পৌনঃপুনিক [পর্ব – ০৮]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।।
আম্মার প্রবল ইচ্ছে ছিল তিন ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাবেন। ছোট দুই ভাই-বোন মনু আর রিমি পড়ালেখায় মেধাবী হলেও রুনু আপার পড়ালেখায় তেমন মনোযোগ ছিল না। একটু বড় হতেই রুনু আপার বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী খালা-ফুপু, মামী-চাচীরা এলেই মাকে বলতো, “এ মেয়েকে বেশিদিন ঘরে রাখতে পারবে না। ওর লেখাপড়া করে কী লাভ? অমন সুন্দর চেহারা-ছবি, দুধে-আলতা রঙ! বাপ তো হাঁড়ির পাছার মতো বউ এনেছিল! সেই মায়ের পেটে এমন পরীর মতো মেয়ে যে কিভাবে হলো! শোকর কর যে, রুনু তোমার রঙ পায়নি। বিপদ তোমার ছোট মেয়েকে নিয়ে। একেবারে মায়ের মতো সেই হাঁড়ির পাছা! মনু তো ব্যাটা ছেলে, ও হলো কালোমানিক আর বউ আনবে কাঁচাসোনা!”
ছোটবেলায় রিমির মনে হতো রুনু আপা বুঝি রূপকথার গল্পের ক্ষীরের পুতুল! নিজের রঙ নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না। সবাই যে তাকে আম্মার মতো দেখতে বলতো তাতে বরং মনে মনে সে খুশি হতো। কেবল আম্মাকে কেউ “হাঁড়ির পাছা” বললে তার খুব রাগ হতো। ছোটবেলা থেকে রিমি সবসময় আম্মার আঁচল ধরে ঘুরতো। আম্মার সাথে বাজার-সদাই, রান্নাঘরের কাজ, আম্মাকে জড়িয়ে ঘুমানো – আম্মার সঙ্গ পেলেই হলো। সবাই তাকে আম্মার পেটপোঁছা বাচ্চা বলে খ্যাপাতো। আর সবার কাছ থেকে “সুন্দরী” খেতাব পাওয়ায় রুনু আপা কেমন যেন উচাটন থাকতো। আম্মার ধারেকাছেও বেশি ঘেঁষতো না। তা সত্ত্বেও আম্মা তার ননীর পুতুল বড় মেয়েকে সবসময় চোখেচোখে রাখতো। রিমিরা সবাই যখন মাঠে খেলতে যেতো ততোদিনে রুনু আপা ক্লাস এইটের ছাত্রী, খেলার পাট চুকিয়ে সে ফ্রিল দেয়া ফ্রকের সাথে পায়জামা পরতো। অথচ আদরী’দি নাইনে উঠেও ঠিকই তাদের সাথে খেলতে আসতো! বরফ-পানি নাকি বুড়িচ্চি খেলা হবে তা নিয়ে নিত্য বিবাদ মীমাংসা করতো। আর চোখে কাজল এঁকে, কপালের এক পাশে চুল পাফ করে বেশ কায়দা করে চুল বাঁধতো রুনু’পা। হেঁটে গেলে পাড়ার সবাই চেয়ে থাকতো।
আম্মা একদিন বলা নেই কওয়া নেই লেনিন ভাইদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত। রিমিও সাথে ছিল। লেনিন ভাইয়ের মা প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন। সেসময় বাড়ি ছিলেন না। ওই সময় কেন লেনিন ভাইদের বাড়িতে যাচ্ছে তারা, রিমি কিছুই বুঝতে পারে না। তবে তার বেশ আনন্দ লাগে। লেনিন ভাই তাদের সবার চেয়ে বড়, ক্লাস টেনে পড়ে। লেনিন ভাই সবাইকে খেলায় খুব উৎসাহ দেয়। একই দলে খেলে ভাল কিছু করলে লেনিন ভাই বাহবা দিয়ে বলে ওঠে, “সাবাস! পার্টনার”। খেলার মাঠে সবাই তার প্রশংসা পেতে উদগ্রীব। খুকু একদিন কানে কানে বলেছিল, “একটা কথা কাউকে বলবি না তো? লেনিন ভাইয়ের হাসিটা কেমন যেন দুষ্টু-মিষ্টি নারে?” সেদিন খেলা শেষে লেনিন ভাই ডেকেছিল, “কী রে! পার্টনার! বাড়ি যাচ্ছিস? নে চকলেট খা। আর শোন, এটা তোর রুনু আপাকে দিবি, কেমন?”
রিমি চকলেটের সাথে ভাঁজ করা চিরকুটটা জামার পকেটে রেখে মাথা নাড়ে– “এবার বাড়ি যাই?”
বলেই দে ছুট! সে তো কয়েক দিন আগের কথা! আম্মার সাথে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে, এই রে! সে চকলেটও খাওয়া হয়নি, কাগজটাও রুনু আপাকে দেয়া হয়নি! বেমালুম ভুলে গেছে সে! আম্মা সেই জামা কেচে দিয়েছে নির্ঘাত! ভাবতে ভাবতে আম্মা লেনিন ভাইয়ে নাম ধরে ডাকে।” জি, চাচী আম্মা! স্লামালিকুম!” লেনিন ভাই স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসি নিয়ে দরজার কাছে আসে – “আম্মা তো স্কুলে, এসে পড়বে একটু পর। আপনি বসেন না!”
আম্মা কোনো ভূমিকা ছাড়াই কড়া গলায় প্রশ্ন করে, “তুমি রুনুকে চিঠি দিয়েছ?” লেনিন ভাই একবার রিমির দিকে চেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। অস্বস্তিতে রিমির মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
আম্মা এক নিশ্বাসে বলে, “এক চড়ে তোমার দাঁত ফেলে দেব, বেহায়া! অসভ্য ছেলে কোথাকার! লেখাপড়া নেই? খবরদার! আর কোনোদিন আমার মেয়েদের সাথে কথা বলার সাহস করবে না!” লেনিন ভাই আগের মতোই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল যেন মাটির সাথে মিশে যেতে পারলে ভাল হতো!
আম্মা রিমির হাত টেনে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসে। সারাটা পথ রিমি আম্মার সাথে কোনো কথা বলে না। বিকেলে খেলার মাঠে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল রিমির। কেউ নিষেধ করেনি, নিজে থেকেই রিমি আর যেতে পারে না। প্রবল ইচ্ছেটাও হার মানে সেদিনের লজ্জার কাছে। খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য আম্মার উপরে গোপন অভিমান তার আজো যায়নি। এখনো মনে হয়, সে যদি ঘুনাক্ষরেও জানতো কেন যাচ্ছে, আম্মার সাথে সেদিন অন্তত ওই বাড়িতে যেত না। আম্মা তো ভালোভাবেও বলতে পারতো কথাগুলো! এই প্রথম আম্মাকে খুব নিষ্ঠুর লেগেছিল রিমির। তার আগে মনে হতো আম্মা ফেরেশতার মতো, তার কোনো ভুল থাকতেই পারে না।
সেদিন মনে হয়েছিল, আসলে আম্মারা ফেরেশতা না, তারাও ভুল করে। নিজের সন্তানের ভাল করতে গিয়ে অন্যের সন্তানের মনে কষ্ট দেয়া তো ভুলই!
[চলবে]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।