April 29, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল একটি নিত্য তামাশা

তৌকির ইসলাম ।। আজ প্রায় দেড় বছর পর লিখতে বসেছি। আমার এই লেখার পেছনে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন মুনমুন শারমিন শামস্, তাই তাকে ধন্যবাদ জানাই। গত বছরের বেশ কিছু ঘটনাতেই মনে হয়েছিল লিখি কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে  নি। কিন্তু যে ঘটনা দেখে একটু ভাবনা চিন্তা করেছিলাম ভাবলাম সেটা দিয়েই না হয় আবার শুরু করি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে গত বছর তিন জন মিডিয়া ব্যক্তিত্বের একটা ভিডিও ফুটেজ বেশ ভাইরাল হয়। ভিডিওটি ছিল এরকম যে তারা রাতে হয়তো ফিরছিলেন না হয় যাচ্ছিলেন কোথাও আর ব্যক্তিগত ভাষা ব্যবহার করছিলেন। আর সেই ভিডিওটি দেখলাম ভাইরাল হল। মানুষের নানা ধরনের মন্তব্য তো আছেই। এই ভিডিওটি ছাড়াও এর আগে পরে অনেক ভিডিও এরকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে। কোনোটা স্ক্যান্ডালের খেতাব পেয়েছে।

এই ঘটনাগুলোকে যদি আমরা কয়েকভাবে বিশ্লেষণ করতে চাই তবে দেখতে পাব পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। অনেকেই বলতে পারেন যে তারা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাই তারা ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি শুধুই তাই!

গত বছরের যে ভিডিও’র কথা আমি বলছি তাতে দুইজন নারী অভিনেতা এবং একজন পুরুষ অভিনেতা রয়েছেন। তারা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এই কথা সত্য কিন্তু তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন আছে। আমাদের মতো তাদেরও বন্ধু আছে। আমরা যেভাবে বন্ধুদের সাথে কথা বলি, হয়তো একটু আধটু স্ল্যাং ব্যবহার করি, সেটা তারাও করেছে। তাতে কি  অন্যায় হয়েছে বলা যায়? আদৌ বলা যায় না। সমাজের কাছে সমস্যাটা হচ্ছে দুইজন নারী অভিনেতা ঐ ভিডিওতে ছিলেন।

আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো আমাদের নারীর সংজ্ঞায় শিখিয়ে দিয়েছে নারী স্ল্যাং ব্যবহার করতে পারে না। আপনি একবার ভাবুন তো যদি ভিডিওটিতে কোনো নারী অভিনেতা না থেকে তিন জনই যদি পুরুষ অভিনেতা হতেন তবে এই ভিডিও’র প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের থাকতো কিনা!

ঠিক তেমনি এর আগে পরে যতগুলো ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবার টাইমলাইনে ঘুরে বেড়িয়েছে তার কারণ হচ্ছে ভিডিওগুলোতে নারীর উপস্থিতি। আর আমাদের সকলের মন্তব্য তা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাদের মাথায় সেট করে দিয়েছে যে নারীর কামনা-বাসনা থাকবে না, নারী কাউকে মারতে পারবে না, নারী কোনো বাজে ভাষা ব্যবহার করতে পারবে না। প্রত্যেকটা ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর আমরা কয়জন ভিডিও’তে থাকা পুরুষটাকে নিয়ে কথা বলেছি?

এখন বলতেই পারেন যে তারা মিডিয়ার, তারা সমাজে পরিচিত তাই তাদের ব্যাপার এতোটা  চাউর হয়েছে। তারা পরিচিত এবং মিডিয়ার তা ঠিক কিন্তু এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মিডিয়ার সাথে যুক্ত নারীকে যথাযথ সম্মান করে কি! বরং সমাজ তো গোপনে তাদের নামে রটনা ছড়ায়।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এটা একটা বিশাল হিপোক্র্যাসি। সমাজ যে কোনো অনুষ্ঠানে, বিনোদনের মাধ্যমে নারীর সরব উপস্থিতি উপভোগ করবে আর সুযোগ বুঝে তারই চরিত্রে কালিমা লেপন করবে। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে মানুষ নয় ভোগের সামগ্রী মনে করে। যদি সমাজ নারীকে মানুষের সম্মান দিত তবে সবার আগে যে বা যারা এই ভিডিওগুলোকে ভাইরাল করেছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতো। একটা সমাজে যখন পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিরাজ করে সেই সমাজে অন্য সবকিছুর মতো সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থার কোনো ভারসাম্য থাকে না। তখন মানুষ অসুস্থ কিছু থেকে বিনোদিত হয়। আর তখনই ব্যক্তিগত ভিডিও বা কথোপকথন হয় বিনোদনের খোরাক। আর নারীকে করা হয় সেই বিনোদনের আর অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু। আর এই কারণে আমাদের খেলার মাঠগুলোতে মেয়েদের খেলার ব্যবস্থা থাকে না। ইনডোর গেমসে মেয়দের জন্য আমরা খুব কমই বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা ভাবতে পারি। ঠিক একইভাবে ছেলেদের জন্য থাকে না একটা সুন্দর পরিপূর্ণ নাচ কিংবা গানের স্কুল। কারণ নাচ বলতেই আমরা বুঝি একজন ষোড়শী তরুলতার ন্যায় হাত নাড়িয়ে সুরের তালে নাচতে থাকবে। কিন্তু একজন ছেলেও যে নাচতে পারে তা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মানতে নারাজ।

আসলে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজ  হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অসুস্থতার একটা সিম্পটম। পুরুষতান্ত্রিকতা যে সমাজের প্রত্যেকটি অর্গানকে ধ্বংস করে তার প্রমাণ।

নারী যে পেশায় নিয়োজিত হোক না কেন তাকেই কেন চরিত্রহীনের তকমা দেওয়া হয়! এটা কি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তামাশা নয়! ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজ তো এর একটি নিদর্শন মাত্র। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্তত এতটুকু বোধদয় হওয়া দরকার যে টিভিতে যার আবেঘন চুম্বনে আমরা শিহরিত হই, তার বেডরুমের চুম্বন কিংবা রাতের রাস্তায় বন্ধুর সাথে অবাধ কথোপকথনের অংশ ভাইরাল হলে আমরা মানুষ হিসেবে ঠিক ততটুকুই লজ্জিত হই।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *