May 15, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সব রক্ষার দায় নারীর পোশাকের

আফরোজ ন্যান্সি ।। নরসিংদীর ঘটনার ভিডিও ক্লিপটিতে আমরা সবাই দেখেছি কিভাবে এই মার্জিয়া শিলা নামক বয়স্ক মহিলাটি টেনে হিঁচড়ে ওই মেয়েটির জামা খুলে নিতে চাচ্ছিল, পাশাপাশি অকথ্য ভাষায় গালাগালিও করছিল। মেয়েটি কোনোমতে পালিয়ে স্টেশন মাস্টারের রুমে গিয়ে আশ্রয় না নিলে ওই মহিলা হয়তো এতগুলো লোকের সামনেই মেয়েটির জামা টেনে খুলে নিতো। আজ মার্জিয়া শিলাকে উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়া হয়েছে। এই মামলার শুনানিতে আসামীপক্ষের আইনজীবী কামাল হোসেন বলেন, ‘মায়ের বয়সী একজন নারী যে প্রতিবাদ করেছে এটা কোনোভাবেই নারী শিশু নির্যাতন আইনের ১০ ধারায় যায় না। কেননা ১০ ধারায় বলা আছে, যৌন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে যদি কোনো নারীকে হেনস্তা করা হয়। ৬০ বছর বয়সী একজন নারীর পক্ষে কীভাবে ২২ বছর বয়সী মেয়েকে যৌন হেনস্তা করা হয়েছে এটা বোধগম্য নয়।’

আমরা সবাই জানি, নারীর প্রতি যতরকম সহিংসতা হয়ে আসছে তার মধ্যে পোশাক কেন্দ্রীক সহিংসতা তুলনামূলক প্রাচীন। অথচ উক্ত আইনজীবী কিনা বুঝতেই পারছেন না, এই ঘটনায় কিভাবে অপরাধ সংঘটিত হলো? হাইকোর্টের ভাষ্যমতে সভ্য দেশে কোনো মেয়ে এমন পোশাক পরে বেরোতে পারে না। তবে কি সভ্য দেশে কারো ব্যক্তিগত পছন্দ না মিললেই অপরপক্ষের পোশাক টেনে খুলে নেওয়া যায়? প্রকাশ্যে অন্যের পোশাক ধরে টানাটানি করাই কি তবে সভ্যতা?

যেকোনো যুদ্ধ- সংঘাত কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করতে সবার প্রথম টার্গেটই হয় প্রতিপক্ষের নারী সদস্যটি। নারীটিকে ধর্ষণ করতে পারা কিংবা তার পোশাক খুলে তাকে নগ্ন করে ফেলতে পারলেই যেন বিনাযুদ্ধে হারিয়ে দেওয়া যায় প্রতিপক্ষকে। এমনকি যুদ্ধজয়ের পরেও প্রতিপক্ষের নারীরা দখলযোগ্য এবং ভোগযোগ্য পণ্য হিসেবে বিবেচ্য। পুরানে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণই হোক আর আজকের এই নরসিংদীর ঘটনাই হোক, নারীর পোশাক টেনে খুলে নেওয়ার মতো সহিংসতা প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে। আমাদের মতোন ভঙ্গুর বিচারব্যবস্থাপ্রবণ দেশে এমন ঘটনা আরো বেশি পরিমানে ঘটে। আপনারা হয়তো মনে করতে পারেন, পহেলা বৈশাখে শাড়ি পরে বেড়াতে যাওয়ার ফলস্বরূপ একজন নারীর শরীর থেকে শাড়ি টেনে খুলে নিয়েছিল বর্বরেরা। আরো মনে করতে পারেন নোয়াখালিতে প্রতিবেশীর দ্বন্দের ফলস্বরূপ একজন বয়স্ক নারীকে নগ্ন করে তার ভিডিও করে ভাইরাল করে দেওয়া হয়েছিলো। আরো মনে করতে পারেন, ভাই ভাই এর জমি নিয়ে দ্বন্দের একপর্যায়ে ভাসুর এসে ছোট ভাই এর বৌ এর শাড়ি টেনে খুলে তাকে নগ্ন করে পিটিয়েছিল। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক মেয়ের কামিজের পিঠের অংশ ছিড়ে নিয়ে চলে গেছে মোটরসাইকেল আরোহী। এদেশের ঘরে, রাস্তায়, রেলস্টেশনে, মেলায়, বাজারে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে এসব সহিংসতা। অথচ একটা সভ্য দেশের আইনজীবী যখন বুঝতেই পারেন না এমন একটা ঘটনা যৌন হয়রানির আওতায় পরে কিনা তখন আমরা আসলে কাকে দোষারোপ করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। ঘাপলাটা আসলে কোথায়? আইনে, নাকি প্রচলিত মূল্যবোধে? যৌন হয়রানির যে আইন আছে সেখানে কোনো ক্রাইটেরিয়া করে দেয়া নেই যে ঠিক কী কী বিষয় যৌন হয়রানির আওতায় পরবে। আবার সামাজিক এবং ধর্মীয় মুল্যবোধের মধ্যেও আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান করার বিষয়টা ঠিক শিখে উঠতে পারিনি।

আর তাই শাড়ি পরে নারী নিরাপদ না, জিন্স-টপ পরে নারী নিরাপদ না, এমনকি নারী নিরাপদ না বোরখা পরলেও। এবার ইদের ছুটিতেই সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখতে পেলাম, বোরখা পরা এক নারী ট্রেনের ছাদ থেকে নামার সময় ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানো এক নরপশু প্রকাশ্যে নারীটির স্তনে হাত দিলো এবং দিয়েই রাখলো যতক্ষণ না নারীটি ওর হাতের নাগালের বাইরে যেতে পারে। আমি জানি না আমাদের দেশের মহামান্য আদালত এই বিষয়টিতে কী রায় দিতেন? তবে এদেশের আপামর মানুষ ভিক্টিম ব্লেইমিং করতে সব থেকে পটু। আর ভিক্টিম যদি নারী হয়, তাকে ব্লেইম করাটা আরো বেশি মজাদার। মেয়েটা কেন ওরম পোশাক পরলো, মেয়েটা কেন এতো রাতে বাইরে গেল, মেয়েটা কেন ভিড়ের বাসে উঠলো, মেয়েটা কেন কপালে টিপ দিলো, মেয়েটা কেন ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রাচীনকালে কিছু কিছু রাজা কিংবা সমাজপতি ঠিক করে দিতো সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা বুক ঢাকা কাপড় পরবে আর নিম্নজাত বর্নের নারীরা বুক উন্মুক্ত রাখবে। সেই মুদ্রারই অপর পিঠে এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি – ধর্মগুরু এবং সমাজপতিরা মিলে ঠিক করে দিচ্ছেন নারীরা আপাদমস্তক ঢেকে চলবে নাকি মুখ খোলা রাখতে পারবে নাকি শুধু চোখ খোলা রাখতে পারবে। এই নিয়ে আবার গোত্রে গোত্রে ব্যাপক তর্কাতর্কি। আর এদের অনুসারীরাই রাস্তাঘাটে ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে নগ্ন করে দিতে চাইছে। সভ্যতা, ধর্ম, সমাজরক্ষা, পরিবারের সম্মানরক্ষা সব দায় গিয়ে পরলো কিনা একা নারীর পোশাক আর আচরণের উপর! যদি তাই হয় তবে নারীকেই নির্ধারন করতে দিন, সে কি পরে তার সভ্যতা, ধর্ম, সমাজ আর পরিবার রক্ষা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যেহেতু সবরক্ষার দায় নারীর হাতেই আছে, নারীই তবে ঠিক করুক কিভাবে রক্ষা করবে এসব। আপনারা দয়া করে নারীর পোশাক নিয়ে দালালীটা এবার বন্ধ করুন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *