November 21, 2024
কলামফিচার ৩

আমরা এগিয়ে আছি হিপোক্রেসিতে

মেহেরুন নূর রহমান।। টাইমস হায়ার এডুকেশন (THE) দ্বারা প্রকাশিত ২০২৪ সালের সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী  কোনো বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয় তালিকার শীর্ষ ৮00তে জায়গা করতে পারেনি। চারটি বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ৮০১ – ১০০০ রেঞ্জে অবস্থান করছে, যেগুলো হল – ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (BRACU), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (DU), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (JU) এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (NSU)।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (BAU), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (BUET), এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (RU) ১০০১ – ১২০০ এর মধ্যে স্থান পেয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (KU) এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (SUST) এর অবস্থান ১২০২ – ১৫০০ এর মধ্যে।

কি দৈন্যদশা আমাদের!

ইউনিভার্সিটিগুলাতে কোয়ালিফাইড শিক্ষক নাই। রিসার্চ পেপারস পাবলিকেশন্স-এর সংখ্যা নূন্যতম। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রপার ইনফ্রাস্ট্রাকচার নাই, সঠিক সুযোগ সুবিধা নাই, লেখাপড়ার পরিবেশ নাই। স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির মাধ্যমে মিডিওকার লোকজনেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাচ্ছে। আমার পরিচিত এমন কিছ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দেখেছি, যাদের স্কুলে শিক্ষকতা করার যোগ্যতা নাই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স, মাস্টার্স এর ছাত্রদের পড়াচ্ছে! তাদের কাছ থেকে ছাত্ররা কী শিখবে?

ছেলেমেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার মোটিভেশন নাই। বিসিএস পাশ করে সরকারি আমলা হবে, পাওয়ার খাটাবে এবং সুযোগ পেলে ঘুষ খেয়ে পেট মোটা করবে এই হলো এইম ইন লাইফ। আমার জেনারেশন (দু-দশক আগে) মেয়েদের মধ্যে যতটুকু সেলফ-ডিপেন্ডেন্ট হওয়ার চেষ্টা ছিল তা যেন পরবর্তী প্রজন্মে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। রূপচর্চা আর ফর্সা হবার দিকে ঠিক যতটুকু ঝোঁক, লেখাপড়ার দিকে তার অর্ধেকও নাই। চেহারা ভালো হলে কোন সরকারি আমলা বা পয়সাওয়ালাকে বিয়ে করতে পারবে এটাই মূল উদ্দেশ্য। সুগার ড্যাডি, সুগার মাম্মি এইসব কনসেপ্টও বাড়ছে। খালি শর্টকাটে আয়েশি জীবন যাপনের ধান্দা।

জানমালের কোনো নিরাপত্তা নাই। পরিবেশ দূষণের কারণে বিশ্বের শীর্ষ অবসবাসযোগ্য শহরগুলার মধ্যে ঢাকা অবস্থান করছে। ধর্মের নামে মানুষকে খুন হচ্ছে, রাস্তায় দুর্ঘটনার কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, আগুন লেগে বছর বছর গার্মেন্টসের দরিদ্র মানুষগুলা মরছে, কিন্তু কোন প্রতিকার নাই। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদেরও রেহাই নাই। রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে তারা টেরোরিস্টদের হাতে জবাই হচ্ছে, না হলে রেস্টুরেন্টে আগুন লেগে মরছে। এসব ব্যাপারে সরকারের খুব একটা হেলদোল আছে বলে নজরে পড়েনা।

মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, খুন হচ্ছে, শিশুরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। এমনকি পুলিশ হেফাজতেও মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আপনি বিচার চাইতে কোথায় যাবেন? মাদ্রাসায় অমানবিকভাবে অত্যাচার এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশুরা প্রতিনিয়ত, কিন্তু সঠিক বিচার নাই, বরং সম্প্রতি দেশের একজন তথাকথিত জনপ্রিয় বুদ্ধিজীবী মাদ্রাসার শিক্ষকদের হয়ে সাফাই গেয়ে বাণী ছেড়েছেন এবং অনেকেই তাতে তাল দিচ্ছে।

সততা বলে একটা জিনিস আমাদের দেশে বিলুপ্ত প্রায়। সবখানে অসৎ লোকের পদচারণা । যে কোন ডিপার্টমেন্ট যান, কাজ করাতে ঘুষ ছাড়া উপায় নাই। আপনি ঘুষ না দিতে চাইলে নানাভাবে আপনাকে বিপদে ফেলবে। ব্যবসায়ীরা বিষ ঢালছে মাছে, সব্জিতে, ফলে, মাংসে, এমনকি শিশুদের দুধও বাদ নাই। সোসিওপ্যাথে ভর্তি দেশ, যাদের কাছে মানুষের বাঁচা বা মরা ম্যাটার করেনা। টাকা বানানোটাই মুখ্য।

উপরের এতো অন্যায়, দুর্নীতি, অসততা, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি নিয়ে মানুষের কিন্তু বোলচাল নাই। তারা পরে আছে শরীফ-শরীফা কিংবা গালা নাইটে চুমুর ঘটনা নিয়ে। কিংবা আম্বানির বিয়েতে কত টাকা খরচ হলো, কোন তারকা নাচলো বা খাবার বাড়লো এসব নিয়ে।

লেখাপড়ার আগ্রহ নাই, জ্ঞানের চর্চা নাই, ধর্মের বাণী সম্বল করে যে যা বলছে, ছাগলের পালের মত তার পিছনে ছুটছে সবাই। নিজ থেকে পড়শোনা করে যাচাই-বাছাই করার কোন ইচ্ছা নাই। একজন মানুষ প্রথাগত নিয়মের বাইরে, কারো কোনো ক্ষতি না করেও নিজের মত  করে বাঁচবার  অধিকার রাখেনা এই দেশে। সব ঠিক করে দেয় ধর্মের ধজ্জাধারীরা। আবার এতো যে ধার্মিক, কিন্তু  ইসরাইল ফিলিস্তিন ইস্যু – যেখানে হাজার হাজার শিশু এবং নারীরা মারা যাচ্ছে, বা ধর্মব্যবসায়ী, লোভী, নিষ্ঠুর আরবদেশগুলার নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে কোন মতামত নাই। পশ্চিমের দেশগুলার নানা বদনাম করবে আবার সেসব দেশে যাবার জন্য জীবনপাত করে। হিপোক্রেসি রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

দেশকে ভালোবাসি বলেই হয়তো এসব দেখে মন খুব ভারি হয়, কষ্ট হয়। বিশ্বের নানাদেশ এগিয়ে যায় জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, মানবিকতায়, উদারতায়, দাক্ষিণ্যে, আর আমরা এগিয়ে থাকি অজ্ঞানতায়, অশিক্ষায়, অমানবিকতায়, নিষ্ঠুরতায় এবং হিপোক্রেসিতে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *