November 1, 2024
মুক্তমত

নারীর প্রতি সহিংসতা- ছড়িয়ে পড়া এক মহামারী

রায়হানা রহমান ।। খুব সম্প্রতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন এক ব্যক্তি বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেত্রী এবং তার নাতনীর প্রতি অত্যন্ত অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে বিতর্কিত হয়েছেন। সর্বক্ষেত্রে যখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তার এই বক্তব্য বা আচরণ, তখন সরকারের তরফ থেকে বলা হলো এটা কোনো দল বা সরকারী বক্তব্য নয়, একান্তই তার ব্যক্তিগত বক্তব্য। যদিও শেষ অব্দি প্রধানমন্ত্রী তাকে দ্রুত পদত্যাগের নির্দেশ দিলেন, এটি আশাব্যঞ্জক ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক বিরোধীতা কেন ব্যক্তিগত আক্রোশে পরিণত হয়? কেন একজন নারীকেই এ ধরণের আক্রমণের শিকার হতে হয়! উত্তরটা সহজ – কারণ সে নারী। খুব সহজেই যাকে অপমান, অপদস্ত আর ভেঙে ফেলা যায় বলে অধিকাংশ পুরুষের ধারণা।

সামাজিকভাবেও নারীকে প্রতিনিয়ত সহিংস আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। খুব সম্প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য গণপরিবহণের ভাড়ায় হাফ পাসের দাবিতে আন্দোলন করছে ছাত্র সমাজ। কিন্তু সেই আন্দোলনের খারাপ ফলটা ভোগ করতে হয় নারীকেই। বাসে কোন ছাত্রীকে একা পেলে মুহূর্তেই ধর্ষণের হুমকি দিয়ে বসে বাসের হেলপার। আবার কখনো শারীরিকভাবেও হেনস্থার শিকার হতে হয়। শুধু এখনই নয়। এ ধরণের বৈষম্য বা হেনস্থার ঘটনা দিনের পর দিন ধরে চলে আসছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য আমি সবসময়ই বাসে যাতায়াত করি। অফিসের সময়ে বাসের পিকআপ পয়েন্টগুলোতে অসম্ভব ভিড় থাকে। সেখানে পুরুষের সংখ্যাই বেশি থাকে। যখন বাসগুলো থামে যাত্রী নেওয়ার জন্য তখন শুধু পুরুষ যাত্রীটিকেই নিতে চায়, মহিলা নেবে না বলে। এটা আমার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। সেক্ষেত্রে আমাকে প্রচন্ড গলাবাজি করে বাসে চড়তে হয়। বাসে ওঠার পরও শন্তি নেই। আমাদের মহা পরাক্রমশালী পুরুষেরা ধরেই নেয় বাসে যাতায়াত করা মেয়েদের শরীরে হাত দেয়াটা তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এ সামাজিক ব্যধির বিরুদ্ধে নারীরা যুগ যুগ ধরেই যুদ্ধ করে আসছে। প্রতিবাদ করতে গেলে- পাবলিক বাসে এমন একটু আধটু হতেই পারে- এমন মন্তব্যও শুনতে হয়।

এই কিছুদিন আগেই, এক জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলের জনপ্রিয় সাংবাদিক ধর্ষণ ও ভ্রুণ নষ্টের অভিযোগে মামলা খেলেন। কিন্তু তাতে তার কী এলো গেলো বোঝা না গেলেও তার বর্তমান স্ত্রীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাসিন্দারা কমেন্টে কমেন্টে জর্জরিত করেছেন। একইভাবে, যিনি অভিযোগ করেছিলেন সেই নারীটিকেও একই কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছেন সকলে। এ ধরণের ইস্যুগুলোতে দেশের আপামর পুরুষ সমাজ অভিযোগকারী নারীটিকেই নানাভাবে হেয় করার জন্য তাদের বিবেককে সদা জাগ্রত রাখে, যাকে আমরা ভিকটিম ব্লেমিং বলে জানি।

সম্প্রতি দেশের ১৩টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য অনুসারে, এ বছরের প্রথম ১০ মাসে ৩,১২৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা নির্যাতনে শিকার হয়েছে। এরকম পরিসংখ্যান শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের আরো বেশ কয়েকটি দেশেই নারীর প্রতি এ ধরণের সহিংস আচরণ করা হয়। মেক্সিকোতে প্রতিদিন প্রায় ১০ জন নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩৪৫ জন নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার। জাতিসংঘের আঞ্চলিক কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ২০২০ সালে কমপক্ষে ৪ হাজার ৯১ জন নারী জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন। জাতিসংঘের লৈঙ্গিক সমতাবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন শারীরিক কিংবা যৌন সহিংসতার শিকার হন।

অনলাইনে নারী হয়রানির সংখ্যাটাও কম নয়। দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কয়েক কোটি। আর স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার ৫৩ শতাংশই নারী। ফেসবুক মেসেঞ্জারে অশ্লীল মেসেজ, ছবি পাঠানোসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হয় নারীরা। যদিও বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সুফল অনেকেই পেয়েছেন।

কর্মক্ষেত্রেও নানাভাবে নারীরা প্রতিনিয়তই সহিংস আচরণ ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। প্রতিবাদ করলেই কখনো কখনো বাধ্যতামূলক চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। ব্যবসায়ী নারীর পথ চলাটাও মসৃণ নয়। আমার পরিচিত কয়েকজন নারী ব্যবসায়ীর অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, শুধু নারী বলেই খারাপ পণ্য বা সময়মতো ডেলিভারি না দেওয়া আবার কখনো কখনো অশ্লীল মন্তব্যও শুনতে হয় তাদের।

আর ঘরের কথা নাই বা বললাম- কর্মজীবী নারীর একই সাথে কাজ আর সংসার, সন্তান সামলানো বিশাল এক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিদিনের লড়াই যার শুরু আছে, শেষ কবে তা জানা নেই।

নারীর প্রতি সহিংস আচরণ উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু – এ যেন এক মহামারির আকার ধারণ করছে ধীরে ধীরে। এই মনোভাব কবে পরিবর্তন হবে জানা নেই। শুধু জানি এ কণ্টকাপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা এক অজানা পথে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *