May 16, 2024
সাহিত্যফিচার ৩স্যাটায়ার

নো ওম্যান নো ক্রাই

মাসকাওয়াথ আহসান।। আমি বেড়ে উঠেছিলাম প্রাচীন রেল জংশন ঈশ্বরদীর ঘন সবুজ জনপদে কলেজপাড়া বলে এক নির্জন উষ্ণ পরিবারে। কলেজের নানা বিষয়ের শিক্ষকেরা পাশাপাশি থাকতেন। আর যারা একটু নরম সরম বিদ্যানুরাগী অন্য পেশার মানুষ; তারাও এ পাড়াটাকে বেছে নিয়েছিলেন বসবাসের জন্য।

কলেজপাড়ায় আমার স্বপ্নগৃহের নাম দ্যুতি-অরণী। দ্যুতি-অরণী থেকে যত দূরে যাই, নিসর্গ খুঁজি, পড়শির উষ্ণতা খুঁজি। পৃথিবীর নানাপ্রান্তে বসে বিনির্মাণ করি গৃহ; যা দেখতে অবিকল দ্যুতি-অরণীর মতো না হলেও, গাছপালা-পাখির গান-রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া বাউলের গান-সুনশান নীরবতা ভেঙ্গে অমল কিশোর কিংবা কিশোরীর হাসির শব্দ; আর দ্যুতি-অরণীর রান্নাঘরের সুঘ্রাণগুলোর পাজল জোড়া লাগিয়ে বিরাট কিশোরের মতো আনন্দযজ্ঞ খুঁজি।

জীবন যে একটাই; এইখানে বিষণ্ণতার সওদাগর হয়ে জীবন্মৃত বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। মানুষের জীবনের মুক্তির চিরন্তন অন্বেষণ করলেও; দ্যুতি-অরণীর প্রিয় কারাগারটিকে বয়ে চলি জীবনের একান্ত খেলাঘর করে।

এই কলেজপাড়ায় আমার আব্বার মতো দর্শন-শাস্ত্রের অধ্যাপক অথচ গৃহস্থ থাকতেন, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অথচ চিরকুমার নরনারায়ণ রায় থাকতেন, ইতিহাসের অধ্যাপক অথচ প্রেমে ব্যর্থ মজনু থাকতেন। আমার আব্বার জীবনের সংগীতপ্রিয়তা আমাদের ব্যান্ড সংগীত আর ইন্সট্রুমেন্টাল শোনার হৈ চৈ-এ হারিয়ে গেলেও; নরকাকার ছিল ধ্রুপদী সংগীত শোনার অবাধ সুযোগ। আর মজনু কাকা রাত হলেই প্রেমের লালা বাই গাইতেন।

এই তিনটি জীবন আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। অন্য যারা ছিলেন, তাদের কেউ কেউ শেক্সপীয়ারের শিশু সংস্করণ কিংবা গালিভারস ট্রাভেলসের ছবি-অলা বই পড়তে দিতেন; ধর্ম-নৈতিকতার কিছু উপদেশ দিতেন। আর কেউ কেউ ছিলেন কেবল প্রতিবেশি বলেই দেখা হলে স্নেহের আস্কারা দিতেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের এই মায়ার খেলাই হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠতম ক্রীড়া। কলেজ মাঠে ফুটবল গড়িয়ে, ক্রিকেটে বাউন্ডারি মারতে গিয়ে মাঠের সীমান্তরেখায় কট হওয়া; কিংবা পোলভোল্টের বৃথা চেষ্টার সব কিছুই আমাকে প্রস্তুত করেছিলো জীবনের ম্যাচের জন্য।

নরনারায়ণ রায় কলেজে পড়ানোর পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ করতেন; বাড়ির উঠোনে জ্যোৎস্না রাতে সংগীত আসর করতেন; আমাদের বাড়িতে আসতেন আব্বার সঙ্গে দর্শন আলোচনা করতে। যাপিত জীবনের মালিন্য তাকে স্পর্শ করতো না। তার সহযোগী একজন রান্নার ঠাকুর ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রজদার মতো আমাদের জীবনে লুচি-বুন্দিয়া-ফলাহার সবই আয়োজন করতেন।

চিরকুমার জীবন কত সুন্দর হয়; তা নরকাকার জীবন না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। নরকাকা একজন প্রকৃত নর যিনি কোন নারীর কাছে পরাভব মানেননি। বাগানভলিয়ার মেজেন্টা ফুল তার গৃহের প্রবেশ পথটিকে স্বর্গে মতো রূপ দিয়েছিলো। ভেতরের উঠোন জুড়ে কচি সবুজ ঘাস। চারপাশে নানা রং-এর ফুল গাছ। টিনের বাংলো বাড়ি; ভেতরটা ঠান্ডা; জলখাবারে মাটির কলসি থেকে ঢেলে দেয়া ঠান্ডা জল।
সাঁঝে নর কাকার নারীবর্জিত স্বর্গীয় জীবন আর রাতে নারীর হাহাকারে মজনুর বিলাপ সংগীতে; এটা বুঝে যাওয়া খুব সহজ ছিলো যে, নো ওম্যান নো ক্রাই।

আগে আমাদের আম্মাদের কালে মেয়েদের নাইওর যাবার চল ছিলো। সেই সময়টাতে আব্বা অনায়াসে আড্ডা দিয়ে কাটাতেন নর কাকাদের স্বর্গে। কিংবা ধ্রুপদী ফ্যাসিজমের অনুপস্থিতিতে আমাদের বাড়িটাই স্বর্গ হয়ে উঠতো। আমরা নানা বাড়িতে যাবার সময় আব্বা আমাদের ট্রেনে তুলে দিতে এলে, আনন্দ তার মনে হুঁই দিয়ে যেত। বোঝা যেত এই ট্রেনটা ছেড়ে গেলেই উনি প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদে আড্ডা দিয়ে অনেক রাত করে নরকাকার সঙ্গে এক রিক্সোতে চড়ে বাড়ি ফিরবেন।

আব্বা অনেকবার আমাদের মজনু আংকেলকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন; নরকাকার বীরোচিত কুমার জীবনের সুখের বিষয়টা তুলে ধরতেন। কিন্তু লাইলির জন্য মজনুর বিলাপ কখনোই থামেনি। সব শেষে এই কান্না পরমাত্মার সঙ্গে মিলনাকাঙ্ক্ষার কান্না হয়ে গেলে উনি বেশ অল্প বয়সেই মারা যান। নরকাকা অনেক সুখে পরিতৃপ্ত জীবনে অল্প বয়েসেই চলে যান। চিরকুমার জীবন মানে সতত মুক্ত জীবন; সেখানে ৪০ বছরের জীবিত অবস্থা ৮০ বছরের বিবাহিত বা জীবন্মৃত জীবনের চেয়ে অনেক আনন্দপ্রদ এক ইনিংস।

এই প্রজন্মের নারী নাইওর যেতে চায় না; মা-বাবার বাসায় গেলে চার-পাঁচঘন্টা কাটিয়েই ফিরে ফিরে আসে। ফিরে এসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাপটে বিরাজ করে। গৃহকর্মীরা সেই ফ্যাসিজমের সহমত ভাই-বোন হয়ে তাকে তেলাঞ্জলি দিয়ে মাথায় তোলে। এই তো একটা গৃহ; তা পরিচালনার ভাব দেখলে মনে হয় ট্রাম্প যেন হোয়াইট হাউজ চালাচ্ছেন। অল রাউন্ডার না হলে; ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেটারের যে বিপর্যয় হয়; সংসার সমুদ্রে নারীরও একই অবস্থা। এর ফলে সব কিছুতেই, ‘‘লিখে রেখো এক ফোটা দিলেম শিশির’’ বা ‘‘তোমাদেরকে এতো উন্নয়ন কে দিয়েছে!’’ এরকম গর্বের হাসি ও হাসি না’র টেনশনে ভরা আজকের যাপিত জীবন।

স্ত্রীকে অনেক বুঝিয়ে তার মায়ের সান্নিধ্যে কাটানোর জন্য সাতদিনের সফরে পাঠানোর পর; মনের মধ্যে ঘরে-বাইরে ফ্যাসিজমে হাসফাঁস ধরা ‘প্যারাডাইস লস্ট’ সলিলকিটি ‘প্যারাডাইস রিগেইনড’-এর সুশীতল হাওয়া রাত নিয়ে এলো যেন। স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়রে কে বাঁচিতে চায়!

বাইরে থেকে ফিরে জুতা কোথায় খুলে রাখলাম; শার্ট কোথায় ছুঁড়ে ফেললাম; এ নিয়ে ধারাভাষ্য দেবার সাতান্ন ধারা নেই; কতক্ষণ কাজ করলাম, কতটা খেলাম, কতটা ঘুমালাম; এই নিয়ে কারা প্রাধ্যক্ষের প্যানপটিসিজম নেই। প্রতিষ্ঠান নামের কারাগারের আড়িপাতা বা পর্যবেক্ষণে রাখা কারাবন্দী জীবন নয়; এ যেন মুক্তধারার জীবন; মুক্ত বিহঙ্গের জীবন।

এরকম ‘বিবাহ’ নামের কারাগারে প্রবেশ করতে না পারায় একজন মুক্তধারার মানুষ; ইতিহাসের সেই অধ্যাপক কেন এতো বেদনাহত হতেন; তা সত্যিই বোধগম্য হয়। এই তো বেশ আছি এক সপ্তাহের মেন্টাল হলিডে-তে। নরকাকার মতো নারীহীন স্বর্গে। অ্যাডাম অযথা আপেলের লোভে ইভের কাছে না গেলে; আমাদের তো স্বর্গচ্যুত হবার কোন কারণই ছিল না।