May 15, 2024
সাহিত্যফিচার ৩বই নিয়ে আলাপ

আমি যে কারণে নারীবাদী নই…

উম্মে ফারহানা ।। জেসা ক্রিস্পিন তাঁর ‘হোয়াই আই অ্যাম নট আ ফেমিনিস্ট: আ ফেমিনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ বইয়ের সপ্তম অধ্যায় ‘মেন আর নট  আওয়ার প্রবলেম’ অংশে পুরুষ পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলছেন যে কোনো পুরুষ যদি নারীবাদ নিয়ে নিজের অস্বস্তি আর অভিযোগগুলো মেটানোর প্রত্যশায় এই ম্যানিফেস্টো পড়ে থাকেন, তাহলে  যেন ইমেইল করে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ না করেন, অন্য নারীদের কাছেও নারীবাদের এ সকল সমস্যা বা সংকটগুলো নিয়ে না যান। কেননা, একজন নারীবাদী হিসেবে নারীবাদকে সহজবোধ্য করে তোলা তাঁর (লেখকের) কাজ নয়। কড়া ভাষায় তিনি বলেন, “ইয়োর ল্যাক অফ এনলাইটেনমেন্ট ইজ নট আওয়ার প্রবলেম। ফিগার ইট আউট। ডু দ্য রিডিং”। এই অংশে শুধু পুরুষদের উদ্দেশ্য করে বলার ব্যাপারটি আমার কাছে একটু আপত্তিকর ঠেকেছে। নারীবাদ নিয়ে দ্বিধা কিংবা ভীতি নারীদের অনেকের মধ্যেও আছে বৈকি।

এই ম্যানিফেস্টোর মোট নয়টি অধ্যায়ে ক্রিস্পিন চোখে আঙুল দিয়ে দিয়ে দেখিয়েছেন বর্তমান নারীবাদের মূল সংকটগুলো। বইয়ের ভূমিকাতেই বলছেন নারীবাদ মানে যদি হয়-

-আমি নারীবাদী, আমি যা করবো সেটাই নারীবাদ, সেটা যতই উদ্ভট আর পশ্চাদপদ হোক- একথা দাবি করা
-দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিতদের শোষণে অংশ নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নামা
-যে কোন প্রকার ভিন্নমতকে উড়িয়ে দেওয়া
-বেড়ালের মতন মিউমিউ করার ভঙ্গি করা
-নিজের তুলনায় নিচের অবস্থানে থাকা সকলকে করুণা করে যাওয়া কিন্তু তাতে কিছুই এসে না যাওয়া
-জীবনের মূল্যকে অর্থ, ক্ষমতা ও নিরাপত্তা দিয়ে হিসেব করা
-নিজের সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপার
তাহলে আমি নারীবাদী নই।

