November 23, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

যে ছকে নারীকে আমরা দেখতে চাই

নাবিলা সোনার ।। আচ্ছা, এই নারীবাদ, নারী স্বাধীনতা নিয়ে যে এত আলাপ, আলোচনা, বিতর্ক হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে, ইরানে মেয়েরা রাস্তায় নেমে এল নিজেদের জীবন বাজি রেখে, বা আমি এবং আমার মত অনেকে সময়, শ্রম খরচ করে যে এই লেখাগুলো লিখছি কোনোরকম আর্থিক লাভ-লোকসান ছাড়া, সেগুলো কিসের জন্য? অন্তত আমার যে উপলব্ধি এই বিষয়টা নিয়ে, তা হল এই সমাজের অদৃশ্য অথচ বেশ শক্তিশালী যে ছকটা আছে সেটা কতখানি যুক্তিযুক্ত বা কার্যকর সেটাকে প্রশ্ন করা, এই ছকে থেকে সমাজের মানুষদের বিশেষ করে নারীদের যে ভোগান্তি সেটা চিহ্নিত করা এবং সেই ভোগান্তি থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায় তার একটা উপায় খোঁজা। সমাজকে এক ছক থেকে আরেক ছকে বদলি করার চেষ্টা কোনোভাবেই না। নারীবাদ নিয়ে আলোচনার এই সারমর্ম বোঝার সাধ্য যে এখনো মানুষের মধ্যে কম, তা নানাবিধ উপায়ে যেহেতু উন্মোচিত হচ্ছে, তাই মনে হল ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

এটা ঠিক যে, নারীমুক্তির কথা যখন বলা হচ্ছে, তখন নারীদের স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে বেশি। এটার কারণ ব্যাখ্যা কোনো জটিল হিসাব না। আমাদের সমাজে নারীদের ভোগান্তির পেছনে বেশ বড়সড় কারণ হচ্ছে কারো উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকাটা। একটা পরগাছাকে উপড়ায় ফেলা অনেক সহজ – সেটা আগে মানতে হবে। আমার সাথে যদি কোনো অপরাধ হয়, সেটা বলতে পারার জন্য পায়ের মাটি শক্ত থাকা দরকার। বিশ বছর আগে এবং পরে মেয়েদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় নিয়ে সরব হওয়ার একটা বড় পার্থক্য চোখে পড়ে এই জন্যে। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে, তাদের বাবা-মায়েরা অনেক সচেতন হচ্ছে। মেয়েরা কিন্তু শত বাধা পার করেও নিজেদের একটা ভিত তৈরি করে নিচ্ছে। তাদের চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের প্রতি হয়ে যাওয়া অন্যায় নিয়ে আলোচনার একটা জায়গা তৈরি করতে পারছে। এই পুরো সমীকরণটা না মানার কোনো কারণ নাই।

কিন্তু ঝামেলা বাধে তখনই, যখন এই স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

“অমুকে কত কিছু করে, তুমি ক্যান পারোনা, তুমি ক্যান তমুকের মতো না।” এই কথাগুলো খুব শোনা যাচ্ছে এখন। কারণ হয়ত হতে পারে যে, যখন মেয়েরা তাদের নিজস্ব সামর্থ অনুযায়ী নানান দিকে তাদের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে, তখন ছকে ফেলতে পটু এই সমাজের নারীদের নির্দিষ্ট একটা ছকে ফেলাতে তো সমস্যা হচ্ছে। এখন ব্যাপারটা এমন দিকে গড়াচ্ছে যে, মেয়েদের শুনতে হচ্ছে, “হয় যা করবে ঠিকঠাক মতো করবে, না হলে কিছুই করবেনা” টাইপ উপদেশ।

যে মেয়েটা ক্যারিয়ারের দিকে ঝুঁকছে, তাকে বলা হচ্ছে, বয়স থাকতে বিয়ে না করলে কোনোদিনই বিয়ের চিন্তা করোনা। বিয়ের জন্য প্রস্তুত না, কিন্তু প্রেম করছো মানে তোমার চরিত্র খারাপ। যে মেয়েটা সংসার করছে, বাচ্চাকে বেশি সময় আর শ্রম দিচ্ছে, তাকে হেয় করা হচ্ছে বুদ্ধিহীন, কর্মহীন, বসে বসে খাওয়া মেয়ে বলে। যে মেয়েটার জামাই হয়তো ভালো টাকা ইনকাম করে, সে যদি চাকরি করতে চায়, তাহলে তাকে চরিত্রহীন বলে দাগিয়ে দেওয়া যাচ্ছে।

“সংসার সামলেও চাকরি করা যায়, অমুককে দ্যাখ।”
“চাকরি করেও সংসার ভালোমত সামলানো যায়, তমুককে দ্যাখ।”

এত দেখাদেখি, বিচার-বিশ্লেষণের চোটে মেয়েদের জীবন দ্বিগুণ কঠিন করে দেওয়া হচ্ছে। এটা নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে এত আলোচনার প্রতিফলন না। এটা আমাদের সমাজের ভয়ংকর একটা বৈশিষ্ট্যের আরেক প্রতিফলন।

আচ্ছা এটা কিভাবে চিন্তা করা যায় যে, সব মেয়েদের একই ধরণের ক্ষমতা থাকবে? একটা মেয়ে একটা কিছু পারছে অনায়াসে বলেই আরেকটা মেয়েও সেই কাজটা অনায়াসে পারবে? আর জীবনটা কি কন্ট্রোল+সি, আর কন্ট্রোল+পি যে কারো কোন কিছু দেখবো, আর আমার জীবনে সেটা কাট-পেস্ট করে নেব? কারো জীবনযাপন দেখে বড়জোর একটা ধারণা নেওয়া যায় যে সেটা করা সম্ভব। এখন সেটা আমার জীবনেও সেটা খাটবে কি না এটা কি একটা গভীর বিশ্লেষণের বিষয় নয়? আমি আর আমার বোন পিঠাপিঠি জন্ম নিয়ে, একই রকম পরিবেশে থেকেও দুজনের কাজ করার ক্ষমতা, চিন্তা-ভাবনা, জীবন যাপনের ধরণ সব আলাদা, সেখানে আমরা একেবারে অন্য পরিস্থিতি, অন্য জীবনযাত্রা থেকে উঠে আসা ব্যাক্তির সাথে নিজেদের বা আরেকজনের তুলনা করতে পারি? আর কারো জীবনের শুধুমাত্র একটা ঝলক দেখেই কিভাবে তার জীবন, চরিত্র, বুদ্ধিবৃত্তি, ক্ষমতা নিয়ে একটা উপসংহারে পৌঁছে যাই? এটা নিয়ে কি একটু চিন্তা করা যায়? অনেক তো মানুষকে একটা নির্দিষ্ট খোপে ফেলে দেখতে চেষ্টা করলেন। এখন কি একটু অন্যভাবে এগুলো নিয়ে ভাবা যায়?

আমার চাওয়া, কারো কোনো ক্ষতি না করে আমি আমার মত হতে চাওয়ার রাস্তাটা মসৃণ চাই। এমন একটা পরিবেশ চাই যেখানে আমার হাসি-কান্না, শখ-আহ্লাদ, কিভাবে বাঁচবো, কী করে বাঁচবো, প্রেম করবো, সংসার করবো কি করবো না, আমার বুদ্ধিবৃত্তি কোন কাজে লাগাবো সেটার জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবেনা, আমার পছন্দের জীবনযাত্রার জন্য আমার সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায় আমি অকপটে বলতে পারবো এবং সারাক্ষন এই চিন্তায় থাকতে হবে না যে সমাজ যদি না মেনে নেয়। আর আমি যদি কারো জন্য কিছু করি, সেটা বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী, সন্তান যে কেউ হতে পারে তার জন্য প্রাপ্য সম্মান এবং স্বীকারোক্তি যেন পাই। আমার সময়, শ্রম বা কোনো কিছুই যেন কোনভাবে “Taken for granted” করে না নেওয়া হয়। যদিও জানি যে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো সহজে এই চাওয়াটা পূরণ করবে না। সে আমার বা আমাদের আবদার তার নিজের মত কায়দায় আমাদের গুলে খাওয়ানো চেষ্টা করবে, আর করছেও। তাই আমাদের লড়াইটাও থামবেনা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *