মেয়েটির স্বপ্ন বনাম ‘খলনায়ক’ পরিবার
নাবিলা সোনার ।। একটা বাস্তব গল্প কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যদিয়ে শুরু করা যাক।
ধরা যাক এই গল্পের মেয়েটির নাম সারা। সারার পরিবার বেশ সচ্ছল, উৎসব আমেজে পরিপূর্ণ। বাবা-মা দুইজনেই নিজেদের কাজের জায়গা, সংসারের জায়গা ঠিকঠাক মতোই সামাল দিতে পারেন, সেই সাথে সারা এবং সারার ভাই-বোনদের যত আবদার সবই প্রায় পূরণ করা হয়। একটা ব্যাপারে একটু ঘাটতি আছে বলা যেতে পারে, কারণ সারা ছোট থেকে বলতে গেলে দেখেই নি যে তার পরিবারের সদস্যরা অন্য অনেক কাজ করলেও একসাথে দূরে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে বা তাকেও ঘুরতে যেতে উৎসাহ দিচ্ছে। উল্টোটা বরং হয়েছে যে, সারা কোনো কোনো সময় ভ্রমণের ইচ্ছে নিবেদন করলেও সেই পরামর্শ তৎক্ষণাত নাকচ করে দেওয়া হত অনেক অনেক অজুহাত দেখিয়ে। তার পরিবারের মতে, কোনো কারণ ছাড়া শুধু শুধু দূরপাল্লার ভ্রমণ পয়সা নষ্ট ছাড়া কিছুই না। তাছাড়া সেসব জায়গায় কতশত দুর্ঘটনাও তো ঘটার সম্ভাবনা থাকে। আমোদ যদি করার ইচ্ছে হয়, বাড়িতেই পোলাও রান্না করে, আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে, জম্পেশ একটা আড্ডা দেওয়াটাই বরং বুদ্ধিমানের কাজ। অগত্যা, সারা তার ভ্রমণের স্বপ্ন দেখাটা, ইচ্ছাটা চাপিয়ে রাখলো বছরের পর বছর। তার একটাই শুধু ইচ্ছা, কোনো একদিন সে যখন পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে, টাকার জন্য আর বাবা-মায়ের দিকে চেয়ে থাকতে হবে না, তখন সে পাখির মত উড়বে।
সেই সারা একসময় বড় হল, নিজের পায়ে দাঁড়ালো, বাড়ি থেকে বের হল, অর্থ উপার্জনও করতে লাগলো। কিন্তু সে তার নতুন জীবনে এমনভাবে ডুব দিল যে, এতদিনের লালিত স্বপ্ন, যার জন্য এত পরিশ্রম – সেই নোমাডের মত ঘুরে বেড়ানোটা আর হয়ে উঠছে না। প্রায়ই চিন্তা করে, না এখন কোথাও যাওয়ার একটা প্ল্যান করতেই হবে। কিন্তু নিজের অজান্তেই মাথায় চলে আসছে, আচ্ছা এখানে যাওয়াটা কি আসলেই জরুরী, কাজের চাপ আছে, শুধু শুধু পয়সা খরচ ছাড়া কোনো লাভ তো হচ্ছে না। সে সেইসব জিনিসগুলোই চিন্তা করছে, যা একসময় তার বাবা-মাকে চিন্তা করতে দেখেছে।
আমি একেবারেই জেনারেলাইজ না করে একটা ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। ছোট থেকে অনেক শুকনা-পাতলা গড়নের সাথে শ্যামলা গায়ের রঙের অধিকারী ছিলাম বলেই হয়ত অনেকের কাছে শুনতে হত, “তোমাকে তো বিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলে পাওয়া যাবে না। আর তোমার আব্বুও তো মনে হয় না কিছু রেখে যেতে পারবে তোমারদের জন্য। ভালো করে পড়াশোনা কর। নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া তো আর গতি নেই।”
একটা নয়-দশ বছরের মেয়েকে দেখে যৌবনে কোনো ছেলে তাকে পছন্দ করবে কিনা, এটা কিভাবে বলা যায়, আমি জানি না। কিন্তু না চাইতেও এটা প্রতিনিয়ত শুনতে হয়েছে। আজ পড়াশুনা, চাকরি-বাকরি তে কিছু গতি হলেও বিয়ে বা সংসার করার কথা মনে হয়না। বন্ধু-বান্ধবীদের বিয়ে ছবি দেখলে শুধু একটু মনে হয়, আচ্ছা আমার কি এখন এই নিয়ে একটু চিন্তা করা উচিত? ব্যাস, এই পর্যন্তই। এবং আমি ধরেই নেই, যদি কেউ আমাকে পছন্দ করে, সে আমার বাহ্যিক চেহারা না বরং ভেতরের মানুষটাকে দেখে হয়ত ভালো লেগেছে বলেই পছন্দ করেছে। দেখতে সুন্দর লাগছে বলে প্রশংসা শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে, “ব্যাটা চাপা মারছে”! এই অসচেতন চিন্তা হয়ত ছোটবেলার সেই মহান (!) বাণীগুলো থেকে আসতে পারে, সেটার একটা উপলব্ধি এখন আলবৎ হচ্ছে।
এরকম উদাহরণ দিতে থাকলে শতশত উদাহরণ তুলে আনা সম্ভব। কত শত অভ্যাস-বদভ্যাস, রুচি, আচরণ, আত্মমর্যাদা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোলাগা, খারাপলাগা নিজের অজান্তেই যে পরিবেশে, যে মানুষদের সাথে বড় হয়েছি, তাদের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি এবং এগুলো আমাদের বড়বেলার জীবন অনেক বেশি নিয়ন্ত্রন করছে। মাঝেই মাঝেই নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হতে হয়, আসলেই কি নিজের এই দিকটার কথা আমি জানতাম? আমি তো নিজেকে অন্যরকম ভেবেছিলাম। বা যেটা নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল সেটা কেন করে উঠতে পারছি না, বা কোনো নির্দিষ্ট টাইপেরই মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছি, যা কিছু জীবন থেকে ছুটে যাচ্ছে বলে ভাবছি, সেগুলো অর্জন করার জন্য যে কাঠামো দরকার সেভাবে কি আসলেও আমি গড়ে উঠেছি?
এইসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো বা পাওয়া যেতে পারে, সেই আমাদের ভিত তৈরি হওয়ার সময়টাতে একটু ঢুঁ মেরে। কী কী আমাকে সেই সময়টায় বলা হয়েছিল, কী কী দেখে বড় হয়েছি, কী কী অভ্যাস এতদিন ধরে পালন করে এসেছি, এইটুকু একটু সচেতনভাবে খেয়াল করতে পারলে হয়তো পরের কাজটা সহজ হয়ে যায়। যেমন এমন হতে পারে যে, যেগুলো মাথায় ঢুকানো হয়েছে তার মধ্যে কিছু জিনিস মাথা থেকে বের করে দিতে চাই। আবার একই সাথে কিছু অভ্যাস আমি আরো যত্ন নিয়ে আরো সজীব করে তুলতে চাই। বা যেগুলো মনে হচ্ছে আমার মধ্যে নেই, সেগুলো হয়তো নতুন করে শিখতে চাই। কিন্তু সবার আগে নিজেকে এবং নিজের পরিপার্শ্বকে জানা প্রয়োজন সময় ফুরোনোর আগেই, যাতে শেষ বয়সে যাতনার মধ্যে না পড়তে হয় যে – এই জীবন তো চাইনি।
শুরুর গল্পের মেয়ে সারা একসময় হয়ত উপলব্ধি করতে পারলো যে পরিবারই প্রধান খলনায়ক, তার ভ্রমণপিপাসু মনের উপযুক্ত পরিচর্যা না হওয়ার জন্য । এজন্য প্রচন্ড অভিমান হলেও তাকে যেমন দোষ দেয়া যায় না, তেমনি সে যদি এভাবেও দেখে, যে কোনো কারণেই হোক সে তার স্বপ্নপূরণের রসদগুলো নিয়ে আসতে পারেনি সত্যি, কিন্তু সে চাইলে সবাইকে এবং নিজেকে তার জন্য ক্ষমা করে দিয়ে নিজের মত করে রসদগুলো একটু একটু করে যোগার করে নিতে পারে, পাখির মত উড়ে বেড়াতে পারে, সে যেমন চেয়েছিল।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]