প্রথম অধ্যায়ের নাম হলো, ‘দ্য প্রবলেম উইথ ইউনিভার্সাল ফেমিনিজম’, বাংলা করলে হয় ‘সর্বজনীন নারীবাদের সমস্যা’। এই অধ্যায়ে জেসা ক্রিস্পিন বলছেন যে এই কালে এসে তারকা নারীরা যেভাবে ঘোষণা দিয়ে নিজেদের নারীবাদী বলে দাবি করছেন, যেভাবে ‘র‍্যাডিকেল ফেমিনিস্ট’ লেখা দামি ব্র্যান্ডের টি শার্ট বা সোয়েটার পরেই কেউ একজন নিজেকে নারীবাদী বলে দাবি করছেন বা নারীবাদী হিসেবে নিজের কর্তব্য শেষ বলে ভাবছেন, এটি সমস্যাজনক। এজন্য যে নারীবাদ একটি রাজনৈতিক অবস্থান এবং আন্দোলন। যুগে যুগে এটাই হয়েছে যে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গুটিকয় নারী সত্যিকার অর্থে লড়াই করেছেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠরা এর ফলাফল ভোগ করেছেন। সংখ্যাগুরু অংশ কখনোই মূল যুদ্ধে নামেননি এবং নামার প্রয়োজনও নেই। ফেমিনিস্ট হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেওয়া এখন ফ্যাশনেবল, তাই সবাই এটা করছেন, আর সত্যিকার অর্থেই সংগ্রাম করাটা, সর্বকালে সর্বযুগেই আনফ্যাশনেবল ছিল।
প্রাথমিকভাবে নারীবাদ মানেই পুরুষবিদ্বেষী, চুল ছোট, লেজবিয়ান, স্ত্রী বা মা না হতে চাওয়া উগ্র নারীদের যদি বোঝেন কেউ তাহলে তাদের সঙ্গে আলাপে যাওয়া অত্যন্ত সমস্যাজনক। নারীবাদীদের এই ভাবমুর্তির সংকট তৈরি হয়েছে সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিস্টদের কিছু কাজে। ক্রিস্পিন বলছেন, সর্বজনীন নারীবাদীরা লোকজনকে এটাই বোঝাতে চায় যে নারীবাদ মানেই উগ্রতা নয়, প্রথাবিরোধী নয়। নারীবাদী শব্দটিকে একটি গালি হিসেবে না নিয়ে বরং একটি লাইফস্টাইল হিসেবে দেখতে চান তারা। এই জায়গায় আপত্তি রয়েছে ক্রিস্পিনের।

মাত্র ৮১ পৃষ্ঠার এই ম্যানিফেস্টোতে জেসা ক্রিস্পিন বলছেন চিমামান্দা ন’গোজি আদিচির ‘উই শ্যুড অল বি ফেমিনিস্টস’ এর উল্টো কথা। সর্বজনীন নারীবাদের মূল সমস্যা হলো নারীবাদের সবচেয়ে সহজ সংজ্ঞা, নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা এবং লৈঙ্গিক বৈষম্যের অবসান ঘটানো- এতে যিনি বিশ্বাস করেন তিনিই নারীবাদী- এমন ভেবে নিয়ে নারীবাদী হয়েও সমাজে গ্রহণযোগ্য হবার বাসনা। লোকজনকে একথা বিশ্বাস করানো যে আমি/আমরা নারীবাদী হলেও আমি উগ্র নই, আমি প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি হুমকিস্বরূপ নই, সমঅধিকারে বিশ্বাস করে আপনিও নারীবাদী হয়ে যান এমন একটা নখদন্তহীন নিরীহ নারীবাদের প্রচার প্রসার ঘটানো যা আদতে নারীবাদের মূল উদ্দেশ্যের জন্য ক্ষতিকর।

ক্রিস্পিন আরও বলছেন, ‘সেলফ এমপাওয়ারমেন্ট ইজ জাস্ট অ্যানাদার নেইম ফর নার্সিসিজম’ (অধ্যায় পাঁচের শিরোনাম), নারী যখন নিজের পয়সা নিজে রোজগার করে নিজের উপার্জিত অর্থে নিজের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য কিনতে পারে বলে নিজেকে নারীবাদী দাবি করে তা মোটেও নারীবাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে না। সমান কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিক, গৃহস্থালি কাজের বা সন্তান পালনে সমান অংশগ্রহন, পারিবারিক সহিংসতা বা যৌন নির্যাতনের মতন অসংখ্য ইস্যু আছে যেগুলো নিয়ে কথা বলা দরকার, সমাধান দরকার। একেকজন নারী নিজে নিজের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ উপার্জিত অর্থের মাধ্যমে কিনে নিয়ে যে শ্লাঘা বোধ করে তাতে সে নিজে সুখী বা আত্মবশ্বাসী হতে পারে, কিন্তু তাতে অন্যদের বা এই সমাজের কোন উপকার নেই।
ক্রিস্পিনের মতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে নারীবাদীরাও তাই করছে যা এতোদিন নারীবিদ্বেষী পুরুষতন্ত্র করে এসেছে, নারীবাদীরাও ক্ষমতার চর্চা করতে চাইছেন এবং পুঁজিবাদের এই যুগে সেই ক্ষমতা কেনা হয় অর্থের বিনিময়ে। নারীবাদীরা যখন নারীর কাজের অধিকার চাচ্ছেন তখন তারা কথা বলছেন উচ্চশিক্ষিত নারীর অফিসে চাকরি করার ব্যাপারে আর ভুলে যাচ্ছেন যে পৃথিবীতে আদিকাল থেকেই নারীরা অনেক বেশি কাজ করে আসছে, শ্রমিক নারী তো বটেই, মধ্যবিত্ত নারীও গৃহকর্মে শ্রম দিয়ে আসছেন সব সময়ই। এখন গৃহকর্মে দেওয়া শ্রমকে যদি কাজ বলে গন্য না করেন, টাকা পাওয়া যায় না যে কাজে সেটাকেই যদি মূল্য দিতে না পারেন তাহলে আপনার চিন্তা পুঁজিবাদী চিন্তা। গোড়ায় গলদ সেখানেই।

ক্রিস্পিন সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলেছেন কেন পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর পরিবর্তন না হলে কত জন নারী সিইও হলেন আর কত জন নারী মিলিটারি অফিসার হলেন তাতে কিছুই এসে যায় না। ক্রিস্পিন বিশ্বাস করেন পুরো ব্যবস্থার আপাদমস্তক পুনর্নিমানে। ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই মিনমিনিয়ে নিজের অধিকার ভিক্ষা করে নেওয়াতে তাঁর আস্থা নেই। লৈঙ্গিক বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক বৈষম্যের নিরসন দরকার। যেভাবে পুরুষতন্ত্র নারীদের চুপ করিয়ে এসেছে, নারীবাদ যদি সেই একইভাবে পুরুষদের চুপ করিয়ে দিয়ে থাকে, অপরপক্ষের কোনো কথা শুনতে না চায় তাহলেও চলবে না। তাই অনলাইনের যে সকল হ্যাশট্যাগ প্রবণতা সাময়িক উত্তেজনা তৈরি করে আবার কিছুদিন পর ঝিমিয়ে যায় সেগুলোকে তিনি বলছেন ‘আউটরেজ ফেমিনিজম’, যৌন হয়রানি বা নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য কোন পুরুষের চাকরি চলে যাওয়ার ব্যাপারটিকে তিনি বলছেন ‘কুইক ফিক্স’- এসবে আদৌ কোন উপকার হবে কিনা তাতে তাঁর সন্দেহ রয়েছে।

বইটির মূল বক্তব্য হলো- নারীবাদী হওয়া বা না হওয়া, এই লেবেলটিকে দাবি করা বা না করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো দিক যে রয়েছে নারীবাদীরা যে দিকগুলো নিয়ে ভাবছেন না বা কাজ করছেন না। ক্রিস্পিন সেই দিকগুলোতেই আলোকপাত করেছেন। নারী সিইও দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান যখন নারী ও শিশুশ্রমিকদের শোষণ করে, নারী যখন আর্মিতে যোগ দিয়ে মানুষ মারার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয় এবং আধিপত্যবাদী পৌরুষিক ক্ষমতাচর্চায় অংশ নেয়, তখন নারীবাদ যে আসলে পুরুষতন্ত্রের উদ্দেশ্য সফল করছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ‘হাউ ফেমিনিজম এন্ডেড আপ ডুইং পেইট্রিয়ার্কি’জ ওয়ার্ক’ শীর্ষক অধ্যায়ে সার্বিকভাবে শোষণ নিপীড়ন বন্ধের কথা বলেছেন লেখক।

দ্বিতীয় অধ্যায় ‘উইমেন ডু নট হ্যাভ টু বি ফেমিনিস্টস’ আলোচনা করছে কিছু নারী কেন নারীবাদী না হয়ে, নিজের স্বাধীনতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র নিয়ে চিন্তা না করে পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল এবং প্রথাগত মেয়েলি জীবন বেছে নিয়েছেন তাঁদের কথা নারীবাদীরা শুনেছেন কিনা সেই ব্যাপারে। নারীবাদী হিসেবে সেইসব মেয়ে বা মহিলাদের ‘উদ্ধার’ করা আমাদের দায়িত্ব নয় বলে তিনি মনে করেন। বরং নারীর চাহিদা এবং প্রত্যাশার কথা শোনা দরকার। ক্রিস্পিন মনে করেন ‘উদ্ধার করা’, ‘রক্ষা করা’ বা ‘নিরাপত্তা দেওয়া’ জাতীয় ধারণাগুলো পুরুষতান্ত্রিক। তাই পশ্চিমা নারীবাদীরা যখন ভাবেন আরবের মেয়েদের মাথাকে হিজাবমুক্ত করতে হবে তখন তাঁরা আসলে সেই পুরুষতান্ত্রিকতায়ই আচ্ছন্ন যা নারীকে হিজাব পরতে বাধ্য করতে চায়।

জেসা ক্রিস্পিনের এই ক্ষুদ্র আকারের গ্রন্থটি সকলের জন্য সহজেই বোধগম্য হয়তো হবে না, কিন্তু নারীবাদীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে আমি মনে করি। নারীবাদের প্রাথমিক ধারণা এবং বোঝাপড়া যাদের আছে তারা এই ম্যানিফেস্টো থেকে নিজেদের পঠনপাঠনকে আরেকটু ঝালিয়ে নিতে পারবেন। অত্যন্ত ঝরঝরে ভাষায় লেখা, আন্দ্রেয়া ডোয়ার্কিন এবং শুলামিথ ফায়ারস্টোনের নাম কয়েকবার আছে, কিন্তু ভুরি ভুরি রেফারেন্স দিয়ে পাঠককে দিকভ্রান্ত করেনি এই বই।

জেসা ক্রিস্পিন (১৯৭৮) একজন লেখক, সমালোচক এবং বুকস্লাট ডট কমের এডিটর ইন চিফ। আমেরিকার কানসাসে তাঁর জন্ম। এই লেখকের বেশ কিছু বক্তব্যকে পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিবাহিত, যদিও আগে তিনি বলেছিলেন ‘‘বিবাহ নারীকে পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে, বিয়ে করলে আপনি সেই ইতিহাসকেই স্বীকৃতি দেন”। কিন্তু এই ম্যানিফেস্টোতে তিনি বলেছেন নারীবাদী হলেই প্রেমের সম্পর্ককে অস্বীকার করতে হবে বা যৌনতাকে অগুরুত্বপূর্ণ ভাবতে হবে এমন নয়, বরং সৌন্দর্য বা যৌন আবেদনের যে সকল মাপকাঠি পুরুষের বিবেচনায় নির্মিত হয়েছে, যেগুলো দিয়ে নারীর প্রেম পাওয়া বা না পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারিত হয় সেই মাপকাঠিগুলোকেই অস্বীকার করা দরকার। তিনি বলছেন পুরুষদের দৃষ্টি দিয়েই আমরা নিজেদের যোগ্যতা বা অযোগ্যতা নির্ধারণ করছি এবং এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে আমরা ঠিক ততটাই দেখতে পাচ্ছি যতটা পুরুষতন্ত্র দেখছে। নিজেদের দৃষ্টি প্রসারিত করা দরকার, প্রতিষ্ঠিত কাঠামো আমাদের যা দিয়েছে তার মধ্যেই বসে থাকলে কোন সত্যিকারের অর্জন সম্ভব নয়। নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম আয়েশ নিশ্চিত করে নিজেকে নারীবাদী দাবি করলেই যেমন সমাজে কিছুই বদলাবে না, তেমন পুরুষতন্ত্রের দেখাদেখি ক্ষমতার চর্চা এবং সকল ক্ষেত্রে নিজের কথা বলে অন্যের কথা না শোনা বা অন্যকে চুপ করানোর মাধ্যমেও সত্যিকারের পরিবর্তন আসবে না।