পুরুষতন্ত্র এবং পুরুষের সীমাবদ্ধ বিচরণ
কিশোর পাশা ইমন।। প্রথম রেসিজমের অভিজ্ঞতা থেকে আমার লেখাটি শুরু করবো। পাঠকের হতাশ হওয়ার কিছু নেই, বর্ণবাদ নিয়ে শুরু করছি বটে, ব্যাপারটার সাথে নারীবাদের অনুভূতির সম্পর্ক বর্তমান।
বর্ণবাদ কী তা বোঝার বয়স তখনও হয়নি। ছয়-সাত বছর হবে বড়জোর। ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে আমরা বেড়াতে এসেছি। খুব সম্ভবত কারো বিয়ে উপলক্ষ্য। রাত এগারোটার মত বাজে। দূরসম্পর্কের কিছু কাজিন এবং আমার বড় ভাই বড়দের সুপারভিশন ছাড়াই একটা ঘরে খেলার সুযোগ পেয়ে গেলাম। বেশ কিছু মজার খেলা হয়েছিলো সেখানে, আমার সব মনেও নেই। অংশও নিয়েছিলাম। তারপর একটা খেলা এলো, যেখানে সবাইকে সবার হাত ধরে গোল হয়ে দাঁড়াতে হবে। এই খেলাটির কথা আমার মনে আছে, কারণ যখন আমারই বয়েসী একটা মেয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, “ভাইয়া, তুমি খেলবা না?”
আমি আমার স্বভাবসুলভ হাসিটা হেসে বলেছিলাম, “না।”
ঐ খেলা থেকে আমার নিজেকে সরিয়ে ফেলার কারণ হচ্ছে আমার চাইল্ডহুড ট্রমা। খুব ছোটবেলা থেকেই আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিলো আমার বড়ভাই হচ্ছে আমার মায়ের প্রিয় সন্তান, এবং আমি নই। কারণটা গায়ের রঙ। আমার ভাই ছিলো আমার মায়ের মতই ফর্সা, আমার গায়ের রঙ কালো, বাবার দিকে গেছি। বর্ণবাদ ইত্যাদির সাথে আমার পরিচয় ছিলো না। মানুষের গায়ের রঙ কেন কেমন হয় সে বিষয়ক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও হয়নি। নিশ্চয় আমার মা আমাকে গায়ের রঙ নিয়ে আহত করার উদ্দেশ্যে কিছু বলেননি, তবে আমি হয়তো সেভাবে ব্যাপারটা নিয়েছিলাম কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে। সেই থেকে আমি নিজের রঙটিকে ঘেন্না করতে শিখলাম, যেহেতু এটি একমাত্র কারণ যার জন্য আমি আমার মায়ের প্রিয়পাত্র হতে পারছি না। একই সাথে স্পর্শ এড়িয়ে চলা শুরু করলাম। আমার ত্বক যেন কাউকে স্পর্শ না করে। এতে করে তারাও নিজেকে অচ্ছুত মনে করবে – এমন এক ছেলেমানুষী আতঙ্ক আমার মধ্যে জন্ম নিয়েছিলো।
ফলাফল হিসেবে, খুব ছোট্ট বয়স থেকে, তখনও আমার বয়স পাঁচ ছোঁয়নি, আমি নিজেকে সমাজের বাইরের একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে শিখে ফেললাম। আমার কোনও বোন ছিলো না, কাজেই নারী পুরুষের বৈষম্য নিয়ে কিছু দেখা বা শেখার উপায়ও ছিলো না। তবে লিঙ্গের বিচারে মেয়েদের নিয়ম কানুন যে বয়সে পাল্টে যেতে থাকে, আমার ক্ষেত্রে তা বদলাতে শুরু করলো বর্ণের কারণে। একই কারণে, সমাজে আমার মত আর যারা আছে- মেয়ে, অবিশ্বাসী, কিংবা সমকামী – তাদের সাথে বাকিদের আচরণটা বড্ড বেশি চোখে লাগতে শুরু করলো ছেলেবেলা থেকেই। ঠিক যে কারণে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হাড়ে হাড়ে টের পান ভারতের সংখ্যালঘুর যাতনা। অথচ এপাড়ের সংখ্যাগুরু তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। লক্ষ্য করলাম, পুরুষতন্ত্র পুরুষকেও কীভাবে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে অনায়াসে!
আমার খুব পছন্দের এক পুরুষ আত্মীয় তখন ভীষণ সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক ঢাকায় একটা চাকরি পাওয়ার জন্য অনেকদিন স্ট্রাগল করলেন এবং অবশেষে এসিআই গ্রুপে প্রকৌশলী হিসেবে তার চাকরিটা হয়ে গেল। এর মধ্যে তার বিয়ের প্রসঙ্গ অনেকবারই উঠেছে, এবং প্রতিবারই মলিন মুখে তাকে জানাতে দেখেছি চাকরিটা পেয়ে গেলেই বিয়েটা করে ফেলবেন। এবং চাকরি হওয়ার বছরখানেক পর তিনি বিয়ে করলেনও। আমার মনে হলো, কেবল ঐ ক’টা দিনই বেচারা স্বাধীনভাবে, কেবল নিজের জন্য- একটা মানুষের মত বাঁচার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপর চলতে থাকলো আবারও যুদ্ধ। এই যুদ্ধ তার নিজের জন্য নয়। স্ত্রী ও অনাগত সন্তানের জন্য।
আরেকটু বড় হলাম। আঠারোয় পা দেওয়ার পর শুরু হয় নতুন নাটক। ছেলেদের এতে করে বিশেষ কিছু এসে না গেলেও, ‘দায়গ্রস্ত’ পিতারা কন্যার গতি করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। কলেজ জীবনের শেষদিকে দেখলাম বন্ধুদের গার্লফ্রেন্ডদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, কারণ ছেলে প্রতিষ্ঠিত নয়। আঠারো বছর বয়সে এদেশে ক’টা ছেলে আর প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে? এই প্রসঙ্গটি অনেকের কাছে ছেলেমানুষী মনে হতে পারে, তবে আমার ধারণা একে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে না দেখলে বড় ধরণের একটি ভুল করা হয়। ছেলেরা যখন আঠারো পেরুচ্ছে তখন তারা ‘প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাবে’ আতঙ্ক থেকে এক ধরণের ট্রমাটাইজড হয়ে থাকেন। এর ফলাফলটা আমাদের চোখে পড়ে আরও ছয়টি বছর পর, ছেলেটি যখন সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। তখন তারা পুরুষতন্ত্রের ঝাণ্ডা যে সোৎসাহে নিজের হাতে টেনে নেন, তার পেছনে ঐ স্মৃতি এবং ট্রমা দায়ী। আমার ধারণা, ছেলেদের বয়ঃসন্ধির শেষার্ধ্বে গিয়ে এমন একটি ভয়াবহ চাপের মধ্যে পড়ে যাওয়া তাদের মননে ভীষণ প্রভাব ফেলে থাকে। যেমন ধরুন, আমার ক্ষেত্রে এই আতঙ্কে আঁতকে উঠতে হয়নি, কারণ তৎকালীন প্রেমিকার বাবা তাকে চট করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন না। অথচ আমি আমার চারপাশে দেখেছি এমনটা ঘটা সম্ভব। কেউ হয়তো ঠেকে শিখছে, আর তাদের দেখে শিখছি আমরা, বাদ বাকিরা। সে বয়সে আমি কখনোই ‘প্রতিষ্ঠিত’ হয়ে উঠতে পারবো না। সে সুযোগ একেবারেই নেই। কাজেই আমার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল, প্রেমিকাকে নিরাপত্তার চাদরে আশ্রয় দিতে হলে আমাকে খুব দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
অথচ ওই বয়সটা কেবল ডানা মেলার। উড়ে বেড়াবার। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার। নিজের আগ্রহ খুঁজে পাওয়ার। তার পেছনে সর্বস্ব ঝুঁকি নেবার। ফিজিক্স নাকি ইলাস্ট্রেশন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ওটা। সাইক্লিং কিংবা ট্রেকিং, তার ভিত্তিটা গড়ার সময় সেটা। অথচ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রথম আঘাতটা এসে পড়ে আমাদের সেই সৃজনশীল অনুসন্ধানী মননের ওপর। সঙ্গিনীকে ‘রক্ষা করা’র জন্য কোনোরকম মাইনের একটা চাকরি পাওয়ার মাইন্ডসেট আঠারো বছরে হওয়া উচিত নয় কখনোই। বাংলাদেশে কেন নিউটন কিংবা আইনস্টাইন জন্মাচ্ছেন না তার পেছনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছুটা দায় আছে বৈকি। এখানে খুব অল্প বয়সে যতসব অগুরুত্বপূর্ণ চাপে পুরুষরা থাকেন এবং নারীরা থাকেন গুরুত্বপূর্ণ চাপে, যেহেতু তাদের ওপর এসে পড়া ঝড়-ঝাপ্টার পরোক্ষ প্রভাবেই পুরুষের চিন্তাজগৎ ব্যতিব্যস্ত, তবে ঝড়ের ধাক্কা তো যাচ্ছে তাদের ওপরই!
কাজেই, আমরা আমাদের পেশা বেছে নেই। যেমন, বায়োলজি ভয় পাই দেখে আমি বাছলাম ইঞ্জিনিয়ারিং। এমন অনেক বন্ধুই ছিলো আমার। এদের একজনের গল্প করা যাক। ধরা যাক, তার নাম তামিম। তামিমের মতো অনুসন্ধানী ছেলে আমার সেকশনে ছিলো না। গণিত ভালোবাসতো, ভালোবাসতো যুক্তি। তার রেজাল্ট কখনোই আহামরি ভালো ছিলো না, তবে অ্যাভারেজের তুলনায় ভালো ছিলো। তার অনুসন্ধানী মনের উদাহরণ একটা ঘটনা দিয়েই স্পষ্ট করা যাবে। ইলেক্ট্রিকালের সেকেন্ড কোর্সের আগের রাতে আমরা একসাথে গ্রুপ স্টাডি করছি। অনেকটাই বাকি সিলেবাস। এদিকে আমরা যন্ত্রকৌশলের ছাত্র বলে ইলেক্ট্রিকাল নিয়ে বাড়তি সতর্কতা রাখছি। একইসাথে আমাদের শেষ না হওয়া সিলেবাস নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি যখন, একটা ইকুয়েশনে এসে থামতে হলো।
ইকুয়েশনটা আমি বোঝার চেষ্টা করে পারলাম না। মনে হচ্ছিলো, দু’তিন লাইন জাম্প করে এটা লিখে ফেলেছে বইয়ে। এদিকে হাতে নেই সময়। কাজেই জিনিসটা কীভাবে এলো তা নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে চটপট ওই জায়গাটা মুখস্থ করে ফেললাম (নন-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্ররা ভ্রু কোঁচকাবেন না, অঙ্ক মুখস্থ করা প্রকৌশলবিদ্যার সাধারণ ঘটনা)। তামিম তা করলো না। সে ইলেক্ট্রিকালের বই বন্ধ করে গণিত নিয়ে পড়লো। ওই লাইন থেকে পরের দুর্বোধ্য লাইন কীভাবে এলো তা তাকে বের করতেই হবে। পরীক্ষার আগের রাতে সে প্রায় সারা রাত ওটা নিয়ে খেটে অবশেষে দেড় পৃষ্ঠায় তা ডেরাইভ করে ছাড়লো, খাতা ভর্তি তার জটিল ক্যালকুলাস। ফলাফল, পরদিনের সেমিস্টার ফাইনালে ডাহা ফেল মারলো বেচারা তামিম। আমি পাশ করে ফেললাম। পুরো রুয়েট লাইফে তামিমের ঐ একটাই ফেল। অথচ যে ডেডিকেশন দেখিয়েছে, আমি কোর্স টিচার হলে তাকে একটা মেডেল ধরিয়ে দিতাম! জোকস অ্যাপার্ট, এই গণিত ভালোবাসা অতি-অনুসন্ধানী ছেলেটার ইচ্ছে ছিলো উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাওয়ার। এবং আমাদের পুরো সার্কেলের মধ্যে কেউ যদি তা ডিজার্ভ করতো, তবে ওটা সে-ই। কিন্তু তামিম উচ্চশিক্ষার চেষ্টাটাও করতে পারেনি। সে ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট হওয়ার আগেই নানা জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়ে একটা চাকরিতে কোনরকম ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো।
কেন এই তুখোর মেধাবী, অঙ্কের জাদুকরকে নিজের সব স্বপ্ন, আশা স্বেচ্ছায় জলাঞ্জলি দিয়ে একটা বৈষম্যমূলক বেতনের চাকরিতে ঢুকে যেতে হলো, অনুমান করুন তো? ঠিক ধরেছেন, তার প্রেমিকা, আমাদের ব্যাচেরই একটি মেয়ে, তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পরিবারটি উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিলো। যথারীতি কন্যাকে রক্ষা করার জন্য কাকে সর্বস্ব খুইয়ে ছুটতে হয়েছে এখানে? পুরুষটিকেই।
পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজালে পড়ে, মেয়ে যতই উচ্চশিক্ষিত ও সাবলম্বী হোক, পুরুষকেই যে একটা দারুণ শো-ডাউন করে তাকে উদ্ধার করার নায়ক-নায়ক খেলায় নেমে পড়তে হচ্ছে – এর সবচেয়ে মজাদার দিকটি আপনাদের দেখাই এবার। আমি যদি আজ তামিমকে প্রশ্ন করি, “বন্ধু, বর্তমান জীবনে তুই সুখী?”
সে সবগুলো দাঁত বের করে উত্তর দেবে, “অবশ্যই সুখী। পেয়েছি নীলিমাকে। আর কী চাই?”
ভয়ের ব্যাপারটা হচ্ছে, সে হয়তো এই উত্তরটিতে বিশ্বাসও করবে। তবে আমি তো জানি ছেলেটা ডানা মেলে উড়তে চেয়েছিলো। নীলিমাকে পাওয়া তার জীবনের লক্ষ্য অবশ্যই ছিলো, তবে একমাত্র লক্ষ্য নয়। এবং অদম্য একটা ক্রোধ আমি এ কারণে অনুভব করি – এই বাড়তি চাপটা সমাজ ছেলেটিকে না দিলেও পারতো। একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ছিলো এই চাপটা, তামিমের মত পুরুষদের শক্তির অহেতুক অপচয়।
অপচয় বলার ব্যাখ্যাটা দেওয়ার সুযোগ দিন দয়া করে, আগেই মারতে আসবেন না। অপচয়, কারণ এটা তো আর ‘কাভি খুশি কাভি গম’ ছায়াছবির শাহরুখ খানের জীবন নয় যে সদ্য মৃত বাবার পাশ থেকে কাজলকে উদ্ধার করার জন্য তাকে তৎক্ষণাৎ বিয়ে করে ফেলতে হচ্ছে। সুস্থ স্বাভাবিক একটি মেয়ে ও একটি ছেলে, তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক দুটো পরিবার, ছেলেটি ও মেয়েটি একে অন্যকে ভালোবাসছে ও একসঙ্গে থাকতে চাইছে, শিক্ষাগত যোগ্যতাতে দু’জনেই সমান, অথচ তারপরও কেন ছেলেটিকে মারাত্মক এক চাপ দেওয়া হবে এগিয়ে আসতে এবং ‘দায়িত্ব’ নিয়ে নিজের স্বপ্ন, নিজের লক্ষ্যকে ছোট করে ফেলতে।
এমন অবস্থানে পুরুষ যা করেন তাকে বলা হয় আত্মত্যাগ। এবং এই আত্মত্যাগের কথা আপনি তাকে হিটলারের টর্চার সেলে নিয়ে গেলেও স্বীকার করাতে পারবেন না। তারা সবগুলো দাঁত বের করে বলবে, নীলিমাকে পেয়েছি, আর কী চাই?
তারা স্বীকার করবে না, সম্ভাবনার সর্বোচ্চ শিখরে তাকে যেতে দেওয়া হয়নি অদরকারি সব বিষয়কে বড় করে দেখিয়ে। কারও প্রাণ চলে যাচ্ছে না এমন একটি ঘটনাকে স্রেফ ‘প্রথা ও পরম্পরা’র দোহাই দিয়ে নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিতে। এমন উদাহরণ এই একটিই নয় এবং এই এক প্রকারেরই নয়। আপনি নিজের জীবনের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, সার্কেলের অমিত সম্ভাবনাময় কয়টি বন্ধু তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং পেছনের কারণটা কী?
আমি বাজি ধরে বলতে পারবো, পুরুষতান্ত্রিক দায়িত্বগুলোই তাদের বাঁধা দিয়েছে। ঈগলরা উড়তে পারেনি। পায়ে জগদ্দল পাথর নিয়ে ওড়া যায় না। এবার সে দায়িত্বগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখুন, দেখবেন অর্ধেকের বেশি ছিলো ‘না করলে কেউ মারা যায় না, তবে প্রথা ও পরম্পরা আহত হয়’ জাতীয় ঘটনা। তবেই বলুন, একে অদরকারি, অপচয় না বলে আর কী বলে ডাকা যায়?
এবং ব্যক্তিগত জীবনে আমি ঠিক করলাম, অদরকারি কারণে নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। বন্ধু ও সিনিয়রদের দেখে যা দেখেছি জীবনের পথে কত ধরণের গর্ত আমাদের স্বপ্নগুলো কেড়ে নিতে চায়। তাদের সে সুযোগ দেওয়া যাবে না। একটি মেয়ের যেমন স্রেফ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়, একটি ছেলের ক্ষেত্রেও তাই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা যদি ভোগ্যপণ্য হয়ে থাকে, পুরুষরা ফুট সোলজার। পুরুষরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রীতিনীতি তাচ্ছিল্যের সাথে পরিত্যাগ করলে পুরুষতন্ত্র ফুট সোলজার হারায় এবং দুর্বল হয়ে ওঠে। কাজেই পুরুষের প্রত্যাখ্যানকে সে ফিরিয়ে দিতে জানে আঘাতের কারেন্সিতে।
যেহেতু আমার একমাত্র নেশা উপন্যাস নিয়ে কাজ করা, তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা যা দরকার তাই করে চললাম। পুরুষতান্ত্রিক সব দায়িত্বকে অগ্রাহ্য করলাম তো বটেই, প্রথম প্রেমকে বিসর্জন দিলাম লেখালেখির স্বার্থে, বাড়ির ‘পুরুষটি’ হয়ে ওঠার মত চাকরি করতে করতে ছেড়ে দিলাম, এক পর্যায়ে কর্মক্ষেত্রটা পর্যন্ত বদলে ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে নিয়ে গেলাম হেলথকেয়ার সেক্টরে। টাফ কল, তবে আমি জানি ঈগলদের উড়তে হয় মুক্ত হয়ে। পায়ে বিশাল জগদ্দল পাথর নিয়ে ওড়া যায় না। এরপর উন্মোচিত হলো নতুন একটি দিক, আত্মমর্যাদা নিয়ে লড়াই করতে থাকা প্রতিটি নারীই আশা করা যায় সে দিকটি প্রত্যক্ষ করেছেন। অসাধারণ দৃঢ়তা আর লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকার পরও আচমকা একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হয়তো দেখলেন আপনি আসলে একজন অশ্বডিম্ব। দ্য বিগেস্ট ফেইলিয়র ইন দ্য ফ্যামিলি। আপনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে প্রথম শ্রেণির একটি ফলাফল করলেও, পরবর্তীতে নিজের প্রচেষ্টায় লিটারেচার এবং হেলথ কেয়ার সেক্টরে ক্যারিয়ার বানিয়ে ফেললেও আপনি ব্যর্থ হিসেবে পরিগণিত হতেই পারেন। আপনি একটি নোবেল কিংবা বুকার পুরস্কার ঘরে তুলে ফেললেও সেই ব্যর্থই রয়ে যাবেন।
কারণ এই পুরুষশাসিত সমাজের একটি নির্দিষ্ট প্রত্যাশা আছে, আছে নিজস্ব রূপরেখা এবং সেই অনুসারে চললে আপনার সঙ্গে কী হবে তাও সে ঠিক করে রেখেছে। সেই অদ্ভুত শুন্য এক চক্র। জন্মানো, বড় হওয়া, পড়াশোনা শিখে একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, তারপর ‘বাবা’ হওয়া এবং ‘দায়িত্ব’গ্রহণ করা। এ না করলে আপনার থেকে ব্যর্থ আর কে-ই বা হতে পারে! আমাকে একবার পরিবার থেকে বলা হয়েছিলো, “তুমি ক্যামেরা ইকুয়েপমেন্ট কিনতে যে সব বেতন খরচ করে ফেলো, জমাও না কেন? বিয়ে করতে হবে না?”
আমি বললাম, “আমার কাছে এই ব্যাপারটা শেখার গুরুত্ব বেশি। সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান আমার লাগবে। কাজেই টাকা ওখানেই ঢালাটা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত।”
আমাকে বলা হলো, “কিন্তু এভাবে একা তো থাকা যায় না।”
আমি বললাম, “দ্যাখো, আমার নিজেরই বর্তমানে যে ধরণের ক্যামেরা সেটআপ কেনার ইচ্ছে, তাতে লাগবে অন্তত আট লাখ টাকার বাজেট। লেখালেখির জন্য এদিকে ওদিকে যেতে হবে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে। কেউ যদি আমার নামে একটা বিশ লাখ টাকার চেক লিখে দেয়, তবে হয়তো সেটা শান্তিমতো করতে পারবো। অন দ্য টপ অফ দ্যাট আমি কেন একপাল নেমকহারামকে ডেকে এনে বিশাল আয়োজন করবো, যাদের অর্ধেক অনুষ্ঠান থেকে যেতে যেতে আমাদের গায়ের রঙ, আয়োজন, দেনমোহর, আচরণ নিয়ে জাজমেন্টাল কমেন্ট করতে করতে এবং ঢেকুর তুলতে তুলতে চলে যাবে? কেন আমি এই ফ্যাসাদের মধ্যে ঢুকতে যাবো, যেখানে ক্লিয়ারলি, কাজটা আমি আমার কাছের মানুষদের নিয়ে করতে পারি, ফালতু ঝামেলা, বিতর্ক আর খরচ না করে? আর ধরো, কারও প্রেমে আমি পা থেকে মাথা অবদি ডুবে গেলাম, সেক্ষেত্রে আমি খরচটা করবোও, এতে করে আমার প্যাশনের বারোটা বেজে গেলে যাক। কিন্তু, তারপর আমাকে তার দায়িত্ব নিতে হবে। এটা ইউরোপের একটা সংসার হবে না, যেখানে ভয়ানক স্বাধীনতা, ভালোবাসা, এবং দায়িত্ববোধ নিয়ে একটা সংসার গড়ে ওঠে (যা আবার এদের চোখে ‘মায়া-মহব্বতই নাই’ মন্তব্যের শিকার)। আমি জানি, ট্রেডিশনাল বাঙালি সংসারের কনসেপ্ট থেকে হয় তোমরা নয় সে মেয়েটি বের হতে পারবে না। ছিঁটেফোঁটা আসবেই। আমার প্যাশন তখন বাঁধাগ্রস্ত হবে। কেন আমি সেধে পড়ে এই পুরূষতান্ত্রিক সমাজের চোখে বিশাল নায়ক হওয়ার জন্য ঝামেলাটি নিজের ঘাড়ে আনতে যাবো?”
এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে আর দিতে পারেননি প্রশ্নকর্তা।
কেন আমাদের সেধে পড়ে পুরুষতান্ত্রিক ঝামেলা কাঁধে তুলে নিতে হবে, কেন বহন করে নিয়ে যেতে হবে এই পরম্পরা, সেই উত্তরটা পাঠকদের কেউ জানলে অবশ্যই দেবেন। একটা সত্য আমি বলে যেতে পারি, যে বিষয়টা নিয়ে অনেক কম কথা হয়- পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে উপেক্ষা করে নিজের মত জীবনযাপন করতে গেলে নারী ও পুরুষকে একই ধার নিয়ে আক্রমণ করে থাকে সমাজ। যদিও পুরুষ হওয়ার কারণে আমি কিছু পুরুষসহায়ক সামাজিক দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে তুলনামূলকভাবে সহজেই বিষয়টিকে সামলে ফেলতে পারি। নারীদের জন্য কাজটা ঢের, ঢের কঠিন।
আমি আপনাদের একটা প্রশ্ন করেছি। সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আপনাদের কিছু দিক মনে করিয়ে দিতে চাই। বর্তমানে যেসব পুরুষ মনে করেন তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের থোরাই কেয়ার করেন এবং যথেষ্ট স্বাধীনতা পেয়ে আসছেন, তাদের একাংশ নিজের অজান্তেই চকচকে একটা হাসি হেসে দাসত্ব করে যান। উত্তর দেন, নীলিমাকে পেয়েছি, আর কী চাই? (ভুল বুঝবেন না পয়েন্টটা, মেয়েঘটিত কারণই হবে এমন নয়, পরিবারের অদরকারি দায়িত্বগ্রহণ থেকে শুরু করে একশ’টা ব্যাপার থাকতে পারে)। পুরুষতন্ত্র ঠিক যেসব নিয়ম ঠিক করেছে তাদের সবগুলোর বিরোধীতা করা এখানে উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য নয় সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো এড়িয়ে যাওয়া। উদ্দেশ্য, আপনি যা করতে চাইছেন তা করতে এই সমাজব্যবস্থা দিচ্ছে কী না। ‘পরিবেশ ও পরিস্থিতি’র চাপে যেসব স্বপ্ন আপনি আর দেখতে পারছেন না সেই পরিবেশটা কী ছিলো? পরিস্থিতিটা কী ছিলো? তাতে পুরুষতন্ত্রের ভূমিকা কতখানি ছিলো? পুরুষতন্ত্র কি একেবারেই অদরকারি একটা বিষয়কে ‘মহা-বিপর্যয়’রূপে আপনার সামনে উপস্থাপন করেছিলো? করে থাকলে, এবং আপনি এই চালাকিটা ধরে ফেললে, আমাকে দয়া করে বলবেন কি, কেন আমি সেধে পড়ে এই পুরূষতান্ত্রিক সমাজের চোখে বিশাল নায়ক হওয়ার জন্য ঝামেলাগুলো নিজের ঘাড়ে আনতে যাবো?
বা, আপনিই বা কেন নিতে যাবেন?
কিশোর পাশা ইমন: লেখক, অনুবাদক, চিত্রনাট্যকার
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]