April 29, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

যে ট্যাবু ভাঙা উচিত, যে গোপন কথা বলা দরকার, আমি সেগুলোই লিখি 

ক্যাথরিন এলিজাবেথ ক্যাটলিন মোরান, ব্রিটিশ নারীবাদী লেখক ও ব্রডকাস্ট সাংবাদিক। বড় হয়েছেন উলভারহ্যাম্পটনে, যেখানে তাঁর হোম-স্কুল ছিল। ১৫ বছর বয়সেই সাংবাদিক হয়ে ওঠেন, আর পরে তিনি হন দ্য টাইমস ম্যাগাজিনের একজন পুরস্কার বিজয়ী লেখক। তাঁর নন-ফিকশন স্মৃতিকথা ট্রিলজি ‘হাও টু বি আ উওম্যান’,  ‘হাও টু বিল্ড আ গার্ল’ ও ‘হাও টু বি ফেমাস’ আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার; ‘হাও টু বিল্ড আ গার্ল’ এর উপর একটি ফিচার ফিল্মও তৈরি হয়েছে।

ক্যাটলিন মোরানের এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিল দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা, ২০১৮ সালে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন পূরবী চৌধুরী ।।

আপনার তৃতীয় বই যেটির শিরোনামও “হাউ টু” মানে “কীভাবে” দিয়ে শুরু? কেন?

আমি প্রয়োজনীয় বই লিখতে পছন্দ করি। আমার স্কুলে যাওয়া হয়নি, আমি যা শিখেছি সব ছিল আমার পছন্দের বিষয়গুলো পড়ে পড়ে এবং সেটা ওলভারহ্যাম্পটনের ওয়ারস্টোনের লাইব্রেরি থেকে। “কীভাবে” শব্দটার টাইটেল দেখলেই আপনি সহজেই জানবেন আপনি আসলে বইটিতে কী পেতে যাচ্ছেন। ধরুন একটি বইয়ের নাম “ক্রাইং অফ ডলফিনস” অর্থাৎ “ডলফিনের কান্না”, বইটির শিরোনাম দেখলে যে কেউ এভাবে ভাববে যে বইটি কি আমার জন্য প্রাসঙ্গিক বা প্রয়োজনীয়? তেমনি আমার বইগুলোতে আমি সেই বিষয়গুলোই তুলে ধরি, যা কেউ তুলে ধরে না, এমন কিছু সামাজিক ধ্যানধারণা বা ট্যাবু যেগুলো ভাঙা দরকার, বা যে গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ্য হওয়া উচিত, আমি সেই বিষয়গুলো বুঝতে চেয়েছি। কোন সে জিনিসগুলো, যা নিয়ে কেউ কথা বলেনা বা বলতে ভয় পায়?

আপনার নতুন উপন্যাসটি একজন ক্ষমতাধর পুরুষের অল্পবয়সী নারীকে যৌনশোষণ করা নিয়ে সবাই এমনটাই বলছে।

হ্যাঁ, কল্পনা করুন প্রতিদিন আপনি টুইটারে যাচ্ছেন এবং ভাবছেন ‘‘ছিঃ, এটা বইটার আক্ষরিক প্লট!” দশ বছর ধরে আমারও এই ধারণাটা ছিল। যৌনতা বিষয়ক লজ্জার কারণে একটা টেপ এবং কিছু ভুল তথ্য খুব সহজেই জনপ্রিয় হয়ে গেল। যখন এমন নেতিবাচক ভয়ানক খবরটি আপনাকে নিয়ে হবে, তখন আপনি এটাকে কীভাবে মোকাবেলা করবেন? প্রতিশোধপরায়ণ পর্ন একজন কম বয়সী মহিলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। জোহানা বুঝতে পারে তার কথা বলা দরকার। সে বলেছে, এই লজ্জা আমার নয়, আপনাদের। এবং সেখান থেকে মি টু আন্দোলন বিশ্বব্যাপী চলছে এবং এটি কাজ করছে। এসব অসভ্য ইতরদের জেলে যাওয়া শুরু হয়েছে, পুরো কর্মক্ষেত্রের অবস্থাটা বদলাচ্ছে।

বোঝা যাচ্ছে জোহানার অবাধ্যতাই মি টু আন্দোলনকে একটা অবয়ব দিয়েছে।

বইটির যে বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো জোহানা অবাধ্য হতে পারতো না যদি না সে সুজানের সাথে দেখা করতো। বন্ধু সুজান তার চাইতে বয়সে বড়, সে জীবনে আরো নানাকিছু অতিক্রম করেছে এবং সে জোহানাকে একটা প্লাটফর্ম দিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বিষয়টি অনুপস্থিত, বিশেষ করে বিভিন্ন অ্যাক্টিভিজমের ক্ষেত্রে, তরুণদের এখানে ক্ষোভই বেশি দেখা যায়। আমি নারীদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং নারীবাদী পরামর্শদাতা বিষয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। অ্যাক্টিভিজমের ক্ষেত্রে আমাদের এটি বেশি প্রয়োজন। আমাদের আদিবাসীদের ভেতরে প্রবীণদের হত্যা বা উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখা যায়।

আপনার নারীবাদী পরামর্শদাতা কে?

আমি জার্মেইন গ্রিয়ারকে পছন্দ করতাম – স্পষ্টতই তার এখন নানা সমস্যা দেখতে পাই, কিন্তু তিনি ভয় পাননি এবং আমিও ভয় পাওয়ার কথা কখনো কল্পনায়ও আনতে পারিনি। এছাড়াও আমার বয়স যখন ১৭ তখন কোর্টনি লাভ আমাকে তার সাথে কাজে নিয়েছিলেন- সুজানও সেখানে ছিলেন – আমি কয়েকবার তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম।

“রেইজড বাই উলভস” আপনার বাস্তব জীবনের উপর ভিত্তি করে। আপনি কি কখনও ভয় পেয়েছেন যে লেখার উপাদান শেষ হয়ে যাবে?

শারীরিকভাবে স্থুল, বুদ্ধিমতি এবং শ্রমজীবী শ্রেণির মেয়েরাও সব ঝাঁকিয়ে দিতে বা পরিবর্তন করতে পারে এবং সেসব রোল মডেল মেয়েগুলোকে আমরা এখনো পুরোটা পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি বলে মনে করি না। কিশোরী মেয়েরা একেকজন সাইফার যারা অনেক বিশ্লেষণের ক্ষমতা রাখে। এই যুগে বয়স্ক মহিলাদের নিয়ে কী সমস্যা হচ্ছে তারা সহজেই এটা বলে দেবে। এবং এসব কারণে দেখা যাচ্ছে ১০ জনের মধ্যে একজন মেয়েকে মানসিক স্বাস্থ্য সহযোগিতার জন্য পাঠানো হচ্ছে কারণ মেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক নারী হয়ে উঠবার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করছে।

আপনি কি মনে করেন বর্তমানের এই সময় একজন কিশোরী মেয়ের জন্য সবচাইতে খারাপ?

আমরা যখন কিশোরী ছিলাম তখনকার সময়টা অন্যরকম ছিল, এখন অনেক বিষয়ে অনেক চাপ তৈরি হয়েছে মেয়েদের উপর। তখন আমি কিশোরী ছিলাম যখন বার্লিন প্রাচীরের সমাপ্তি ঘটেছিল। আমরা সে সময় আনন্দ উপভোগ করেছিলাম, প্যাক-মেনের মতো নাইটক্লাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল সবকিছু ভালো হবে, উদারনীতির হবে, হুরর রে! কিন্তু বর্তমানে এসব কিছু উল্টে যেতে দেখছি, সম্পত্তি এবং চাকরির বাজার পরিবর্তিত হয়েছে, জাতীয়তাবাদ এবং জনতাবাদের উত্থান ঘটেছে। এর মূলে রয়েছে ইন্টারনেট যা নানা মতবিরোধ তৈরি করছে এবং এমন কোথাও নেই যেখানে আমরা আমাদের সমস্ত অগ্রগতি একসাথে দেখতে পাই।

সুতরাং আপনার বই একজন কিশোরী হবার উদযাপন, কিন্তু বর্তমানে বাস্তবতা বেশ ভয়ানক?

বর্তমানের এই কিশোরী-কিশোরীদের ফ্যানডম এবং যৌনতা বিষয়ক ইতিবাচক তথ্যগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা বেশ গুরুত্বপুর্ণ যার সবকিছুই এই বইতে রয়েছে। আপনি যদি শুধু সৌন্দর্য আর ভাল ভাল ভাবনা নিয়েই থাকেন তাহলে এই বিষয়গুলো আপনার কাছে পৌঁছানো কঠিন। আনন্দ কেবল বিলাসিতার বিষয় নয়, বরং আনন্দ হলো যখন আপনি সমস্যাগুলোর সমাধান করবেন। সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক খারাপ দিক রয়েছে, একটু খেয়াল করলে দেখা যায় এখানে কিশোরীরা অনেক পর্ন সাইট অনুসরণ করছে, এবং ফলো করা অ্যাকাউন্টগুলোও এই মেধাবী কিশোরীদের তাদের নানা কাজে ব্যবহার করছে, তাদের নানা জালে আটকে ফেলছে। এই সাইটগুলো যেন তাদের লোক খুঁজে পেয়েছে। ইন্টারনেট এমন একটা মাধ্যম যা আপনার মতো করেই আপনার সামনে হাজির হবে। আমার বাচ্চারা স্কুলে কঠোর পরিশ্রম করে কিন্তু তবু আমি তাদেরকে বলি যে আসো মুভি দেখো, বাইরে হাঁটতে যাও, লেকের পাশে দৌড়াও কারণ এগুলো জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কারণ শুধুমাত্র স্কুল এবং ইনস্টাগ্রামই জীবন নয়।

আপনি একবার বলেছিলেন লেখা শুরুর আগে আপনি লোভী হয়ে যান, আপনার নাকি লালা ঝরে! আপনি কি বিশেষ কিছু করেন কোনো লেখা শেষ করার পর?

হ্যাঁ, আমি শুধু লোভীই হই না, আমি তখন আমার নিপলে সুরসুরি অনুভব করি ও হাঁটুতে উষ্ণতা টের পাই। আমার ল্যাপটপ আমার খেলার মাঠ, আমি সেখানে ডেভিড বেকহ্যামের মতো। আমি আমার কাজ সময়মতো শেষ করি, একবারে বাচ্চারা স্কুল থেকে বাসায় ফেরার আগের মুহূর্ত হলেও। আমি যদি প্রচুর ধুমপানও করি, তাহলেও আমি দ্রুত স্নান করে নিই যাতে ধোঁয়ার গন্ধ না থাকে।

এরপর আপনার কোন বইটি আসছে?

“হাও টু বি আ ওম্যান” এর সিক্যুয়াল। আমি ট্র্যান্স অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গের ইস্যু, যত্ন, মানসিক অসুস্থতা, উদ্বেগ এবং বার্ধক্য নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছি এবং আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে খুব উত্তেজিত।

 “হাও টু বি বিল্ড আ গার্ল”- এর চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ কেমন চলছে?

চলচ্চিত্র নির্মাণ একটা বড় ধরনের ঝগড়া করার মতো মনে হয়। যখন আপনি একটা স্ক্রিপ্ট লিখছেন এবং বাসে মাতাল হয়ে যাওয়া নিয়ে লিখছেন, তখন আপনাকে এর জন্য বাসের ভেতরে কিছু খারাপ লোককে খুঁজতে হবে, রাস্তা পরিষ্কার করতে হবে, অভিনেতাদের খুঁজতে হবে- এটা একটা হু-হা। এটা কিন্তু সত্যি মর্মান্তিক। কিন্তু এটা ম্যাজিকের মতোও।

এখন কোন বইটি পড়ছেন যা আপনার বেড সাইডে রাখা?

আমি ক্যারেন আমস্ট্রং -এর “হিস্ট্রি অফ গড” পড়ছি । আমি কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করছি যার কারণে আমাকে ঈশ্বরের উৎপত্তি বিষয়ে পড়তে হচ্ছে। কেন আমরা এই লোককে উদ্ভাবন করেছিলাম? এবং এখন তার প্রাসঙ্গিকতা কী?

এমন কোনো লেখক কি আছেন যার কাছে আপনি বারবার ফিরে আসেন?

আমি প্রতি বছর আদ্রিয়ান মোল-এর “দ্যা সিক্রেট ডায়রি” পুনরায় পড়ি। এটি অসাধারণ। এটি এমন বিষয় যা আপনি প্রায়ই নারী লেখকদের মধ্যে দেখতে পাবেন – নিনা স্টিবের যেমন, হালকা, উজ্জ্বল, ফেনায় ঢাকা এবং অবিশ্বাস্যরকম কঠিন। এটি অনেকটা এমন যেন কউ রুটি বানাচ্ছে কিন্তু ময়দাকে দীর্ঘ সময় নিয়ে গুড়া করতে হচ্ছে যাতে হালকা পালকের মতো মনে হয়। সিরিয়াস বা কষ্টের বই তো যে কেউ লিখতে পারেন!

আপনার বুকশেল্ফে কোন বইটি খুঁজে পেয়ে লোকজন অবাক হতে পারে?

আমার একটি অভিধান আছে যেটা দেখে তারা অবাক হতে পারে, কারণ তারা জানে না বানানে আমি কত খারাপ! আমি এখনো ব্যাকরণ বা বানান সম্পর্কে সত্যি কিছু জানিনা।

এবং বাচ্চারা আজকাল স্কুলে ব্যাকরণে বেশ ভালো।

এটা আমার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে। আমার কিছু জিনিস ওরা জিসিএসই এবং এ-লেভেলে পাঠ্য হিসেবে যুক্ত করেছে, তাই এখন বাচ্চারা আমাকে বলে “আমরা আজ তোমাকে বিশ্লেষণ করছি, কেন তুমি সেখানে পাস্ট পারটিসিপল ব্যবহার করেছিলে? এবং আমার কাছে আক্ষরিক অর্থেই বলার মতো কিছু ছিলনা। আমি পড়ে পড়ে লিখতে শিখেছি। আমি আমার বাচ্চাদের সবসময় বলি যে এই বাড়িতে সম্ভবত এমন অনেক কিছু আছে যা স্কুলের শেখা জিনিসগুলোর চাইতে বেশি শেখা বা কাজে লাগার মতো।

তারা কি আপনার কাজের ভক্ত?

না! হস্তমৈথুন সম্পর্কে মায়ের লেখা কে পড়তে চায়? আমরা একটা খেলা খেলেছিলাম, যেটা ছিল ইস্টার ডিম শিকার করা যার একটা সূত্র আমার বইয়ের ভেতর লুকানো ছিল কিন্তু বাচ্চারা বইটি খুলতে অস্বীকার করেছিল। বিষ্ঠা! তারা বলেছিল – “লোমশ কিছু নিয়ে পড়তে চাই না!”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *