November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীবাদকে না জেনেই কেন হেয় করা হয়?

আমিনা সুলতানা সোনিয়া ।। আপনি যদি নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট হন তাহলে আপনাকে অহরহ ব্যঙ্গাত্মকভাবে যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তা হচ্ছে – “এর নাম নারীবাদ কেন, সমতাবাদ না কেন ? Why its called femenism not peoplism/ humanism?” অথচ প্রশ্নটা হওয়া উচিৎ ছিল “নারীবাদ আসলে কী  বা What is feminsm?” এই দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের রয়েছে নারীবাদ / Feminism নিয়ে ভ্রান্ত ধারনা। তারা মনে করে নারীবাদ মানেই পুরুষবিদ্বেষ আর নারীবাদী মাত্রই পুরুষবিদ্বেষী এবং নারীবাদ নারীদের ঢালাওভাবে পুরুষদেরকে ঘৃণা করাই শেখায় আর এসবের মাঝেই ঢাকা পড়ে যায় নারীবাদের গূঢ় অর্থ ।

একটি দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি মানুষ কেন এই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে তা একবার ভেবে দেখেছেন? আর এই জিংঘাসার তালিকায় কিন্তু শুধু পুরুষই নয়, রয়েছে নারীরাও। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বহুল সংখ্যক মানুষের কেন নারীবাদ তত্ত্ব নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট ধারনা নেই? সবাই কেন “কান নিয়ে গেছে চিলেতেই বিশ্বাস করে?” কেন এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী?

এর মূল হেতু পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব। এছাড়া রয়েছে মৌলবাদ, ধর্মীয় গোড়ামি বা অন্ধত্ব। নারীবাদ বা নারীবাদীদের অচ্ছুৎ মনে করাটা কিন্তু শুধুই অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষের মনোভাব নয়, উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির মনোভাবও প্রায় একই। যারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তাদের কথা না হয় বাদ দেয়া যায়; কিন্তু যারা শিক্ষিত তারা কেন নারীবাদকে শুধু শুধু নামকরণের কারণে হেয় করে? এটা কি নারীবিদ্বেষী / missogonist মনোভাব নয়! তার মানে নারীবাদকে যদি আবারো নামকরন করে রসোগোল্লা রাখা হয় তাহলে কি তারা হাসিমুখে নারীবাদকে সমর্থন  দেবে? তা তো নয়। কেন এই মানুষগুলো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একটু বিশদভাবে পড়ে নারীবাদকে জানার চেষ্টা করে না?

সাধারণভাবেই কেউ যখন কোনো কিছু নিয়ে বিরূপ ধারনা পোষণ করে তখন উল্লেখ্য বিষয় সম্পর্কে বিশদ জেনে নেয়। অথচ নারীবাদের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা পুরো উল্টো। যেখানে উন্নত তথ্য-প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় থাকার কারণে এক লহমায় যে কোনো তথ্য বা সংবাদ সহজেই জানা যায় সেখানে এক ধরনের মানুষের এ সম্পর্কে নেই কোনো বিশদ ধারনা। তারা শুধু জানে নারীবাদকে বা নারীবাদীকে হেয় প্রতিপন্ন করতে। এই যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এর মূল কারণ কিন্তু জানার অনাগ্রহ নয়, এর কারণ হচ্ছে ভীতি এবং এই ভয়ের উৎপত্তি কিন্তু সেই পিতৃতান্ত্রিকতা থেকেই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যখন দেখে নারীরা প্রশ্ন করা শিখে গেছে তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। পিতৃতন্ত্র ভেঙ্গে পরার ভীতি। এই ভয় থেকেই নারীবাদ সম্পর্কে ভুল ধারনা ছড়ানো হয় এবং নারীবাদকে হেয় করা হয়। পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক যেমন শুধু পুরুষরাই নয় নারীরাও, তেমন নারীরাই একমাত্র পুরুষতন্ত্রের শিকার হয় তা কিন্তু নয়, পুরুষরাও পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়। নারীবাদ নিয়ে নানান ভুল ধারণা যত বেশি চর্চিত হবে, তত বেশি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চেপে ধরবে।

নারীবাদ আসলে কী? নারীবাদ মানে তো পুরুষবিদ্বেষ নয়, পুরুষ মানেই যেমন পুরুষতান্ত্রিকতা নয় তেমন নারীবাদ মানেও পুরুষের বিরোধিতা নয়। নারীরা যেমন নারীবাদী হতে পারে, তেমনি পুরুষরাও নারীবাদী হতে পারে। নারীবাদের মূল লক্ষ্য মানুষের সমতা নিশ্চিত করা, নারী-পুরুষসহ সব লিঙ্গের সমতা নির্ধারণ করা। নারীবাদ পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে, নারীবাদ মানে হচ্ছে নারী পুরুষসহ সকল লিঙ্গের প্রতি যে বৈষম্যগুলো হয় তা নিয়ে প্রশ্ন করা এবংএগুলো যত দ্রুত কমিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে কাজ করা। নারীবাদের আসলে নির্দিষ্ট কোনো বাউন্ডারি বা সীমানা নেই, এর রয়েছে বিভিন্ন ধারা। ইসলামিক ফেমিনিজিম, থার্ড ওয়ার্ল্ড ফেমিনিজম, ইকো ফেমিনিজম, ব্ল্যাক ফেমিনিজম, ট্রান্সন্যাশনাল ফেমিনিজম, লিবারেল ফেমিনিজম, লেসবিয়ান ফেমিনিজম , রেডিকাল ফেমিনিজম সহ আরো হাজারো ধরনের ফেমিনিজম বা নারীবাদ রয়েছে।

অন্যসব তত্ত্বের মতো এরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এখানে এক ধারার ফেমিনিজম বা নারীবাদ আবার আরেক ধারার নারীবাদের সীমাবদ্ধতাকে প্রশ্ন করে, কোনো বিশেষ ধারা বা যে কোনো একটি ধারার নারীবাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে পুরো নারীবাদকে বিচার করা সম্ভব না। নারীবাদের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই এ কথা কোন নারীবাদী বলবে না। এই সীমাবদ্ধতাকে নারীবাদীরা কিন্তু স্বীকার করতে জানে, সাথে এ ব্যাপারে অন্যদের ছুড়ে দেয়া প্রশ্নটাও নিতে পারে, তদুপুরি যথাসাধ্য উত্তর দিতেও চেষ্টা করে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে কেউ যখন নিজেকে নারীবাদ থেকে বিছিন্ন রেখে এই সীমাবদ্ধতাগুলো অ্যাড্রেস করে বা প্রশ্ন করে সেটাও কিন্তু এক ধরনের নারীবাদী এপ্রোচ। নারীবাদ একটা evolving open কনসেপ্ট। বাংলাদেশের নারীবাদ আর পশ্চিমা নারীবাদ যেমন এক ধরনের নয়, ১০০ বছর আগেকার নারীবাদ আর এখনকার নারীবাদও এক ধরনের নয়। আপনার নারীবাদ আর আমার নারীবাদও হয়তো এক ধরনের নয়। নারীবাদ ভিন্নতা নিয়ে চলতে জানে। এই ভিন্নতা নিয়েই নারীবাদ অধিকারবঞ্চিত নারী পুরুষসহ সকল লিঙ্গের মানুষের জন্য কাজ করে যায়। নারীবাদে প্রশ্ন করার সুযোগ এবং অধিকার দুটোই রয়েছে, তাই নারীবাদকে গালি হিসেবে ব্যবহার করার আগে অথবা একজন নারীবাদীকে হেয় করার আগে বিশদভাবে নারীবাদ কি জানার চেষ্টা করুন। কোনো কিছু নিয়ে ঢালাও মন্তব্য করা বা লোক মুখে শোনা কথা বলা কিন্তু মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। নারীবাদ নিয়ে আপনার ভিন্নমত থাকতেই পারে। সেই ভিন্নমতটি সঠিকভাবে প্রকাশ করুন হেয় বা ব্যঙ্গ করে নয়।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *