May 15, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

যুগে যুগে পরকীয়া কেন টিকে আছে?

আমিনা সুলতানা সানজানা ।। আমরা জানি আমাদের এ দেশের বেশিরভাগ মহিলাই স্বামী দ্বারা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত বা অবমাননার শিকার। আবার কিছু কিছু পুরুষও স্ত্রীর অন্যায় আবদার রক্ষা করতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এমন অবস্থায় সংসারে আর দুজনের ভালোবাসা ভালোলাগার জায়গা থাকে না। শান্তির নীড় না হয়ে সেটা অনেকক্ষেত্রেই অশান্তির মূল কারণ হয়। সন্তানের কথা ভেবে দুটি মানুষ চরম অসুখি জীবনযাপন করেন। কোনো পক্ষই ভালো থাকে না।

এই পরিস্থিতিতে কারো কারো জীবনে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন হয়। তখন সমস্যা আরও বেশি জটিল আকার ধারণ করে। এই তৃতীয় ব্যক্তির সাথে সম্পর্ককে আমরা পরকীয়া নাম দেই। খুব জঘন্য দৃষ্টিতে দেখি। এই সম্পর্কে লিপ্ত ব্যক্তিদের সমাজে ঘৃণিত মানা হয়। (যাদের চরিত্রের সমস্যা আছে সে কারণে অকারণে পরকীয়া করে চলেছেন একটার পর একটা, তাদের কথা বলছি না এখানে। যারা সংসারে অশান্তির এক পর্যায়ে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে যান সেটা বলছি। )

তারপরও যুগে যুগে পরকীয়া কেন টিকে আছে? এই প্রশ্নের গভীরে আমরা কখনোই যাই না বা যেতে চাই না। কারণ আমরা চাই একটা সাজানো পৃথিবী। যেখানে বাবা-মাসহ সন্তান সুন্দর একটা জীবন কাটাবে। বাবা মাকে দেখানো হয় আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে। তারা কোন ভুল করতে পারে না। একটা আদর্শের মাপকাঠি আমরা সমাজে সেট করে রেখেছি যার বাইরে আমরা যেতে বা দেখতে নারাজ।

আইনে ও ধর্মে ডিভোর্সের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া থাকলেও আমরা সামাজিকভাবে এমন একটা বলয় তৈরি করে রেখেছি যার কারণে সহজে কেউ আলাদা হতে চান না। নিজেরা আলাদা হওয়ার বিষয়ে একমত হলেও সামাজিকতার কথা ভেবে এই উদ্যোগ নিতে চান না অনেকেই। এই সমাজ হিংভাগ দোষ দেখে মেয়েরই। দূরের লোকজন তো আছেই, কাছের আপনজনও আঘাত করে কথা বলতে তখন একটুও দ্বিধাবোধ করে না। কারণ সমাজে এমন একটা মানসিকতা সেট করে রেখেছে একজন ডিভোর্সি মেয়ে মানেই খারাপ, সে কেন মানিয়ে নিলো না, পুরুষ মানুষ তো এমন একটু আধটু করতেই পারে! একেবারে মার খেয়ে রক্তাক্ত না হওয়া পর্যন্ত অথবা স্বামী অন্য মেয়েকে বিয়ে করে আনা না পর্যন্ত আমরা ডিভোর্স নেয়াকে স্বাভাবিক চোখে দেখি না। কেউ কেউ এই পর্যায়ে যাওয়ার পরও বলে- ‘বাচ্চার জন্য সহ্য করা যেতো না এসব?’

আবার ডিভোর্সি বাবা মায়ের সন্তানদেরও আমরা ভালো চোখে দেখতে নারাজ। ওই বাচ্চাদের সাথে নিজের বাচ্চাদের মিশতে দিতে আমাদের অস্বস্তি লাগে। নিজের ঘরে যতই অশান্তি থাকুক আমরা ডিভোর্সি পরিবার পরিহার করতে পছন্দ করি।

আরেকটা দিক হচ্ছে বেশিরভাগ অভিভাবক কোনোভাবেই ডিভোর্সের পক্ষে না। কিছুদিন আগে আমার এলাকায় গৃহপরিচারিকার সাথে স্বামীর অনৈতিক সম্পর্কের কারণে এক গৃহবধূ সাত তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। পরে জানতে পারলাম তার স্বামী এসবে অভ্যস্ত ছিল বিয়ের প্রথম থেকেই। মেয়েটি তার পরিবারকে বারে বারে জানানোর পরেও তারা তাকে সব মেনে নিয়ে সংসার করতে বলেন। সে যেহেতু মানুষ ( জানি না তার পরিবার তাকে মানুষ হিসেবে ভেবেছিল কিনা) এক সময় সে এসব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। তার কাছে এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক সহজ মনে হয়েছিল নিঃসন্দেহে।

আমার আরেক পরিচিত তার ঢাকা শহরে ভালো চাকরি, স্ত্রী বাচ্চা ছেড়ে ছুড়ে কাউকে কিছু না বলে হুট করে শুনি একদিন বিদেশ চলে গেছে। দেশে থাকতে আমরা জানতাম তার স্ত্রীর ভয়াবহ সন্দেহ প্রবণতা ছিল। যার কারণে সেই ছেলেটি বিয়ের পর তার বোনদের সাথেও দূরত্ব রেখেছিল।

সমাজে আমরা যখন এমন মানদণ্ড ঠিক করেই রাখি তখন অবশ্যই অসুখি হওয়া সত্ত্বেও সংসার নামক খাঁচায় বন্দি থাকতে বাধ্য হয় অনেক নরনারী। হয়তো সমাধান সম্ভব, যদি তারা চায়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাধান আর হয় না। তখন মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সমাজের নোংরা কথার ভয়ে মুখ বুঝে সহ্য করতে হয় সব।

অল্প কিছু মানুষ সাহসী হয়, তারা নিজের পথ নিজে তৈরি করতে চায়। ধুকে ধুকে মরার চেয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচতে চায়। এবং তাদের আমরা সামাজিকভাবে মোটামুটি এক ঘরে করে দেই।

এই লেখা পড়ে অনেকেই মনে করবেন আমি হয়তো সংসারের বিপক্ষে লিখছি। আপনি আংশিক ঠিক ধরেছেন। যে সংসারে শুধু স্বামী স্ত্রী হিসেবে আপনাদের নামটাই আছে, কাজে কিছু নাই, সেই সংসারের বিপক্ষে লিখছি।

পারস্পরিক বোঝাপড়া, দুজনের প্রতি দুজনের সম্মান, একসাথে অন্তত কিছু কোয়ালিটি সময় কাটানো, লুকোচুরি না করা, দুজন মিলে ভবিষ্যৎ ভাবনা তৈরি করা এসব না থাকলে যে কোনো নরনারীর পক্ষেই সংসার করা খুব কষ্টের। আমার নানু একটা কথা বলে, ‘শুধু ভাত কাপড়ের জন্য কেউ সংসার করে না, প্রেম ভালোবাসা যদি না থাকে সেটাকে সংসার বলে না।’ এক পক্ষ বুঝবে আরেক পক্ষ বুঝবে না, এতে সংসার করা যায় হয়তো, কিন্তু তা হয় পাহাড়সম বোঝার মতো। মানুষ তখন তৃতীয় ব্যক্তিতে সুখ খুঁজতে চায়, মনের আবেগ কোনোভাবেই আটকে রাখা যায় না। তখনই পরকীয়া সম্পর্কের উদ্ভব ঘটে। তাই যুগের পর যুগ আপনি যত জঘন্য বলেন না কেন পরকীয়া টিকে আছে এই সমাজে।

পরকীয়ার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে সংসারের এই অসমতা। আমি আবারও বলছি যাদের চারিত্রিক সমস্যা তাদের কথা এখানে বলছি না। বলছি যারা সংসারে সুখি না, তাদের কথা।

পরকীয়াতে নাক সিটকানোর আগে, ডিভোর্সির উপর আঙুল তোলার আগে নিজের পরিবারে মনোযোগ হোন, নিজের কাছের মানুষটিকে বুঝতে শিখুন। তার নিশ্বাস নেয়ার জন্য জায়গা তৈরি করুন।

আর যদি কোনোভাবেই সমাধান না হয়, একসাথে ঘরকে দোজখ বানানোর চেয়ে আলাদা আলাদা অন্তত ভালো থাকতে দিন অপরকে। প্রতিদিন বাবা-মাকে লড়তে দেখলে সন্তানের মানসিক বিকাশও ভালো হয় না। ওদেরও বুঝতে দিন অনেক সময় দুজন ভালো মানুষও এক সাথে থাকতে নাই পারে। এটা কোনো অপরাধ বা খারাপ বিষয় না। তখন তাদের মধ্যেও হীনমন্যতা কাজ করবে না। ডিভোর্সি বাবা মায়ের বাচ্চাদেরও অন্য বাচ্চাদের মতো স্বাভাবিক জীবন প্রাপ্য। অযথা বিতর্ক তৈরি করে তাদের জীবন বিষিয়ে দেয়ার অধিকার কারো নেই। একদিন হয়তো সেটা বুঝবে এই সমাজ।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *