May 16, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

আমার উদ্যোক্তা জীবন, লড়াই আর নিন্দুকদের গল্প

শতাব্দী বোস।। ছোট বেলা থেকেই কে যেন মাথায় গুজে দিয়েছিলো, মেয়েদের নিজস্ব কিছু থাকা চাই। বার বার বরের কাছে হাত পাততে ভালো লাগেনা কোন মেয়েরই। খুব সম্ভবত আমার মা-ই কথাটা খুব ভালভাবে মাথায় ঢুকিয়েছেন। মা একটা প্রি ক্যাডেট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, কোন এক কারনে ছেড়ে দিলেন। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তাই বাবার সাথেই এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতাম।

মাকে এক টাকা পেতে হলেও বাবার কাছে চাইতে হতো। আমার খুব বিরক্ত লাগতো। কেন মা চাকরিটা ছেড়ে দিলেন! মাও খুব আফসোস করতেন। তখনই ভেবে নিয়েছি, বড় হয়ে কিছু একটা করতেই হবে।

বড় যত হতে থাকলাম, বাবার চাকরি দেখে চাকরির প্রতি অনীহা এসে গেলো। উফফ মানুষটা কত কষ্ট করছেন! মাথায় গেঁথে গেল ব্যবসার কথা। যাকেই পেতাম আমি খুব আগ্রহ করে বলতাম- আমাক নিবেন? সবাই হাসতো, বলত- বাচ্চা এখনও। আর মেয়েরা চাকরি, তাও প্রাইমারি স্কুলের চাকরিই ভাল। ব্যবসা মেয়েদের জন্য না। লোকে খারাপ কথা বলে।
বয়স অল্প থাকার কারনে মন খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু সবাইকে উৎসাহের সাথে বলতাম, ব্যবসা করেন? খুব ভালো কাজ। বেকার নাম না নিয়ে ব্যবসায়ী হওয়া অনেক ভাল।

সবাই হাসতো। জানিনা কি ভেবে হাসতো। আমার পরে লজ্জা বোধও হত।

কিন্তু এরই মধ্যে  জীবনের চরম বিপর্যয় নেমে এলো। শুরু হলো আমার জীবনের কঠিন সময়গুলো। কোন সহজ দিন ছিল না।

বাবা খুব দ্রুতই রিটায়ার্ড করেন। তখন আমি সবে মাত্র একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। তার আগে দিন খুব ভালোই কেটেছে। চার ভাই বোনের মধ্যে আমি ছোট। ভাইয়াও কেবলই আমার বড়। বড় আপুদের পড়াশোনা শেষ হতেই  বিয়ে হয়, বাবা বিপাকে পড়ে আমাকে নিয়ে। এক বছর পর আমি আমার ইন্টারমিডিয়েট জীবন পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা শুরু করতে গেলাম, জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কা তখনই পেয়েছিলাম হয়ত, আমার বাবা খুব মন খারাপ করে বলেই দিলেন যে- ‘তোমার আর পড়াশোনার দরকার নেই বাবা, আমি খরচ চালাতে পারছিনা।’

সেইদিন কোন কিছু বলিনি, আমি ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিশনের জন্য ফর্ম তুলতে টাকা চাইতে পারিনি আমার বাবার কাছে। লজ্জা, কি যে ভারি লজ্জা! এই ভেবে আরো লজ্জা যে আমার বাবার কষ্ট হবে। মা অসুস্থ বাবাও অসুস্থ, তাই ভার্সিটি জীবনের স্বপ্ন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলাম।

কিছু টাকা ধার করে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ম্যানেজমেন্টে চান্সটা নিলাম। পেলাম কিছু ভালো বন্ধু। ওরা আমাকে নানান ভাবে সাহায্য করত। না, আমি আার্থিক সাহায্যের কথা বলছিনা, মেন্টাল সাপোর্ট দিয়েছে তারা আমাকে। কি ভায়ানক ডিপ্রেশন! রাতে ঘুম বা কথা বলতেও ভালো লাগতো না। সবসময় ওরা সঙ্গ দিয়েছে। একটা টিউশনিরও ব্যবস্থা করে দেয় আমাকে। সেখানে গিয়েও আর এক বিড়ম্বনা, আমি কাজের লোক, না কি আমি বাচ্চাদের টিউশন করাতে যাই, এটাই ভেবে পাই না। বন্ধুদের বলি, ওরা বলে, ‘টাকা ভালো দেয়, দেখ কি হয়।’ দিন যায় অভিভাবকের আচরণ আরো খারাপ হতে থাকে। আজ দু’বেলা এসো, কাল বাবুদের নিয়ে একটু একাডেমিতে যেও।
আমার ক্লাস টাইমে ফোন দিয়ে বলতেন- কই আছ, বাবুদের স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় এসে পড়াও।

আমার মা কে জানাতাম, আমার মা বলত, ছেড়ে দাও,কষ্ট হলেও চলে যাবে,আত্মসম্মানটা আগে।

এভাবে ৬ মাস কেটে গেলো, কোটিপতি হওয়ার পরও আমাকে ২০০০ টাকা দিতে কতই না কষ্ট পেতেন! অথচ আমি সপ্তাহে ৬ দিনের মধ্যে ১২ বার যেতাম, তাও আবার আড়াই ঘণ্টা করে, এরপর বুঝতে পেলাম ওনাদের স্বামী স্ত্রী’র মধ্যে আমাকে ইন্ডিকেট করে কিছু নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে।

কি লজ্জা!
আমি এরপর আর মেনে নিতে না পেরে ফেসবুকের স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ওনাদের বুঝালাম এবং ছেড়ে দিলাম। শুরু হলো আবারও আমার বিভীষিকাময় দিন।

আমার খুব কাছের বন্ধু খুব ভালো ছবি তুলতে পারে, ইচ্ছা বড় ফটোগ্রাফার হওয়ার। সংগঠন করার কারনে প্রথম আলোতে প্রায়ই ওর তোলা ছবি এবং আমার ছবি পত্রিকায় যেত, সেই সুবাদে আমাদের আরো এক বন্ধু যোগ হয়, যার অনেক মেধা ও অসম্ভব ক্রিয়েটিভ।
তিন জনে মিলে ঠিক করে নিলাম আমরা একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট আইডিয়া নিয়ে এগুবো।

আমরা সবাই ছাত্র।  তাই ইনভেস্ট করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু ব্যবসার মূলই তো ইনভেস্ট বা মূলধন। আমরা চিন্তা করলাম যদি ব্যবসায়ে যোগ দেই, তবে আমরা আমাদের মেধাকে কাজে লাগাতে পারবো। সেই সাথে আমাদের  সাথে আরো অনেক মানুষ যোগ দেবেন। একই সাথে বিভিন্নরকম পেশার মানুষের প্রয়োজন হবে। আর তারা সবাই উপকৃত হবে।

বসে না থেকে আমরা ব্যবসার কাজ শুরু করে দিলাম।

সাইনবোর্ডে পাওয়া বিভিন্ন পেশার মানুষের ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে শুরু করলাম, কারণ আমরা জানি, তারাই বিজ্ঞাপন দেন, যাদের একটু হলেও কাজের চাপ কম থাকে। কাঠ মিস্ত্রি থেকে শুরু করে রিক্সাচালক, ভ্যান চালক এমন কি একটা বাচ্চা ছেলে ভিক্ষা করতো তাকেও আমরা আমাদের তালিকায় রেখে দিয়েছি। ওনাদের ডাক দিলেই আমরা পাই।
শুরু হলো আমাদের উদ্যোক্তা জীবনের পথচলা।

কিছু মানুষের সহায়তা নিলাম।  শুরুতেই কাজ পেলাম। প্রথম কাজেই খুব নাম পেলাম।

এদিকে শুরু হলো আমাদের নিয়ে রাজনীতি, কে মালিকানা নেবে এই নিয়ে।

আমরা ২ জন থেকে  ৩ জন, ৩ জন থেকে ৪ জন হলাম। কিছু মানুষ ডাকে,  কিন্তু সব ঠিক থাকার পও কাজে যেতেই ক্যান্সেল করে দেয়। বুঝলাম আমরা রাজনীতির শিকার। আমাদের আড়ালে আমাদের ইভেন্টের নামে বদনাম করে। এর পর আবার এক লোক এলেন, সাহায্য করবেন বলে খুব সান্ত্বনা দিলেন। কাজ পেলাম। টানা ৩ দিন বানিজ্য মেলার ডেকোরেশন করে আরো ১০ জনকে সাথে নিয়ে যখন পেমেন্ট আনতে গেলাম  জানতে পারলাম আমাদের সেই কাকা পেমেন্ট নিয়ে নিয়েছেন। হতাশ হয়ে বাকিদের কাছে কাজের বিনিময়ে কিছু না দিতে পারার লজ্জায় মাপ চেয়ে নিলাম।

আমরা কখনো প্রচারনার জন্য যে পোস্টার টাঙ্গিয়েছি, পরের দিন সকালে গেলে দেখতাম কোথাও কোন পোস্টার নেই। হতাশা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। এরপর  বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আমাদের ৪ জনকে আলাদা করার অনেক চেষ্টা চলে, এইভাবে চলা যায় না ভেবে এক বছর বসে ছিলাম। কিন্তু কোন না কোন বন্ধুকে সৃষ্টিকর্তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। আমাদের ছোট ছোট কাজ দিতেন। আমরা করে দিতাম। যা পেমেন্ট পেতাম তাই দিয়ে আমাদের জিনিস কিনতে শুরু করে দিলাম। আর কিছু টাকা রেখে দেই আমরা চার জন ছাড়া বাকি  যাদের কাজে নেই তারা যেন পেমেন্ট পায়, আর এমন ছেলেপেলেদের নেই যারা একটু টাকা পেলেও মূল্য দিতে জানে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আমরা অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে। কিন্তু  কিছু মানুষ থেকেই যায় যারা ভালো কিছুর সঙ্গ দিতে জানেনা বরং ক্ষতি করে। আমাদের অর্ডার ক্যান্সেল করিয়ে অন্যদের বা বাইরের লোক এনে করানোর চেষ্টা করেন। হাতছাড়া হয় আমাদের ৭/৮ টা ইভেন্টের কাজ। তবুও হতাশ হইনি।

আমরা আমাদের স্বপ্নের ইভেন্টের নাম দেই কল্পতরু।  এখনও অনেকে এসে বলে, চলবে না। অনেকে আবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।  এক  বছরে আমাদের কল্পতরু নাম করে। আমাদের কাজ ভালোলাগার কারনে এবার ১৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের জন্য গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় রাষ্টপ্রধানদের নিয়ে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল তার স্টেজ ডিজাইন ডেকোরেশনের দায়িত্ব আমাদেরই দেওয়া হয়। আর এটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

কিন্তু এত সবের মাঝে এখনও আমরা কেউ প্রফিট নেই না। হয়ত একদিন নেব। আমাদের কল্পতরু ইভেন্টের নাম আরো বড় হবে, সেদিন নেব।

কিন্তু সারাবছর বিয়ে বা ইনভেন্টর কাজ তো লেগে থাকে না, তাই বসে থেকে না থেকে কিছু করার চিন্তা শুরু করি।আমার আর্ট বা ক্রিয়েটিভ কিছুর মাঝে ঝোঁকটা অনেক বেশি। টেপা পুতুলের ভালোবাসায় আমি সবসময় আচ্ছন্ন।  মাটির জিনিস বলতেই পাগল। শুরু করলাম আমার টেপা পুতুল নিয়ে কাজ।

অনেকে এসে বলে, এই সব চলে নাকি! কিছু না বলে শুধু এটুকুই বলেছি, যে এটার কদর জানে সেই বুঝবে। আমার টেপা পুতুল ইতোমধ্যেই সারা দিচ্ছে।

আমি নিজে হাতে বানাই। কেউ হতাশ করলে খারাপ লাগে। এর সব কিছুতে আমার মা আমার পাশে। ইভেন্টের কাজে অনেক মানুষের সাথে মেলামেশা করতে হয়, বাড়িতে অনেকে রিপোর্ট পাঠায়। আমার মা বাবার একটাই কথা, ওর যা ভাল লাগবে, করবে। বড় হয়েছে নিজেরটা নিজে বুঝবে। নিজের পায়ে দাঁড়াক।

এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছুতে নেই। এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি।  প্রতিটা মেয়ের পাশে যদি এমন সাপোর্ট থাকে, জীবনকে অনেক দূর নেওয়া যায়।

নিন্দুকের মুখে ছাই।