November 21, 2024
সাহিত্যগল্প

অক্ষরের এপিটাফ

রাফসানা ইমাম পুষ্প ।। 

মায়ের মৃত্যুর দুপুরে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। খুব শুভ্র, সহজ, স্নিগ্ধ এবং সাধারণ একটা সিদ্ধান্ত। অথচ কবে বাস্তবায়িত করব সেটা এখনো ঠিক করিনি কিন্তু এই ঘটনা যে এই বিশাল মহাবিশ্ব ধ্বংসের আগে কোনো একদিন ঘটবে সেটা নিশ্চিত করে বলে ফেলতে পারছি।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কোনো এক ভর দুপুরবেলায় চলন্ত রিকশা থেকে ছুটে আসা কোন দ্রুতগামী ট্রাক বা বাসের সামনে লাফিয়ে পড়ব। তীব্র ধাক্কায় আমার মুখ এবং মাথা থেঁতলে যাবে। শক্ত করোটি ভেঙে মগজ তথা লাল-সাদা ঘিলু বের হয়ে পড়ে থাকবে থকথকে জেলির মতো, যে থকথকে জেলি পাউরুটিতে মাখিয়ে রোজ ভোরবেলা নাস্তা করে শহরের সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের বাসিন্দারা। সজোরে ধাক্কার আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটা হাত ও পায়ের উপর দিয়ে চলে যাবে আরেকটা দ্রুতগামী বাস, ফলাফলে হাড়ের মিহি গুড়ো মিশে কালো পিচকে পেছনে ফেলে বাসের চাকায় মিশে ছুটে যাবে আরও দূর থেকে দূরান্তে। আমার শরীর সমস্ত লাল রক্ত কালশিটে হয়ে যখন কালো পিচের সাথে মিশে যাবে তখন এই সমস্তকিছু নিশ্চয়ই দেখার মতো একটা দৃশ্য হবে! আফসোস হচ্ছে এই ভেবে যে সেই দেখার মতো দৃশ্যটা দেখার সৌভাগ্য আমার হবে না। এ কারণেই কি জীবনের এই মাঝপথে এসে আমার দুঃখ পাওয়া উচিত? বুঝতে পারছি না দুঃখ পাওয়া উচিত কি উচিত না। আমি আসলে দীর্ঘ বত্রিশ বছরের জীবনে বুঝে উঠতে পারিনি কোন সময়টাতে আমার দুঃখ পাওয়া উচিত আর কোন সময়টাতে আমার দুঃখ পাওয়া উচিত নয়। এই নিয়ে আমাকে বেশ কয়েকবার বিপাকে পড়তে হয়েছে। আমি মকর রাশির জাতক বৃষ। নাম শুনে সনাতন ধর্মালম্বী মনে হলেও আমি জন্মেছি আগাগোড়া এক কট্টর মুসলিম পরিবারে। শুনেছি আমার বাবা পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। আমার জন্মের খানিকক্ষণ আগে তার মাথার ভেতর বৃষ শব্দটা ঢুকে যাওয়ার ফলাফল স্বরূপ আমার নাম রাখা হয় বৃষ। রাড়িখালের আড়িয়াল বিলের ধার ঘেষা শান্ত স্নিগ্ধ আধপাকা ইটের বাড়ি ছেড়ে আমি যেদিন ঢাকায় পা রাখি সেদিন থেকে বুঝতে পারি আমি আসলে পা রেখেছি এক মস্ত বড় কালকেউটের জিহ্বার উপরে। আমি যতই একটু একটু করে ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করছি ততই ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি কালকেউটের জিহ্বা অতিক্রম কর তার মস্তবড় পেটের ভেতর। সেই মস্ত বড় পেটের ভেতরে এদিকে সেদিকে ছাপিয়ে জীবন পার করতে গিয়ে এক রাস্তায় আমার পরিচয় হয় পুষ্পের সাথে। একটা সাপের পেটের ভেতর বাস করতে থাকা আরেকটা সাপ। যাকে ভালোবাসবার পর আমি সমস্ত দ্বন্দ্ব কাটিয়ে হয়ে উঠছিলাম একজন পুরোদস্তুর কবি। শ্রমজীবী পাগলাটে বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাশ করে বের হয়ে কবি হতে চাওয়া ব্যর্থ যুবকের জীবনে নারী কিংবা নারীসঙ্গ যে সময়ে হুইস্কির সমান বিলাসিতা ঠিক সেই সময়ে আমি মুখোমুখি হই পুষ্প নামের মহাকালের সাথে। যে নারীটি আমাকে ধীরে ধীরে শেখায় কবিতা লিখতে। যেন নারীটির সাথে পরিচয়ের পূর্বে আমি ছিলাম এক শান্তশিষ্ট সুবোধ বালক! যেন নারীটির সাথে পরিচয়ের পূর্বে আমি কখনো জানতে পারিনি পুরোদস্তুর যৌনতা ও প্রেমের মধ্যেখানে বাস করে গোপন শিল্প, যে শিল্প ভিসুভিয়াসের লাভার মতো উত্তপ্ত হয়েও প্রচন্ড কোমলতা নিয়ে স্থির হয়ে ঝুলে থাকতে পারে দেয়ালের পেইন্টিংয়ে কিংবা সারি সারি অক্ষর হয়ে জেগে থাকতে পারে কবিতার বইয়ে! যেন নারীটির সাথে পরিচয়ের পূর্বে আমার মাথার ভেতর শব্দেরা খেলা করে যেত না!

পুষ্প, এই পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধস্বর আর কোমল নারীটি কেন যে গণিতের মতো একটা কাঠখোট্টা বিষয়কে নিজের জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিল সেই উত্তরে আমি একগাল হাসি ছাড়া কিছু পাই নি। পুষ্পের সাথে পরিচয়ের পর আমি পরিচিত হয়েছিলাম নতুন আরেকটি দুপুরের সঙ্গে। যে দুপুরে আমি জেনেছিলাম একটা পুরাতন শহরের ব্যস্ততম স্টেশনের সামনের রাস্তার কোন এক সুউচ্চ ভবনের পলেস্তারা খসে পড়া সবুজরঙা ঘরের দেয়াল ঘেঁষে পুষ্পের সাথে বসে থাকা প্রতিটি মুহুর্ত একেকটা মহাকালের সমান। পুষ্পের ত্বক, চুল, ওষ্ঠ, গ্রীবা, উরু সেই রংচটা দেয়ালের রুমে আমাকে ধীরে ধীরে শেখায় কেমন করে সুবোধ বালক থেকে কবি হয়ে উঠতে হয়। সেই সুউচ্চ ভবনের পলেস্তারা খসে পড়া সবুজরঙা দেয়ালের ঘর থেকে বের হবার পর সারাটা সন্ধ্যা ঘোরলাগা মানুষের চোখ নিয়ে আমি হেঁটে বেড়াই শহর জুড়ে। শহরে হেঁটে বেড়ানো জুতো পরিহিত একেকটা মানুষকে আমার কবিতা মনে হতে থাকে। আনমনে হাঁটতে যেয়ে ধাক্কা খাওয়া রিকশাকে আমার মনে হতে থাকে বোদলেয়ারের সেই আশ্চর্য মেঘদল! শহর থেকে দুরের ছয়তলার চিলেকোঠায় আমি সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠতে থাকি সিঁড়ি ভেঙে। প্রতিটা সিঁড়িকে আমার মনে হতে থাকে একেকটা আকাশ। যেন আমি আকাশের পর আকাশ ছাপিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছি। যেমন করে সারা দুপুর আমি পৃথিবীর আশ্চর্যতম সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে গিয়েছিলাম একের পর এক।

সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে আমার সেদিন হঠাৎ মনে পড়তে থাকে নীপার কথা। কলেজের সেই নীপা, যাকে না পাওয়ার দুঃখ নিয়ে আমি কবি হবো বলে ঢাকায় পা রেখেছিলাম। আমি জানতাম কবিদের কেউ পছন্দ করে না। আমি জানতাম কবিদের কেউ চায় না। যেমন করে চায়নি নীপা এবং অন্যান্যরা। যেমন করে নিজের ছেলে হিসেবে আমাকে আর চায়নি আমার শ্রমজীবী পাগলাটে বাবা। একেকটা সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে আমার আবার মনে পড়তে থাকে অন্তঃসত্তা মাকে, যাকে এক আশ্চর্য দুপুরে বিশাল এক পেট নিয়ে বাবার হাতে মার খেয়ে মরে যেতে দেখেছিলাম চোখের সামনে। আমি ঘোরলাগা মস্তিষ্ক নিয়ে ভাবতে থাকি মায়ের উঁচু পেটটাতে ঠিক কে ছিল! পুষ্পের মতোই একটা আশ্চর্য প্রজাপতি? যার জন্মের কতগুলো বছর পেরোনোর পর কোন এক যুবক হয়ত তার ভেতরে আশ্চর্যজনকভাবে খুঁজে পেতো নিজেকে? আমি জানি না, আমি কখনো জানতে চাই নি। আমি কখনো জানতে চাইনি কলেজে পড়বার সময় রাহাতের সাথে যাওয়া বেশ্যাপল্লীতে মোহনার মুখোমুখি হওয়ার পর কেন মোহনা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল! আমার সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে আবার মনে পড়ে স্কুল পড়ুয়া একটা স্বচ্ছ মুখ, যার মুখ ঠিক মোহনার মতোই! যার হাসি বেশ্যাপল্লীর নোংরা শাড়ি পেঁচিয়ে থাকা আর কড়া লিপস্টিক পরে থাক মোহনার মতোই! মোহনকে দেখে আমি কাঁপছিলাম কেন সেদিন? করুণায় নাকি ঘেন্নায়? নাকি প্রথম বেশ্যাবাড়ি যাওয়ার এক আশ্চর্য ভয়ে? আমি জানি না, সেসবের কিছুই আমি জানি না! কখনো জানতে চাই নি।

আমি পকেট হাতড়ে চাবি বের করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকি। ঘর ছাপিয়ে যেয়ে দাঁড়াই ঘরের পাশের এক টুকরো ছাদে। যে ছাদ থেকে সোজা সারি সারি দেখা যায় ময়লার স্তুপ। যে ছাদ থেকে দেখা যায় সামনের হাসপালের পেছনের দিককার ডাস্টবিন। যেখানে প্রতিদিন অ্যাবরশন করা অপরিপক্ক নবজাতকের শরীর চাপা পড়তে থাকে ময়লার স্তুপের আড়ালে, সকাল কিংবা সন্ধ্যেবেলা। আমার ইচ্ছে করে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে শূন্যে ভাসতে। পরমুহূর্তেই দেখতে থাকি অপরিপক্ক নবজাতকদের শরীরগুলো একেকটা কবিতা হয়ে যাচ্ছে, যাদের আমি মুঠো করে ধরতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। হাত গলে তারা বেরিয়ে পড়ছে এদিক সেদিক। আমি এক আশ্চর্য সুবোধ বালক, যে এই বত্রিশ বছরের জীবনে কতটুকু কবি হতে পেরেছে জানি না। ছয়টা কাব্যগ্রন্থ আর একাডেমি থেকে তিনটে শ্রেষ্ঠ কবির পুরষ্কার পেলে যদি এই শহরে কবি হওয়া যায় তবে সেদিনের সেই আশ্চর্য দুপুরের পর আমি কবি হিসেবে এই পৃথিবীতে নাম লিখিয়েছি। কবি জীবনের সফলতার ভিড়ে আমার ব্যক্তিজীবনের অজস্র ব্যর্থতা আমার স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য দায়ী করলে বোধহয় আমার ভুল হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি, এই পৃথিবীর কোন এক ঝাঁঝালো দুপুরে আমাকে চলন্ত রিকশা থেকে লাফিয়ে পড়তে হবে। সেই ঝাঁঝালো দুপুরের পর থেকে এই শহরে কবিতা পড়া মানুষেরা দ্বিধায় ভুগতে শুরু করবে। যেমন করে আমি চিরকাল দ্বিধায় ভুগেছি জীবনানন্দের মৃত্যু নিয়ে। যেমন করে রাতের পর রাত ধরে আমি ভেবে গিয়েছি জীবনানন্দ ট্রামের নিচে লাফিয়ে পড়েছিল নাকি আনমনে হাঁটতে গিয়ে ট্রাম তার সুতীক্ষ্ণ ধারালো পা দিয়ে মাড়িয়ে গিয়েছিল জীবনানন্দের শরীর! সেই ঝাঁঝালো দুপুরে আমাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে রিকশা থেকে যেই ঝাঁঝালো দুপুরে আমি এক অদ্ভুত অনুভুতি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম পুষ্পের মুখের দিকে আর তার হাতে থাকা একটা রিপোর্টের দিকে। যেই রিপোর্ট এই পৃথিবীতে একটা নতুন শিশুর আগমনের সংবাদ নিয়ে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছিলো পুষ্পের হাতে। একটা নতুন শিশু, যে শিশুটি আমার নয়! যে শিশুটি আমার বীর্য থেকে ফুটে ওঠেনি সূর্যমুখী হয়ে! যে শিশুটির ভেতর কখনো জেগে উঠবে না কবিতা লেখার আদিম বাসনা! যে শিশুটি রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কখনো আমার মতো কবিতাদের হেঁটে বেড়াতে দেখবে না!

আমি তাকিয়েছিলাম পুষ্পের দিকে কিন্তু আমার চোখ দেখছিল অন্যকিছু। আমি সেই দুপুরে চোখের সামনে সারিসারি সূর্যমুখী দেখতে পাচ্ছিলাম। ভ্যান গগের সেই গাঢ় হলুদ রঙের সূর্যমুখী। যে সূর্যমুখীর তীক্ষ্ণ হলুদ রঙ চোখের স্নায়ুকে ছিঁড়েফুঁড়ে ফেলে। পুষ্পের চোখের খানিকটা রাউন্ড শেইপের চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে মুক্তোর মত যে নক্ষত্রেরা ঝরে ঝরে পড়ছিল তাদের দেখে আমার ইচ্ছে করছিল মুঠোয় পুরে কবিতা বানিয়ে ফেলি। আমি ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম কেমন করে লেখা যেতে পারে আরেকটা মৃত্যুসম কবিতা। যে কবিতা লেখবার পর আমি এক আশ্চর্য সুখ পাই। যে সুখ আমি নিজের বীর্যস্থলনের পরও কখনো পাইনি! যে সুখ আমি সঙ্গমেও কখনো পাইনি! যে আশ্চর্য সুখ আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হবার পরও আমি কখনো পাই নি। সেই আশ্চর্য সুখ আমি শুধু পেয়েছিলাম কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঝাঁঝালো দুপুরে। যে সুখের মুখোমুখি আমি শীঘ্রই হবো, আরেকটা নতুন দুপুরে! সেই দুপুরের পর এই পুরোনো ব্যস্ত শহর থেকে দুরের শান্ত স্নিগ্ধ আড়িয়াল বিলের ধারঘেষা এক ছোট গ্রামের সিমেট্রিতে কফিনের মধ্যে পচে গলে যেতে থাকবে আমার শরীরের সমস্ত কোষ। পচে গলে যাওয়া কবরের সামনে বহু বৎসর পর এক দুপুরে রেড ওয়াইন রঙের শাড়ি পরিহিতা নারী ফিসফিস করে আওড়াবে ওজদেমির আসাফের কবিতা। বিষন্ন ভাঙা কণ্ঠে বিড়বিড় করে আওড়াবে –

I will hide you, believe me

In what I write, in what I draw

In what I sing, in what I say.

You will stay and no one will know

And no one will see you,

You will live in my eyes.

You will see, you will hear

The gleaming warmth of love,

You will sleep, you will wake up.

You will see that the days passing by

Are not like the ones you used to live,

You will lose yourself in thought.

Understanding a love

Is spending a life,

You will spend it.

I will live you, it can’t be told,

I will live in my eyes;

I will hide you in my eyes.

One day, you will just start to tell…

You will look,

I will close my eyes…

You will understand.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *