মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন, মিথিলা ও ইমেজের রাজনীতি
লিখন চন্দ্র দত্ত ।। ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ সিরিজটি আমি দেখিনি। তবে ওই সিরিজের আদিরসের ইঙ্গিতপূর্ণ একটা দৃশ্য দেখেছি ফেসবুকে। মিথিলা আর নাসির উদ্দিন খানের অন্তরঙ্গ দৃশ্য। ফেসবুকে আমার জানাশোনা সবাই এই সিরিজে যৌনতার ব্যবহার নিয়ে খোলামনে প্রশংসা করেছেন; খালি একটা জিনিস বাদে। অ্যামাজন প্রাইম আর নেটফ্লিক্সের যুগে অতটুকুতে কেউ সন্তুষ্ট হতে চায় না। দৃশ্যগুলো আরো অন্তরঙ্গ করা যেত কিনা প্রশ্ন তুলে দেখুন, দশজনের নয়জনেই হাত তুলবে – হ্যাঁ আলবাৎ করা যেত।
কিন্তু করা হয়নি। তাতে কোনো ক্ষতিও হয়নি। সিরিজটা চরকির একটা বড় সাফল্য। সিরিজের দর্শকের সবাই না হলেও বেশিরভাগই বিদেশি টিভি সিরিজে অভ্যস্ত বলেই আমার বিশ্বাস। বিলেতের বড় বড় স্ট্রিমিং কোম্পানিগুলোর বদৌলতে অডিওভিজুয়াল দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে, কিছু কিছু স্থানিক প্রাসঙ্গিকতা বাদ দিলে এমন কিছু বোধহয় নেই যা আপনি দেখাতে পারবেন না। স্ট্রিমিং জায়ান্টগুলো সিনেফিলদের জন্য অবতার হয়ে নামেনি, ব্যবসা করাই তাদের কাজ। যে জিনিস বাজারে বিকোবে বেশি তাতেই তারা আরো বেশি বেশি বিনিয়োগ করবে। আর যৌনতার চেয়ে বড় সার্বজনীন আগ্রহের বস্তু আর কী আছে! ফলে নিরীক্ষণ ও বিনিয়োগ দুটোই হয়েছে এই লাইনে বেশি। তো আমাদের দর্শক বা বাইরে থেকে যারা আমাদের বাজারের কাজ দেখেন, উভয়েই অ্যালেন স্বপনে এত মজেছেন কিসে? চটচটে সংলাপওয়ালা চটুল আদিরসাত্মক যৌনতার দৃশ্যই বা এত উত্তেজনার খোরাক যোগালো কিভাবে? উত্তরটা সহজ তবে খানিকটা বিস্ময় জাগানিয়া – ‘রাফিয়াত রশিদ মিথিলা’।
টিভি ফিল্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সামাজিক কদর অন্যান্য শিল্পীদের চেয়ে আলাদা। বিশেষত যাদের তারকাখ্যাতি আছে। তাদের কাজের প্রতি না যতটা, তার চেয়েও বেশি তাদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর ভক্তকুলের আগ্রহ; বিশেষত তারকা যদি একজন নারী হন। সোশাল মিডিয়া আসার পরে ব্যাপারটা ফুলে ফেঁপে স্থুল কদাকার একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ফলে তারকার কাজ, তার যাপিত জীবন, প্রেম-পিরীতি-পরকীয়া, অনলাইন তথা সোশাল মিডিয়ায় উপস্থিতি, তাঁকে ঘিরে সৃষ্ট মিথ-রহস্য জল্পনা-কল্পনা, পাপারাজ্জিদের ছবি অথবা চটুল পত্রিকার রসালো স্টোরি সবকিছুর জগাখিচুরি মিলিয়ে অনেকগুলো ইমেজ অনুসারি মন তৈরি করে নেয়।
বিনোদন জগতে যারা কাজ করেন তারা সবাই মানুষ, কিন্তু স্মার্টফোন বা টিভির পর্দায় আমরা যাদের দেখি সেগুলো সব দ্বিমাত্রিক ছবি, ইমেজ। মানুষকে পণ্য বানিয়ে বাজারে বিক্রি করা যায় না, ইমেজকে যায়। নায়ক নায়িকার শরীরও তাই পণ্য হয়ে যায়। মানে তাদের শরীর কিংবা মুখশ্রী নয়, মুখশ্রীর ইমেজটা হয়ে যায় পণ্য। তাই খবরের কাগজ বা টিভি মোবাইলের পর্দায় যে লাস্যময়ী বলিউড তারকাদের সচরাচর দেখি, ওগুলো আদতে সব ইমেজ। অনেকগুলো হাতের নিখুঁত কর্ম ও প্রয়াসে রচিত ঝাঁ চকচকে চোখ ধাঁধানো ইমেজ। কারণটাও সরল। পণ্য যত নজড়কাড়া হবে, তার চাহিদা বাড়বে তত, বিক্রিও হবে তত বেশি।
আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি দর্শকের মাথায় পর্দার নায়িকাদের ইমেজ যতবেশি ডায়নামিক, সে ততবেশি যৌন আবেদনময়ী হিসেবে গৃহিত হয় (বাস্তব জীবনেও ব্যাপারটা খাঁটে)। এই ডায়নামিকস তৈরি হয় অনেকদিন ধরে, ভক্ত-অনুসারিদের মনে অনেকগুলো ঘটনা স্মৃতি আকাঙ্খা হতাশার চাদর পরতের পর পরত জমতে জমতে। আমার একটা সাধারণ পর্যবেক্ষণ হলো যৌনতায় শারীরিক গড়নটা অনেকটা জুড়ে থাকে, কিন্তু সবটা নয়। মনন, অপরের একটা মানসিক ছবি অনেক বড় ফ্যাক্টর হতে পারে। যৌনতার মত জৈবিক ক্রিয়ায় মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলো সহজে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কল্পনা করি একজন পুরুষকে এমন একটা সুযোগ দেয়া হচ্ছে সে তার ইচ্ছেমত যেকোনো একজন নারীকে যৌন সম্ভোগের জন্য বেছে নিতে পারবে। তাহলে দেখবেন সে এমন নারীকেই বেছে নেবে যাকে পাবার একটা অবদমিত কামনা তার মধ্যে আছে, অর্থাৎ মিডিয়ার যেহেতু সামগ্রিক সমাজ মনের ওপর একটা প্রভাব আছে সেহেতু সে এতটা রঙ চড়িয়ে টানা হেঁচড়া করে পুরুষটির মধ্যে এই বোধটা তৈরি করে দিয়েছে যে অমুক এই নারী একটি চমৎকার ভোগ্যপণ্য এবং একে পাওয়া চাই এবং এরকম কাউকে ভোগ করতে পারা মানে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি ছিনিয়ে নেয়ার এক দুনির্বার আত্মতুষ্টি লাভ; অর্থাৎ সাধারণ বিবেচনায় পুরুষটি এমন এক নারীকেই চাইবে যে সামগ্রিক (ব্যক্তি নয়) অবচেতনে একটা বিরাট জায়গা দখল করে আছে। এখানে একবারও নারীটির ব্যক্তিসত্তা, স্বভাব চরিত্র চলাফেরা বা চেহারার স্কিন টোনের ব্যাপারটা আসছে না, আসছে ওই নারীর ইমেজ ও সেই ইমেজ প্রসূত কামনা। যৌনতার জন্য বিলিতি সুপারমডেলকে বেছে নেবার সুযোগ দিলেও বাঙালি পুরুষ পাড়ার সুডৌল ললনাটিকে বেছে নেবে ওই ইমেজের কারণেই। আগের উদাহরণের নারীর সাথে যৌনতা করা পুরুষটি একটি সামগ্রিক অবদমিত যৌনসমাজের চির আকাঙিক্ষত নিষিদ্ধ কল্পনার ফলটি আস্বাদনের তৃপ্তি লাভ করবে। এই পরিতৃপ্তি পুরোটাই শারীরিক যৌন সংবেদন বিবর্জিত এবং এর ফলে তার সম্ভোগকে আর নিছক জৈবিক ক্রিয়ায় ফেলে রাখা যায় না।
আমাদের উদাহরণটা নিছকই কল্পনা। বাস্তবে কখনো সামগ্রিক পুরুষের পছন্দসই নারীদের ভোগ্যপণ্য বানিয়ে পসরা সাজিয়ে কারো চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু ইমেজকে যায়। এবং সেটা বিক্রিও হয় ভালোই। অ্যালেন স্বপনের সাফল্যের অন্যতম কারণ সামগ্রিক দর্শকমনে জুড়ে থাকা অভিনেত্রী মিথিলার ইমেজ ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণে একপ্রকার যৌনবস্তু হিসেবে তার উপস্থাপন। তার প্রেম, পরিচয়, দাম্পত্য জীবনের ওঠাপড়া, পুরনো সম্পর্ক বিচ্ছেদ, নতুন সংসার, দুই বাংলার পত্রপত্রিকায় ছবি সাক্ষাৎকার অনলাইন উপস্থিতি হেডলাইন আলোড়ন এই সবটার সামগ্রিক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবে মিথিলার ইমেজের সৃষ্টি। সাথে পরের বউকে (শাড়িপড়া বাঙালি বউ টাইপ) ভোগ করার আদিম আকর্ষণ। মিথিলাকে যদি ওই পোশাকের বদলে পাশ্চাত্যধর্মী পোশাক ও চরিত্রে উপস্থাপন করা হতো তাহলে দৃশ্যটা অতো জনপ্রিয় হতো কি? পাঠক কল্পনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমাদের আলোচনায় অভিনেত্রী মিথিলা কেবল উদাহরণমাত্র। এই প্রক্রিয়া স্থান কাল নির্বিশেষে তারকাখ্যাতি পাওয়া পৃথিবীর সকল নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে সত্য, তার জন্য কাউকে আলাদা করে মেরিলিন মনরো হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
সিরিজের ভাইরাল ওই দৃশ্যের আরেকটা জিনিস আলোচনা করে লেখাটা শেষ করছি। নাসির উদ্দিন খান ওরফে অ্যালেন স্বপনের সংলাপ। ‘তৈ তৈ তৈ আমার বৈয়াম পাখি কই’ এর মত ইরোটিক ডায়লগ মানুষের মুখে মুখে ভেসে বেড়িয়েছে এ কয়দিন। ভেবে দেখলাম এটা ওই আদিরস ভোগের আরেকটা রসালো উপায়। দৃশ্যে নাসির উদ্দিন খানের কামুক চাহনি ও সংলাপ দর্শকের বিনোদন যেন আরো দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বেশিরভাগ পর্নোগ্রাফিতে দেখা মেলে একজন অ্যাকটিভ পার্ট নিচ্ছেন, আরেকজন প্যাসিভ। পুরুষ দর্শকের জন্য সাধারণত প্যাসিভ পার্টটা হয়ে থাকে একজন নারীর। তবে ক্যামেরার ফোকাস পুরোটা থাকে নারীর ওপর। তিনিই নানারকম অভিনয় করে যৌন উত্তেজনা ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করেন। সঙ্গি পুরুষটি সেখানে থেকেও নেই; কারণ তিনি পুরুষ দর্শকের কাছে অনাকর্ষণীয়, তবে অপ্রয়োজনীয় নন। তার ভূমিকা সেখানে অনেকটা দূরের দর্শকটির মাধ্যম হিসেবে। পর্নোগ্রাফি দেখার সময় দর্শক ওই অভিনেতাটির ইমেজের স্থলে নিজেকে কল্পনা করে নেন। পুরো ব্যাপারটা বেশ স্বাভাবিক এবং যারা দেখেন তারা কখনো এই নিয়ে মাথা ঘামান বলেও মনে হয়না।
নাসির উদ্দিন খানের চেয়েও তার উচ্চারিত ডায়লগগুলো এই ভূমিকা নিয়েছে বলে আমি মনে করি। এই রসালো সংলাপে দর্শক যেন অভিনেত্রীর ইমেজটিকে আরো ভালোভাবে স্পর্শ করেন, জড়িয়ে ধরেন, কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে উড়ে চলে তাদের নিষিদ্ধ ফল আস্বাদনের অবচেতন সুখানুভূতি।
পুনশ্চ: এই লেখাটা অ্যালেন স্বপন সিরিজের কোনো ক্রিটিক নয়। সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল কয়েকটা দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই তো আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছি না। এই লেখাটা শুধু ওই দৃশ্যগুলোর উছিলায় সামগ্রিক সমাজদৃষ্টি বোঝার একটা চেষ্টা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]