পরকীয়া, পরকীয় নয়
মেহেদী হাসান ।। বহুকাল আগে কবি শামসুর রাহমান ‘পরকীয়া প্রেমে পাপ নেই’ – বলে ভীষণভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের সমাজের একটা অংশের কাছে। কাছাকাছি সময়ে আমাদের সেকালের মশহুর নজরুলগীতি শিল্পী শবনম মুশতারী আনন্দ বিচিত্রার ‘একান্ত সান্নিধ্যে’ শিরোনামের এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পুরুষ যদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নেয়, স্ত্রীরও অধিকার থাকা উচিৎ একই রকম স্বাধীনতার। আমার ছাত্রকালে সে কথার অর্থ যদি বুঝে থাকি তাহলে বলতে হয় তিনি বলতে চেয়েছিলেন, যৌন-স্বাধীনতার অধিকার দুজনের সমান থাকা উচিৎ। অর্থাৎ স্বামী অবিশ্বস্ত হলে, স্ত্রীকেও সে অধিকার দেওয়া উচিত। বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক হতে থাকে। যতদূর মনে পড়ে, শবনম মুশতারী তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন এবং বলতে চান যে সাক্ষাৎকার গ্রহীতা তাঁর বক্তব্য যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে পারেন নি। এর কাছাকাছি সময়ে ভারতের অপর্ণা সেনের একটি বাংলা ছবি মুক্তি পায়। সেখানে দেখা যায়, রাখির স্বামী তার নারী পিএসকে নিয়ে অফিসের কাজে ভ্রমণে যায় এবং পিএস-এর প্রতি শারীরিক সম্পর্কের আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু ঘরে তার দুই যুগের সতী-সাধ্বী স্ত্রী তিন সন্তানের মাকে অন্য পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের অপরাধে বের করে দেওয়া হয়। সে ছবির একটা সংলাপ আমার মনে এখনও গেঁথে আছে। স্বামী দীপঙ্কর স্ত্রী রাখিকে বলে: “I don’t like my children would be brought up by a whore.” এ উক্তিটা পুরো ছবিতে দীর্ঘকাল সংসার করা পতিব্রতা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর নিষ্ঠুর উক্তির স্মারক হয়ে আছে।
পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর জন্ম ১৯২৮ সালে। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় ১৯৪৩ সালে। স্ত্রী শিরিন আমির বেগম তাঁর কাজিন। এ বিয়ে বেশিদিন টেকে নি। ১৯৫১ সালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন ইরানি মেয়ে নুসরাত ইস্পাহানিকে। যিনি নুসরাত ভুট্টো নামে মশহুর। এ বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় তিনি সম্পর্ক গড়ে তোলেন হুসনা নামের বাঙালি-পাঠান দম্পতির ঔরশজাত এক নারীর সঙ্গে। জুলফিকারের সৌভাগ্য এই যে, হুসনা তালাকপ্রাপ্তা ছিলেন। তাই তাঁর স্বামীর তরফ থেকে এ সম্পর্কে আপত্তি আসে নি। বরং হুসনা এক পর্যায়ে তাঁকে বিয়ে করার দাবি তোলেন নতুবা সব ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন। ‘কাতর ভুট্টো’ হুসনার হুমকি থেকে বাঁচতে কোরআন শরীফের পাতায় লিখে দেন, তিনি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে হুসনাকে বিয়ে করলেন। ভুট্টো অতিশয় চতুর প্রেমিক ছিলেন। পরে লোক লাগিয়ে সে কোরআন শরীফটি চুরি করিয়ে নিয়ে আসেন। ভুট্টোর জীবনের এ ঘটনা সামনে আসে না। কারণ হুসনা- ভুট্টো উপকাহিনীতে স্বামী নামক কোনো তৃতীয় ভিলেনের আবির্ভাব ঘটেনি। এ থেকে বোঝা যায়, পরকীয়া সম্পর্কে নারী একটা চরিত্র মাত্র; এর উপস্থাপন, নিয়ন্ত্রণ, মাত্রানির্ধারণ পুরুষের হাতে।
ইউরোপীয় সাহিত্য বিবাহিত নারীর পরপুরুষের সাথে সম্পর্ক নিয়ে অনেককাল ধরে কথাবার্তা বলে আসছে। ‘মাদাম বোভারি’ (১৮৫৬) বা ‘আনা কারেনিনা’র (১৮৭৮) পর বাংলা ভাষায়ও অনেকে লিখেছেন। ইউরোপের দুটো উপন্যাসেই যথাক্রমে এমা ও আনার আত্মঘাতি হওয়ার মধ্যদিয়ে সমাধান মিলেছে। এক্ষেত্রে পুরুষ চরিত্রগুলো বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে ছিল। যদিও পরকীয়া একপাক্ষিক বিষয় নয়, কিন্তু এর দায় কমবেশি নারীকে বহন করতে হয়।
রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরেবাইরে’ (১৯১৬) আর শরৎচন্দ্র ‘গৃহদাহ’ (১৯২০) লেখার পর বুদ্ধদেব বসু ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ (১৯৬৭) শুরুই করছেন নারীর জবানিতে স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কজাত অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে। বুদ্ধদেব বসু অবশ্য মামলাও খেয়েছিলেন অশ্লীলতার অভিযোগে। কিন্তু এ জাতীয় বিষয় নিয়ে লেখা তাতে থামেনি। কারণ সমাজে অস্তিত্ব আছে, এমন বিষয় সাহিত্য কোনো না কোনো উপায়ে বলে যায়। এটা আটকানো যায় না। যেসব উদাহরণ আমরা দিলাম, সেগুলো পরকীয়ার উদাহরণ। পরকীয়া একটি লিঙ্গান্তরিত শব্দ। নরনারীর বিবাহিত জীবনে নারী যদি স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িত হয় তখন তাকে পরকীয়া বলে।
সিমন দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গে বলছেন, ‘পুরুষ, দূরদর্শিতাবশত, তার স্ত্রীকে দীক্ষিত করে সতীব্রতে, কিন্তু সে নিজে সন্তুষ্ট নয় স্ত্রীর ওপর আরোপ করা ব্যবস্থায়।’ এর অর্থ পরিষ্কার। পুরুষ নিজে বহুগামী হতে পারে, কিন্তু নারী কেবল বিশ্বস্ত হবে স্বামীর প্রতি। পরকীয়া শব্দটির অর্থ দেখতে নেটামলের অভিধান খুঁজলাম। ‘পরকীয়া স্ত্রীলিঙ্গ, পরকীয়’র স্ত্রীরূপ। নায়িকা বিশেষ। প্রণয়াসক্ত স্ত্রী।’ ডিকশনারিও নারীর প্রতি ইঙ্গিত করছে। শব্দটির অপরায়ণ হয়ে গেছে। অভিধানে বলছে, এটা স্ত্রীবাচক চরিত্র লাভ করেছে। এ শব্দের মধ্যদিয়ে নারীর কলঙ্ক প্রকাশ পায়।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের তিনজন ক্ষমতাবান চাকরিজীবীর কাজকারবার দেখে পরকীয়া বিষয়ক প্রসঙ্গ সামনে চলে এসেছে। প্রথমেই একটা ডিসক্লেইমার দিয়ে নেই। ‘মিসিং’ ছবির পরিচালক কস্তা গাভরাস ছবির শুরুতেই বলে দেন, যদিও এ ছবির প্রতিটা ঘটনা ডকুমেন্টেড তবুও ছবিটা এবং এর কর্মীদের বাঁচাতে আমরা ব্যক্তিনাম ও দেশটা উহ্য রাখলাম। আমাদেরও এ লেখায় ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ও ইত্যকার মিথষ্ক্রিয়া বর্তমান আলোচনায় উহ্য থাকবে। যদিও বিষয়টি বর্তমান আলোচনায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জরুরি ছিল।
যে তিনজন ক্ষমতাবানের কথা বললাম তাদের দুজন পুরুষ এবং একজন নারী। এখানে আদৌ পরকীয়া আছে কি না আমরা এখনো জানি না। অন্তত নারীটির ভাষ্য থেকে তেমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় নি। তবে মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করে ছেড়েছে নারীটির চরিত্রকে। হাসপাতালে তার ওপর হামলা হয়েছে এটা কোনো বিষয় নয়। সে স্বামীকে ফেলে বসের সাথে চিকিৎসা নিতে গেছে এটাই বিষয়। আমরা বাইনারি করে বিষয়টা ভাবতে পারি। স্বামী যদি হার্টের চিকিৎসা নিতে তার কোনো নারী সহকর্মীর সহযোগিতা নিত, সেক্ষেত্রে স্ত্রী কতটা প্রতিরোধ করতে পারতো? সে কি তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতা নিয়ে স্বামীকে শাস্তি দিতে পারতো? আর মিডিয়াই বা বিষয়টাকে কতটা দোষের বিষয় হিসেবে দেখত? নারীটি কেন স্বামীর সহযোগিতা না নিয়ে স্যারের সহযোগিতা নিলেন, তার জবাব নারীটির কাছ থেকে এসেছে। সেটা মিডিয়া বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় নি। কিন্তু স্বামীপ্রবরটিরও বক্তব্য আছে নিশ্চয়ই। সেটা আমরা জানি না। এ ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, বিবাহিতা নারীর স্বামীর বাইরে কোনো সম্পর্ক সমাজ সমর্থন করে না। কিন্তু এটা নিশ্চয়তা দেয় না যে, স্ত্রীর বাইরে স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারবেন না।
একজন নারীর ওপর একজন পুরুষের অধিকার নিয়ে গ্রীক যুগে প্রচুর সাহিত্য হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যে বছর জন্ম সে বছর বাখোফেনের ‘মাতৃ-অধিকার’ বইটা প্রকাশিত হয়। সে বইতে বলা হয়েছে, আমাদের কালের মতো বিয়ের বিষয়টা ছিলে না বলে পিতৃত্বের পরিচয়ের নিশ্চয়তা ছিল না। এর ফলে বংশধারার পরিচয় রক্ষায় মায়ের দিকটা বিবেচিত হতো। সে কারণে সমাজে জন্মদাত্রী হিসেবে নারী উচ্চমূল্য ও উচ্চমাত্রার শ্রদ্ধা পেতেন। বাখোফেন একবিবাহ প্রথায় উত্তরণকে দেখিয়েছেন, ‘আদিম ধর্মীয় নির্দেশ লঙ্ঘন করা’ হিসেবে। এটা ছিল একই নারীর ওপর ‘অন্যান্য পুরুষের চিরায়ত প্রাচীন অধিকার লঙ্ঘন’। বাখোফেনের এ ব্যাখ্যা একান্তই ইউরো-সেন্ট্রিক। বাখোফেন গ্রীক সাহিত্য থেকে উদাহরণ টেনে দেখাচ্ছেন, বীর যুগে ক্ষয়িষ্ণু মাতৃঅধিকারের সময় ইউরিপিডিস ‘অরেস্টেইয়া’ নামে একটা নাটক লেখেন। সে নাটকে ক্লাইটেমেনেস্ট্রা তার স্বামী আগামেমননকে হত্যা করে প্রেমিকের সহায়তায়। ক্লাইটেমেনেস্ট্রা ও আগামেমননের সন্তান অরেস্টেস ফিরে এসে বোন ইলেক্ট্রার সহায়তায় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয় মাকে হত্যা করে। সেকালে রক্তের সম্পর্কের কাউকে হত্যা করা গুরুতর পাপ ছিল। অ্যাপোলোর নির্দেশে এথেনা বিচার করতে বসেন। ক্লাইটেমেনেস্ট্রা তার স্বামীকে হত্যা করে যার সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু অরেস্টেস তার মাকে হত্যা করে যার সঙ্গে রয়েছে তার রক্তের সম্পর্ক। আর অরেস্টেস পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী মাতৃহত্যার কোনো প্রায়শ্চিত্ত নেই। কিন্তু অ্যাপোলো হস্তক্ষেপ করলেন। দু’পক্ষে জুরিগণ সমান ভাগে বিভক্ত হলেন। এথেনার কাস্টিং ভোটে মাতৃ-অধিকার পরাজিত হলো। পিতৃ-অধিকার জিতলো। ক্লাইটেমেনেস্ট্রার পক্ষে যুক্তি ছিল আগামেমনন যখন মেয়েকে দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে তখন একবারও সন্তানকে বলি দেবার সময় মায়ের কথা ভাবেনি। অথচ ১০মাস পেটে ধরার কষ্ট সেই করেছে। পিতা হিসেবে আগামেমনন নন। মিনার মনসুর এক কবিতায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘জন্মদাতা বাপটি এখন কোথায়? তার সে ক্ষণিক আনন্দের আমি কেন মাশুল দেব সারাজীবন?’ অনেকটা এমনই প্রশ্ন ক্লাইটেমেনেসট্রার। মা হিসেবে তার কোনো অধিকারই ছিল না সন্তানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
একই কাহিনী নিয়ে বাখোফেনের বইটা প্রকাশের একশ বছর পর, ইস্কাইলাসের নাটকের তিন হাজার বছর পর বুদ্ধদেব বসু লেখেন ‘কলকাতার ইলেক্ট্রা’। এ যুগে ব্যক্তি স্বাধীনতার দুয়ার খুলে গেছে। মাতৃ-অধিকার পিতৃ-অধিকারের জায়গায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ জায়গা করে নিয়েছে। তাই স্বামীকে হত্যা করে প্রেমিক অজেনকে নিয়ে সংসারী হয়ে মনোরমা যুক্তি দেখায়, স্বামী যুদ্ধে গেছে। স্ত্রীর কোনো খবর নেয়নি। অসুস্থ শরীরে, জ্বরে কষ্ট পাবার সময় অজেন মাথায় পানি ঢেলে শান্তি দিয়েছে, সেবা করেছে। একটা নারী তো এ টুকুই চায়। এখানেই তার শান্তি। কিন্তু অদ্রি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে মা মনোরমাকে হত্যা করে।
এক্ষেত্রেও দেখছি শেষ পর্যন্ত পরকীয়ার বলি হচ্ছে নারী। পরকীয়া বর্তমান সমাজে আছে, তবে বিরুদ্ধে সমাজ দারুণ নীতিমুখর। তাই বলে এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় নি। সমাজের সঙ্গে তুমুল দ্বন্দ্বে অনেক অঘটন, অনেক অকল্পনীয় অনাচার নিয়ে পরকীয়া টিকে আছে। তাই ঘুরে ফিরে পরকীয়া সাহিত্যের বিষয় হয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লেখেন ‘পরস্ত্রী’ কবিতাটা –
যাবো না আর ঘরের মধ্যে ওই কপালে কী পরেছো
যাবো না আর ঘরে
সব শেষের তারা মিলালো
আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না
ধরে-বেঁধে নিতেও পারো তবু সে-মন ঘরে যাবে না
বালক আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো
কখন যেন পরে?
সবার বয়স হয়
আমার
বালক-বয়স বাড়ে না কেন
চতুর্দিক সহজ শান্ত
হৃদয় কেন স্রোতসফেন
মুখচ্ছবি সুশ্রী অমন, কপাল জুড়ে কী পরেছো
অচেনা,
কিছু চেনাও চিরতরে।