December 23, 2024
মুক্তমত

বউ-পাগল বনাম মা-ভক্ত

সাদিয়া আক্তার ।। “বউ-পাগল” – এই শব্দটা আমাদের সমাজের নারী, পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ কেউই যেন মেনে নিতে পারেন না। কারণ শুরু থেকেই এটাকে আমরা নেগেটিভ অর্থে ব্যবহার করে এসেছি। কোনো ছেলে বউ পাগল হয়েছে বা কি সবাই তাকে খোঁচা মেরে কথা বলবে, মুখ চেপে হাসাহাসি করবে, কেউ কেউ তো গালাগালি দিতে গিয়েও বলে, “আরে শালা তুই তো একটা বউ-পাগল……।” ছেলের মায়েরা আবার এসব নিয়ে খুব চিন্তায় থাকে। নাওয়া- খাওয়া ছেড়ে দিয়ে তারা সারাদিন চিন্তা করতে থাকে – “আমার সোনার পুত আর আগের মত নাই, হে আছে তামাশায়, মায়ের কতা মনেই হরেনা। বউ হের মাতাডা অ্যাক্কালে খাইছে।” মনে করে ছেলেকে বাঘে ধরে নিয়ে গেছে। এসব নানা কথা বলে বিলাপ করতে দেখা যায়। সঙ্গ দেয় আবার পাড়ার কাকিমা- আন্টিরা।

বউকে সম্মান দিলে, ভালোবাসলে, তাকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়ালে, তার ইচ্ছার প্রাধান্য দিলে, লেখাপড়া আর কেরিয়ারে বউ স্বামীর থেকে উচ্চপদে থাকলে, বউকে সবার সামনে সম্মান করলে এই সমাজে ছেলেরা বউ পাগল হিসেবে পরিচিতি পায়। যেটা মানুষ একটু মুখে ভেংচি কেটে বলে।

কিন্তু এর বিপরীত হচ্ছে “মা-ভক্ত” ছেলে। আহা তার কি যে নাম দাম সমাজে। তাকে সবাই মাথায় তুলে রাখতে পারলে শান্তি পেত এমন অবস্থা। সবাই তাকে সুনজরে দেখে। কিছু ছেলেও আছে তেমন। সে তার হ্যাডম প্রকাশ করতে চায় সবসময়। কেউ কেউ পারেনা লজ্জার ভয়ে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে যদি বউ পাগল নামক একটা লজ্জাজনক উপাধি পায়! এজন্য বউকে ছোট করে বীর উপাধি পেতে চায় তারা, বউয়ের উপর বড়ত্ব প্রমাণ করে সিংহ পুরুষ উপাধি পায়, ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে সফল পুরুষ হয়। বউকে চার দেয়ালে আটকে রেখে, লেখাপড়া কেরিয়ার বন্ধ করে দিয়ে পাড়ার চায়ের দোকান আর বন্ধুদের কাছে বুলি আওড়ায় মেয়েদের এতো লেখাপড়া করার দরকার নেই। কিন্তু বউকে একটু ভালোবাসলে আর বুঝলে তার নাম দাম মান সব কমে যাবে। মা-ভক্ত ছেলেগুলো সবসময় এজন্য মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে, “এখন কি করবো মা বলে দাও।” তারপর মা যেটা রায় দিবেন সেটাই যথার্থ। নমঃ নমঃ করে মেনে নেয় মায়ের সোনার পুতেরা।

সংসারের মারপ্যাঁচে পরে মেয়েটা হারায় তার স্বপ্নগুলো। লেখাপড়া ক্ষ্যান্ত দেয়, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা থেকে বিমুখ হয়। তখন তার সংসার ছাড়া আলাদা কোনো জগৎ থাকে না। হারিয়ে ফেলে বন্ধুবান্ধব, নিজের শখ আহ্লাদ, একটা সময় সে বুঝতে পারে কিন্তু তখন আর সময় থাকে না। এই সময়ে শুধু টানাটানি স্বামীর ভালবাসা পাওয়া নিয়ে। কিন্তু স্বামী মশাইয়ের কোনো চিন্তা নেই বউয়ের ভালোলাগা গুলো নিয়ে। সে শুধু তার প্রয়োজন ফুরায়। এদিকে মা চায় ছেলে মা-ভক্ত হোক আর বউ চায় বউ-পাগল হোক। এসবের মারপ্যাঁচে পরে মেয়েটা সরে আসে তার ক্যারিয়ার, শখ আহ্লাদ, ভালোলাগা থেকে।

প্রেমের সময়ে দেয়া কথাগুলো বিয়ের পরে আর রাখতে হয় না। কোনো বিবাহিত ছেলেকে যদি তার বউকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করা হয়,” How important she is?” তাহলে বেশিরভাগ ছেলেই উত্তর দিতে পারবে না। বউয়ের কোনো কথা প্রকাশ করতেই সে লজ্জা পাবে। কিন্তু এমন কোনো প্রশ্ন মেয়েটাকে করলে সে খুব গুছিয়ে বলবে সবার সামনে তার স্বামীকে বড় করে। বউ নিয়ে ফেসবুকে কোনো পোস্ট দিলে বা ছবি শেয়ার করলে সেখানেও থাকে নানা ধরনের নেগেটিভ কমেন্টস। কিন্তু কেন এই ট্যাবু আমাদের দেশে? এগুলো কেনই বা ধরে রাখতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম?

তাই পাশের মানুষটাকে সময় দিন। আপনার সবাই আছে, তারও আছে। কিন্তু তার কাছে সবার আগে প্রাধান্য আপনার। আপনিও সবার আগে তাকেই প্রাধান্য দিন। এতো থাকতেও সে ভাবে তার আপনি ছাড়া কেউ নেই। লোকে তো অনেক কথাই বলবে। কিন্তু দিনশেষে দেখবেন এই মানুষটাই আপনার পাশে আছে। কথা-বলা লোকগুলো নেই। এবারে একটু নিজেদের সময়টাকে নিজেদের মতো কাটিয়ে নিতে শিখুন, যেন সে হারিয়ে গেলে আফসোস করতে না হয়। বৃদ্ধ বয়সের গল্পের ঝুড়ি এখনই তৈরি করুন শখগুলো পূরণ করে।

শাশুড়ি মায়েরা, আপনারাও তো এমন সময় পার করে এসেছেন যখন স্বামীর ভালোবাসা পেতে চেয়েছেন, তার ভালোবাসার প্রকাশ চেয়েছেন, যেন কোনো বাঁধা না আসে তাইই চেয়েছেন। তাহলে ছেলের বউয়ের বেলায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন কেন? কেন টাকা নষ্ট হবে বলে বউয়ের কেরিয়ারে ফোকাস করা থেকে আটকে দিচ্ছেন? আপনাদের উচিত হাসব্যান্ড ওয়াইফকে একটা আলাদা স্পেস দেয়া, ভালোবাসা প্রকাশের সুযোগ করে দেয়া, এমন একটা মনোভাব সৃষ্টি করা যেন ছেলের মাথায় এই চিন্তা না আসে যে বউকে সবার সামনে ভালোবাসা, সম্মান করা, তাকে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করা, তাকে বড় প্রমাণ করা একটা লজ্জার কাজ।

সোনার ছেলেরা, আপনারা ভালোবাসুন আপনার পার্টনারকে। একমাত্র সেই আপনার লাইফের একটা পার্ট। আপনার সাথে সাথে সবকিছু তাকেই ফেইস করতে হবে। সে সারাজীবনের জন্য আপনার। হাসি, আনন্দ, দুঃখ কষ্ট তার সাথেই শেয়ার করতে হবে। প্রকাশ করুন আপনার ভালোবাসা। তাকে স্বাধীনতা দিন, তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে বাধা দিতে যাবেন না দয়া করে। এতে ভালোবাসা বাড়বে বৈকি, কমবে না। এক্ষেত্রে লজ্জা নামক ব্যাধি পরিহার করুন।

দয়া করে মায়ের সাথে বউয়ের ভালোবাসার তুলনা করতে যাবেন না। দুটোই আলাদা বিষয়। “মাকে বেশি ভালোবাসো নাকি বউকে” এমন মূর্খ প্রশ্ন করা থেকেও বিরত থাকুন। বউ ভালোবাসা আর সম্মানের করারই একটা মানুষ। খেয়াল রাখবেন এটা আপনি যত দিনে বুঝতে পারবেন তত দিনে যেন দেরি না হয়ে যায়!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *