November 21, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনা

সমাজ, রাজনীতি ও সময়ের গল্প খুফিয়া

ফাহাদ বিন সাঈদ হৃদয় ।। কিছুদিন আগেই বলিউডের সিনেমা খুফিয়া মুক্তি পেয়েছে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে। বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী টাবু, অভিনেতা আশীষ বিদ্যার্থী ও আলী ফজলের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে আজমেরী হক বাঁধন অভিনয় করেছেন সিনেমাটিতে। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন পাঞ্জাবি অভিনেত্রী ওয়ামিকা গ্যাবি। মুক্তির পরেই সিনেমাটি জন্ম দিয়েছে অসংখ্য আলোচনা সমালোচনা, বিশেষ করে বাঁধন ও টাবুর মাঝে দেখানো হয়েছে প্রচলিত সমাজবিরোধী সমকামি সম্পর্ক – যা আরো বেশি বিতর্ক উস্কে দিয়েছে।

সিনেমা ভালো নাকি খারাপ হয়েছে তা নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু এই লেখায় একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে খুফিয়াকে দেখার চেষ্টা করেছি।

পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ আর স্ক্রিপ্ট লেখক রোহান নারুলা সিনেমাটি তৈরি করেছেন অমর ভূষণের উপন্যাস Escape to Nowhere অবলম্বনে। এটি মূলত একটি স্পাই থ্রিলার, যেখানে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে শংকিত হয়ে নিজেদের স্বার্থে কিছু অপারেশন চালায়। এরকমই কোনো এক অপারেশনে পরিচয় হয় গল্পের মূল চরিত্র RAW এজেন্ট KM বা কৃষ্ণা মেহরা (টাবু) এর সাথে বাংলাদেশের লোকাল ইনফরমার হিনা’র (বাঁধন)।

গল্পটায় অনেক দুর্বল দিক আছে। বাঁধন স্বেচ্ছায় গিয়ে যেসব সহজ হাস্যকর তথ্য দিয়ে RAW এর ইনফর্মার হওয়ার চেষ্টা করেছে তা অনেক বড় অসঙ্গতি মনে হওয়ার কথা। এতটা কাঁচা কাজ করে লোকাল গ্যাংয়ের ইনফর্মার হওয়া গেলেও বিশ্বের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার কোনো একটিতে রিক্রুট হওয়া কিছুটা অতিরঞ্জিত। এছাড়া বাংলাদেশের প্রভাবশালী নেতাদের ব্যাপারে সহজে অনেক কিছু কীভাবে জানলো একজন লোকাল মেয়ে এই ব্যাপারটার কোনো ব্যাখ্যা না রাখা, স্পাইগিরি করতে গিয়ে প্রধান চরিত্রের ব্যক্তিগত জীবনের বারোটা বাজানো অর্থাৎ কর্মজীবী নারী মানেই সংসারে ক্যাচাল, ঘরে থাকা হাউজওয়াইফ নারীর স্বামীর কুকর্ম ও দেশবিরোধী কাজ নিয়ে বিন্দুমাত্র আইডিয়া না থাকা, নেটফ্লিক্সের গল্প মানেই হোমোসেক্সুয়াল সাবপ্লট ব্যবহার করা, উগ্র টেররিস্ট মানেই টুপি পাঞ্জাবি পরে সারাক্ষণ রাইফেল হাতে রাখা, অযথা কোনো একজন নারী চরিত্রের যৌন উদ্দীপক দৃশ্য রাখা এসব অনেকটা বারবার ব্যবহার করা দুর্বল স্ক্রিপ্টের মতো লেগেছে।

তাহলে গল্পের আলাদা ব্যাপার ঠিক কী হতে পারে?

আমি বলবো সময়। গল্পে যে সময়টা দেখানো হয়েছে, ২০২৩ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই সময়ের গল্প বলাটা পরিচালকের বা সিনেমার প্রডিউসারের না বুঝে নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয় মোটেও। গল্পটার ফ্ল্যাশব্যাক ২০০১ এর আগের সময় থেকে শুরু হয়েছে আর গল্পের বর্তমান সময় ছিল ২০০৪ সাল। বাংলাদেশে তখন একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী যথেষ্ট শক্তিশালী, ক্ষমতায় আসার জন্য তৈরি হচ্ছে তারা আমেরিকায় নিজেদের বন্ধুদের সহযোগিতায়। তাদের পরোক্ষ মদদে তখন অ্যাক্টিভ হয়েছিল বাংলাদেশে বহু জঙ্গি সংগঠন, যারা কিনা পরবর্তীতে চালিয়েছে দেশব্যাপী বোমা হামলা। এমন পরিস্থিতি পাশের দেশে চলমান থাকলে যে কোন দেশেরই নিজের স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। ঠিক সেই সময়টায় RAW এর এজেন্টরা যখন পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের রাজনীতির প্রভাব মোকাবেলায় তৈরি হচ্ছে, তখন ঘটনাক্রমে একজন লোকাল ইনফরমারের পরিচয় প্রকাশ পেয়ে গেলে উদ্ভব হয় জটিলতার। দায়িত্ব তখন পরিণত হয় ব্যক্তিগত প্রতিশোধের লক্ষ্যে। তবে ইনফরমারের পরিচয় প্রকাশ কীভাবে পেয়েছে তা দেখানোর সময় পরিচালক কিন্তু বাংলাদেশি কাউকে ব্যবহার করেননি। স্বয়ং ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের গুপ্তচরের পরিচয় আমেরিকার কাছে প্রকাশ করে দিচ্ছেন এই দৃশ্য নিঃসন্দেহে শক্তিশালী রাজনৈতিক মেসেজ দেয়। ভূ-রাজনৈতিক ব্যাপারে আসলে কেউই যে ধোয়া তুলসীপাতা হয় না, সবার কাছে আপন স্বার্থই প্রধান – তা তো চিরন্তন সত্য।

গল্পে উল্লিখিত পরিবেশ দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশে তখন সরকার গঠন করা জোটের মাঝে যেই স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী ছিল, তাদের নাম সরাসরি উল্লেখ করার পাশাপাশি তৎকালীন বাংলাদেশি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে মূল খলনায়ক বানিয়ে পুরো গল্প অগ্রসর হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল দর্শকেরা স্টেরিওটাইপ ভেঙে দুজন নারীর মাঝে দেখানো সম্পর্ক আর বাংলাদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে ভিলেন দেখানোর ব্যাপারে এতটাই রিঅ্যাক্ট করেছেন অনলাইন বাবলে যে কার গল্প আসলে বলা হচ্ছে আর কোন সময়ে বলা হচ্ছে তা হয়তো অনেকেরই চোখে পড়েনি। আর এই প্রতিশোধের গল্পটুকু কিংবা অভাবী একজন মেয়ে কীভাবে নিজের অসুস্থ বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার জন্য তথ্য বিক্রি করতে গিয়ে বিভিন্ন রূপে অভিনয় করছে সেই অংশটুকু অথবা সেই একই ইনফর্মারের পরবর্তীতে ভালোবাসা প্রমাণের জন্য ডেস্পারেট হওয়ার ব্যাপারগুলো ওই সময়ের গল্প বলার পাশাপাশি বাঁধন আর টাবু ফুটিয়ে তুলেছেন নিজেদের অভিনয় দক্ষতায়।

গল্পের আরো একখানা মেজর সাবপ্লট আছে যেখানে চারু চরিত্রে আছেন ওয়ামিকা গ্যাবি। মূলত যে গুপ্তচরের বদৌলতে RAW-এর গোপন তথ্য ISI ও আমেরিকার কাছে ফাঁস হচ্ছিল সেই গুপ্তচরের স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। গল্পের এই অংশে যে ব্যাপারটা কিছুটা গতানুগতিকের বাইরে দেখানো হয়েছে তা ছিল গুপ্তচর আলি ফজলের দেশদ্রোহী হওয়ার উৎসাহটুকু। দর্শকদের মতো RAW এজেন্টরাও এমন পরিস্থিতিতে পুরুষের খারাপ পথে যাওয়ার পিছনে প্রেমিকা বা বউয়ের ভূমিকা আছে ধরে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করলেও পরবর্তীতে বের হয়ে আসে ভিন্ন কিছু। শুধু অভিনয়ের ব্যাপারে যদি আলাপ করি তবে সিনেমার অন্যতম সেরা অংশই ছিল তিনটি প্রধান নারী চরিত্রের অভিনয়, যদিও বাঁধনের চরিত্রটি সম্ভবত আরেকটু প্রপার ব্যাকস্টোরি ডিজার্ভ করে।

বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই গল্প বলে আসলে পরিচালক – প্রযোজক শুধুই কি ব্যবসা করতে চেয়েছেন নাকি ভিন্ন কোনো মেসেজ দেয়ারও ইচ্ছা ছিল তাদের? আমরা তা নিশ্চিত হতে পারছি না তবে দুই ঘন্টা মোটামুটি চুপচাপ বসে কফি খেতে খেতে সিনেমা দেখতে চাইলে খুফিয়া খুব একটা মন্দ নয়, তা বলা যেতেই পারে।

One thought on “সমাজ, রাজনীতি ও সময়ের গল্প খুফিয়া

  • সুচরিত বড়ুয়া

    লেখাটা পড়লাম.
    লেখকের বেশ কিছু জায়গায় বোঝার ঘাটতি আছে আর গতানুগতিক চিন্তা থেকে বের হতে পারেন নি.
    আমি গল্পের বিষয় আর চরিত্রের উপস্থাপনা নিয়ে বলছিলাম.
    আমার মনে হয় সিনেমা টি গল্প making বেশ ভালো ছিল, সব কিছু বলে দেয়া থাকে না কিছু জিনিস পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা আর মনস্ত্বত দিয়ে বুঝে নিতে হয়. প্রতিটা চরিত্রে র রূপায়ণে কিছু ব্যাখ্যা ছবিতে আছে, একটা সিন ও বাড়তি নয়, যেমন চারু র নাচ. আবার চারু র husband তার দিক থেকে সে ঠিক. তার কাছে ইন্ডিয়ার জন্য তালেবান সমস্যা বড়, সেদিক দিয়ে সে দেশ প্রেমিক,CIA কে হেল্প করছে, তাদের ট্রাস্ট এর জন্য সে তথ্য দিচ্ছে গিফট নিচ্ছে. এই রকম সব কিছুর ব্যাখ্যা আছে.
    লেখা বড় হয়ে যাবে বলে details বললাম না,বিশেষ করে আমাদের দেশে কাজ করা বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাজ যেখানে তাদের উন্মোচন করা হয়েছে.
    অভিনয় সবারই সুন্দর, বিশেষ করে বাঁধন.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *