May 16, 2024
নারী'র খবরবিদেশফিচার ৩

অপহরণ ও ধর্ষণ যখন প্রথা : চলছে কিরগিজ নারীদের লড়াই

কিরগিজ নারীদের নিয়ে এই ফিচার রিপোর্টটি প্রকাশ করে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা গত ৩০ আগষ্ট ২০২১ এ। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য এটি  বাংলায় অনুবাদ করেছেন কারিন আশরাফ ।।

প্রতিবছর কিরগিজস্তানে অন্তত ১২ হাজার নারীকে অপহরণ ও জোরপূর্বক বিয়ে করা হয়। মধ্যযুগীয় এ প্রথা নির্মূলে চাপ বাড়ছে।

আইসুলুলু ফিরছিল চাচির বাড়ি আত বাশি গ্রাম থেকে। সে জানায়, “শনিবার বিকেল ৫টার মতো বাজছিল। আমার সঙ্গে কাগজের প্যাকেটে সামসা ছিল। আমার চাচি সপ্তাহান্তে সবসময় সামসা তৈরি করতেন।”

“আমার উল্টোপাশে একটা গাড়ি আসে, ভেতরে চারজন লোক। হঠাৎ গাড়িটা ঘুরে আমার পাশে এসে থামে। পেছনে বসা একটা লোক বের হয়ে টেনে আমাকে গাড়িতে ঢুকিয়ে ফেলে। আমার হাতের সামসাগুলো পড়ে যায়। আমি চিৎকার করি, কাঁদি, ছটফট করি। কিন্তু কিছুই করার থাকে না।”

যে লোকটি তাকে অপহরণ করে, সেই পরবর্তীতে আইসুলুলুকে বিয়ে করে। বিয়ের সময় সে জানতে পারে যে, তাকে অপহরণ করার উদ্দেশ্য লোকগুলোর ছিল না। কিন্তু বিয়ের কনে নিয়ে ফেরার তাড়া থাকায় যাকেই প্রথম পছন্দ হয়েছে তাকেই তুলে আনার সিদ্ধান্ত নেয় লোকটি।

১৯৯৬ সালের ঘটনা এটি, তখন আইসুলুলু একজন কিশোরী। আজও সে তার স্বামীর ঘর করছে এবং তার চারটি সন্তান রয়েছে।

আলা কাচু (নাও ও পালাও) নামে পরিচিত ঘৃণ্য এই প্রথাটির মধ্যযুগীয় ইতিহাস থাকলেও আজও এর প্রচলন দেখা যায় মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে। কিরগিজস্তানে কয়েক দশক ধরে এটি নিষিদ্ধ এবং ২০১৩ তে আইনটিকে আরো কঠোর করা হয়। কোনো নারীকে অপহরণ করে জোরপূর্বক বিয়ে করলে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের ব্যবস্থা রয়েছে।

নতুন আইন থাকা সত্ত্বেও এই প্রথা বিলোপ হয়নি। তাছাড়া খুব কম সময়ই অপরাধীরা সাজা পেয়ে থাকে। মানবাধিকার সংস্থা রেস্টলেস বিইংস বলছে: “এটা বলার মতো একটা উন্নতি। আগে আলা কাচুর শাস্তির থেকে গবাদিপশু চুরির শাস্তি ছিল বেশি কঠোর।”

 

একটি কিরগিজ প্রবাদ প্রচলিত আছে যে,”সুখী বিয়ে কান্নার মাধ্যমে শুরু হয়।” এই অশ্রু হলো আলা কাচু কনেদের রাগ ও ভয়ের।

মধ্য এশিয়ার সব দেশেই এই প্রথাটি প্রচলিত, তবে সোভিয়েত-পরবর্তী কিরগিজস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এটি বেশি দেখা যায়। সোভিয়েত আমলে এই প্রথাটি সচরাচর দেখা যেত না, বাবা মা বিয়ের ব্যবস্থা করতেন।

কিরগিজস্তানের উইমেন সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর অন্তত ১২০০০ বিয়ে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়ে থাকে। (২০১১ সালের রিপোর্ট থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ধারণা করা হয় প্রকৃত সংখ্যাটি আরো বেশি)। পুরুষরা নিজেদের পৌরুষ প্রমাণ করার জন্য নারীদের অপহরণ করে, যাতে সময় আর টাকা বাঁচে।

কখনো কখনো আলা কাচু সম্মতিসূচক হয়ে থাকতে পারে। তখন কনেকে হবু স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ‘জুলুক’ (সাদা একটি শাল যা নতুন পরিবারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের প্রতীক) পরানো হয়। ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে অপহৃত নারীরা নিজের ভাগ্যকে মেনে নেয়।

ইউনিসেফ এর তথ্যানুযায়ী, কিরগিজস্তানে ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের গর্ভধারণের হার বেশি৷ আর অবৈধ হওয়ার পরেও ১৩% বিয়ে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই সম্পন্ন হয়।

অনুমান করা হয় ২০০০ নারী প্রতি বছর তাদের হবু স্বামীর কাছে ধর্ষিত হয়। এই ‘কলঙ্কের’ কারণে নারীরা তাদের পরিবারের কাছে ফিরতে পারে না।

সাতাশ বছর বয়সী আইজাদা কানাতবেকোভা এমন একজন কনে ছিল। এ বছরের এপ্রিলে তাকে মৃত অবস্থায় একটি ক্ষেতে পাওয়া যায়। তার দুইদিন আগে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র বিশকেকে তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এতে বোঝা যায় এই প্রথাটি শুধুই গ্রামাঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়।

আলতিন কাপালোভা একজন লেখক, নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট এবং সেন্ট্রাল এশিয়া বিশকেক এর গবেষক। তিনি নারীদের আইনি নিরাপত্তার অভাবকে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “নারীদের জন্য পুলিশ স্টেশন সাহায্য চাওয়ার জন্য নিরাপদ নয়। কোনো মহিলা অপহরণের অভিযোগ করতে পুলিশের কাছে গেলে তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করা হয়, বলা হয় যে এসব পুলিশের ব্যাপার নয়, আর বলা হয় বাড়ি গিয়ে পরিবারের সাথে এসবের মীমাংসা করতে।”

২০১৮ সালে এক জঘন্য ঘটনা প্রশাসনের গাফিলতিকে উন্মুক্ত করে দেয় প্রকাশ্যে। ২০ বছর বয়সী মেডিকেল শিক্ষার্থী বুরুলাই তুরদালি কিজিকে তার অপহরণকারী পুলিশ স্টেশনেই হত্যা করে। সে মেয়েটিকে ছুরিকাঘাত করে আর তার দেহে মেয়েটির নামের আদ্যক্ষর ও অন্য এক পুরুষ, যাকে মেয়েটির বিয়ে করার কথা ছিল, তার আদ্যক্ষর খোদাই করে দেয়।

এই আসামীকে হত্যার দায়ে বিশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, নারীর বিরুদ্ধে ঘটা বেশিরভাগ সহিংসতার ঘটনাই এড়িয়ে যায় ন্যায়বিচারের চোখ। কাপালোভা বলেন, “সমস্যাটি নিহিত আছে সংস্কৃতি আর শিক্ষায়, আইনে নয়।” ২০১৯ সালে কিরগিজস্তানের প্রথম নারীবাদী প্রদর্শনীর আয়োজনে অংশগ্রহণ করার পর থেকে কাপালোভা নিয়মিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছ থেকে হুমকি পেয়ে আসছেন। ‘ফেমিনালে’ নামের এই বহুল বিতর্কিত শোটি উগ্র জাতীয়বাদীদের রোষের মুখে পড়ে। তারা ১৭ দিন টানা কিরগিজ জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিক্ষোভ করে।

তাতিয়ানা জেলেনস্কায়াও এমন একজন শিল্পী যিনি আশা করেন মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে। তিনি ওপেন লাইন ফাউন্ডেশন নামের মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী। এই সংস্থাটি অপহৃত কনেদের আইনি সহায়তা ও কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করে থাকে। জেলেনস্কায়া ‘স্প্রিং ইন বিশকেক’ নামের একটি মোবাইল গেমের গ্রাফিক তৈরি করেছেন। এই গেমটি তরুণদের বোঝাতে চায় যে অপহরণ একটি অপরাধ, ঐতিহ্য নয়।

মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই অ্যাপটি ১৩০,০০০ বারের বেশি ডাউনলোড করা হয়েছে। গেমটিতে প্লেয়ারের বন্ধুকে অপহরণ করা হয়, এবং গেমের মিশন হলো তাকে যেকোনো উপায়ে উদ্ধার করা। গেমটিতে মনোবিজ্ঞানী, সাংবাদিক এবং অ্যাক্টিভিস্টদের তৈরি করা বিভিন্ন বার্তা ও পরামর্শ দেখানো হয়৷ সাথে সাথে সত্যিকারের ইমার্জেন্সি ফোন নম্বরগুলোর সাথেও পরিচিত করানো হয়।

জেলেনস্কায়া বলেন, “আমরা মেয়েদের বোঝাতে চাই যে, তারা নিজেরাই তাদের ভাগ্য গড়ে তুলতে পারে। তাই আমরা তাদের বিদ্রোহ ও পরিবর্তন আনার যোগ্য করে গড়ে তুলতে কাজ করছি।”

তিনি আরো বলেন,”যে প্রজন্মের নারীরা বেড়ে উঠেছে এই ধারণা নিয়ে যে, পুরুষের অনুমোদন ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়, তাদের পক্ষে এই বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন।”

কিরগিজ সরকার এসব প্রচেষ্টায় খুব সামান্যই সমর্থন জানিয়েছে। অনেকের মতে, নতুন সংবিধানের শব্দচয়ন নির্দেশ করে যে, প্রথাগত মূল্যবোধের সাথে সংঘর্ষে মানবাধিকার আর মৌলিক স্বাধীনতা গৌণ। সংবিধানের প্রস্তাবনায় কিরগিজ সমাজের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকের মতে, এই সংবিধান আলা কাচুর বৈধতায় মৌনসম্মতি দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *