নারীর শিল্পের জাদুঘরে ‘স্কাই ইজ দ্য লিমিট’
সাবিহা ইশরাত জাহান স্টেলা ।। প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, শিক্ষা অথবা মানবাধিকারে বিশ্বের সব দেশের চাইতে বরাবরই এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, মানবাধিকার নিয়ে অন্য দেশকে কথা শোনাতে সদা ব্যস্ত মার্কিনি রাজনীতিবিদ অথবা নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের দেশে নারীর অধিকার রক্ষার অনেক জায়গাতেই স্থূল ভুল করে বসে আছেন যুগের পর যুগ ধরে। যেমন বিশাল এই দেশে কেবলমাত্র নারী শিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনী বা জাদুঘরের সংখ্যা মোটে একটা। ‘দ্য ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ উইমেন ইন আর্টস’-এর অবস্থান খোদ রাজধানীর বুকে – ওয়াশিংটন ডিসিতে। তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, এটি বিশ্বের একমাত্র জাদুঘর যেখানে শুধু নারীদের শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। সেখানেই গেল ২৫শে ফেব্রুয়ারি শেষ হলো ‘স্কাই ইজ দ্য লিমিট’ নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমসাময়িক নারী ভাস্করদের ভাস্কর্য প্রর্দশনী। আর ওই জাদুঘর ঘুরে জানা গেল কিভাবে বহু বছর ধরে কিউরেটর এবং চিত্র সমালোচকেরা নারীদের যেকোনো শিল্পকর্মকে অবহেলা ও উপেক্ষা করে এসেছেন।
প্রথমেই বলা যাক ‘স্কাই ইজ দ্য লিমিট’ প্রদর্শনীর বিস্তারিত। সেখানকার নারী ভাস্করদের বিরল ভাস্কর্যগুলো মূলত ছিল বিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের। যেগুলোর বেশিরভাগই শিল্পীদের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে নিয়ে আসে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। যার বেশিরভাগ আবার আগে কখনোই কোথাও প্রদর্শন করা হয়নি।
বৃটিশ ভাস্কর করনেলিয়া পার্কারের শিল্পকর্মটির নাম ‘থার্টি পিসেস অফ সিলভার সুগার বোল’। এই রুপালি বাটিগুলো শিল্পী সংগ্রহ করেন নিলাম, চোরাবাজার বা বন্ধুদের কাছ থেকে। ২০০৩ সালে চারদিকে ক্ষমতালোভীদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে ক্লান্ত শিল্পী এটি সৃষ্টি করেন।
ভারতের কলকাতার শিল্পী রিনা ব্যানার্জীর শিল্পকর্ম ‘লেডি ইন কমার্স’। কাঠ, কাঁচ, লোহা ও অন্যান্য ধাতুর মিশ্র মাধ্যমে তৈরি এই ভাস্কর্যটিতে শিল্পী নারীর ওপর সমাজ ও পুঁজিবাদের ষড়যন্ত্রগুলো বোঝাতে চেয়েছেন।
‘নারীরা কখনোই অতটা শক্তিশালী নয় যে পুরুষের মত ভারি ভারি ভাস্কর্য বানিয়ে ফেলবে’ – এই ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গে ফেলার প্রমাণ পাওয়া যাবে চাকাইয়া বুকারের দু’হাজার পাউন্ড ওজনের শিল্পকর্ম ‘এসিড রেইন’ দেখলে। শিল্পীর মতে, এটি একাধারে ধ্বংস ও সৃষ্টিকে বোঝায়।
চিলি’র শিল্পী জোহানা উনযুয়েটা’র ভাস্কর্য ’ব্ল হিঞ্জ’। কাপড়, সুতা ও ফেল্ট মাধ্যমে তৈরি ভাস্কর্যটি শিল্পী সৃষ্টি করেন ২০১১ সালে।
জার্মান ভাস্কর উরসুলা ভন রাইডিঙ্গভার্ডর এর সৃষ্টি ‘ডটির’। এটিও ‘নারী ভারি কাজ পারে না’ – এই আদিম ধারণা ভেঙ্গে দিতে পারে এক লহমায়।
এবার আসা যাক জাদুঘরটির অন্যান্য শিল্পকর্মের কথায়। জাদুঘরটি তৈরি করতে শিল্পসংগ্রাহক উইলহেলমা কোল ও তার স্বামী ওয়ালেস হলাডে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৯৭০ সাল থেকে নারীদের শিল্পকর্ম যোগাড় করতে শুরু করেন। যা করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন পৃথিবীর সব দেশেই নারীরা যেকোনো কাজ করে দক্ষতা অর্জন করলেও স্বীকৃতি পায় খুব কম ক্ষেত্রেই। এবং নারী শিল্পীদের অবস্থা নাজুক খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে ১৯৮৭ সালে খুলে দেয়া হয় ‘দ্য ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ উইমেন ইন আর্ট’ এর দরজা।
ষোড়শ শতাব্দী থেকে সমসাময়িককাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে পনের’শ নারীর ৬ হাজার চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য রয়েছে এখানে। আছে ফ্রিডা কাহলোর সেল্ফ পোর্ট্রেইট।
ক্যামেরুনের শিল্পী অ্যঞ্জেলি ইটুন্ডি এসাম্বার বিখ্যাত ফটোগ্রাফ ‘নোইয়া’ বা কালো। কৃষ্ণবর্ণ কি নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা? বাধা ততক্ষণই যতক্ষন নারী বিষয়টি আমলে নেয় বলে মনে করেন এসাম্বা।
দীর্ঘদিন এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি নিয়ে কাজ করা দক্ষিণ আফ্রিকার চিত্রগ্রাহক যেনেল মুহোলির পুরষ্কারপ্রাপ্ত ছবিটিও আছে এই যাদুঘরে। মুহোলি বলেন, সেখানে এই সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন তারা কত ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার।
ক্যালিফোর্নিয়ার ভাস্কর অ্যালিসন সার, বরাবরই নারীদের নিয়ে ভাস্কর্য বানান। তাঁর বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘স্কর্চ সং’ রয়েছে এখানে। নারীর কোমরে বেধে দেয়া হয়েছে একাধিক হাঁড়ি পাতিল। রয়েছে হাতে ও কাঁধেও।
এই মোটে ১৯৮৮ সালে ‘গেরিলা গার্লস’ নামক মুভমেন্টে বা বিক্ষোভের মাধ্যমে যে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোন যাদুঘরে নারী শিল্পীদের ছবি কোনো রকম বৈষম্য ছাড়াই প্রদর্শনের অধিকার আদায় হয়। তার আগ পর্যন্ত নিউইয়র্ক সিটির মাত্র একটি জাদুঘরে কোনো নারী শিল্পীর একক প্রদর্শনী হয়। ওয়াশিংটন ডিসি’র এই যাদুঘরটিতে রয়েছে এর দালিলিক প্রমাণ।
তবে অতৃপ্ত মন বলে, শেষ হয়েও হলো না শেষ। এখানে ভারত ও পাকিস্তানের চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের শিল্পকর্মও স্থান পেয়েছে। পৃষ্ঠপোষকের অভাবেই হোক অথবা প্রচারের বৈষম্যে, বাংলাদেশের শামীম শিকদার বা নভেরা আহমেদের মত বিখ্যাত শিল্পীর অন্তত একটি শিল্পকর্ম ওখানে ঠাঁই পেলে হয়তো বঙ্গসন্তান হিসেবে আমার চোখে পরিপূর্ণ হতো নারীদের জন্য নিবেদিত এই জাদুঘর দর্শন।