত্মীয়দের সাথে। আত্মীয় যুবকদের বুলিয়িং এবং যৌনতামূলক ইংগিতে লুকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না আমার। দেশে আমাদের তেমন আত্মীয় নেই, আমি উঠতি বয়সী ছেলেদের নোংরা কৌতুকের সাথে আদৌ পরিচিতই না। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে দোষ না করেও অনেক দায় নিতে হবে। নালিশ করলে কেউ সাহায্য করতে আসবে না – এই সাধারণ সত্য বাংলাদেশের অন্য অনেক মেয়ের মত আমাকেও সাঁড়াশির মত আঁকড়ে ধরে। আমি আবারও ভবিষ্যতে যেন লাথিগুতা না খেয়ে থাকতে হয়, তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করি। করার চেষ্টা করি।
এর অনেক অনেক বছর পর – ফুল ফান্ডিংসহ আমেরিকায় আসছি, ২০১৩ সালে। আত্মীয়রা বললেন, “মেয়ে হইলেও ছেলের মতই বংশে বাতি দিচ্ছে” – ততদিনে আমার শরীরে ক্ষোভ, দুঃখ এইসব বোধ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। আমি জেনে গিয়েছি, এর সাথে লড়াইয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমার বোনও এখন ফুল ফান্ডিং নিয়ে ম্যারিল্যান্ডে পড়াশোনা করছে। এখন আমরা দুই বোন হলেও “ছেলে”র মতই যে বংশে বাতি দিচ্ছি, এইকথা বলেন অনেকেই।
তবুও মাঝে মাঝে ভাবি, বোনের বদলে ধরুন সেই রাতে যদি সত্যি সত্যি ভাই একটা জন্ম নিতো? জীবন যেটুকু সুযোগ দিয়েছে, তার কিছুই হয়তো দিতো না। মাছের মুড়োটা, বড় মাংসের টুকরোটা বাদ দিলাম, তেমন খাদক মানুষ আমি নই – কিন্তু এও হরহামেশাই দেখি ছেলেকে পড়াতে গিয়ে বাবা মা উজাড় করে দিচ্ছে। মেয়ের জন্য খরচ কেবল বিয়ের সানাই বাজাতে। ভাইদের লম্বা জীবন চেয়ে ভাইফোঁটার সন্ধ্যায় কান্নাকাটি করতে হতো। ঢাকায় বাবা মায়ের বাড়ি এতদিনে পরের বাড়ি হয়ে যেতো।
সে জন্মায়নি দেখে জীবন অনেক সুযোগ হাতে করে এনে দিয়েছে – তাকে কিছু কৃতজ্ঞতা জানানোই যায়!