May 19, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীর চরিত্র বিচার আর ভিক্টিম ব্লেইমিংয়ের দেশ

মাহজুবা তাজরি।। চারিত্রিক বিশ্লেষণের লক্ষবস্তু সম্পর্কে একটু পর্যাচলোনা করলে নারী পুরুষের বিভেদটা কোথা থেকে যেন চলে আসে। উল্লেখ্য যে,  চারিত্রিক বিশ্লেষণ  নারী পুরুষ ভেদে ভিন্নভাবে কাজ করে। নারীর চরিত্র হতে হবে একটা এমন যেন তার চরিত্র দ্বারা জীব এবং পরজীবীরা জীবন যাপন করতে পারে। কিংবা নারী চরিত্র “ভালো” বলে বিবেচনা করতে গেলে তার শারীরিক ত্রুটি, মানসিক ত্রুটি, সামাজিক ত্রুটি থাকা যাবে না। সে একজন কর্মজীবী নারী? কিন্তু তবুও তাকে ভালো গৃহিনী হতে হবে। সে একজন অভিনেত্রী? তাকে ভালো স্ত্রী হতে হবে। সে একজন লেখিকা? তাকে ফুল টাইম মায়ের দায়িত্ব পালন করতে হবে। মায়ের দায়িত্বকে ছোটো করে দেখানোর উদ্দেশ্যে নয়। তার কাজটা তার মূল প্রায়োরিটি না। তার সন্তান লালন পালন থেকে শুরু করে বাড়ির আনাচ কানাচের ধুলো জমা কাচের খবরেও সর্বদা তটস্থ থাকা চাই।

আজ কোয়েল মল্লিকের ছবি দিয়ে এক ব্যক্তি একটি লেখা পোস্ট করেছেন। কোয়েল মল্লিকও একজন নায়িকা, কোনো পরকিয়ার সম্পর্ক নেই। তিনি তার কোনো ছবিতে চুম্বনের দৃশ্য স্থাপন করেন নি। রাজনীতিতে জড়ান নি। তবুও তিনি টলি কুইন। তার মানে তিনি কোন গল্পে কাজ করেছেন, তিনি অভিনেত্রী হিসেবে কেমন, তিনি একজন অর্থনৈতিকভাবে সফল নারী সেটা বিবেচনা করার আগে তাকে নিয়ে আসতে হবে তিনি নায়িকা হয়ে চুম্বনের দৃশ্য স্থাপন করেননি। এই কারণে তিনি একজন সৎ এবং চরিত্রবান নারী।

তার মানে কি এই দাঁড়ায়? পরকিয়া, চুম্বন দৃশ্য, রাজনীতিতে জড়ানো একটা আপোষ করার পথ? অনেকেই চলচ্চিত্রের গল্পের খাতিরে এর বেশি কিছুও হয়তো করেছেন। তার মানে কি তারা চরিত্রহীন? এটা কি আদৌ বিচারের মানদণ্ড হওয়ার কথা? একজন শিল্পীকে তার শৈল্পিক কাজ দিয়ে বিবেচনা না করে কি তার ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী-স্ত্রী সংসার নিয়ে কেমন আছেন,  কে কয়টা বিয়ে করেছে বা কার সাথে কার সম্পর্ক এই ধরণের বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করে বিচার করাতে কোন স্বার্থদ্ধার হলো সেটাই একটা রহস্য।

এই একবিংশ শতাব্দীতে সবাই সবার সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারা আরো বিরাট এক অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এখানে অন্যায়কে জাস্টিফাই করা, অন্যায়কে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া এই সবই যেন একটা সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটিয়েছে। এই সময়ে জনপ্রিয় ইউটিউবাররা যারা মানুষকে বডি শেমিং, ব্যক্তিগত জীবন শেমিং,  স্লাট শেমিং করতে যারা ব্যস্ত, তারা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় রূপ ধারণ করেছে। মিলিয়ন বিলিয়ন ভিউ সেই সব চ্যানেলে যেসব চ্যানেলে সেলিব্রিটি গসিপ দেয়া হয়৷

অনলাইন বুলিং বা সাইবার বুলিং একদম আলাদা একটা বিভাগ।  যেটা লিখতে গেলে একটা নতুন অনুচ্ছেদ লেখা যায়।

এবারে পুরুষের চরিত্র বিশ্লেষণের পালা। পুরুষের চরিত্র বিশ্লেষণের প্রথম কথা হলো বাজারে আদর্শ পুরুষ কীভাবে হবেন এই বিষয়ে কোনো বই নাই। একজন পুরুষের কী কী ধরণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উন্নত করা উচিত এই বিষয়ে কোনো ভিডিও নাই। “পুরুষের রাগ বানায় তাদের বাদশা আর নারীর রাগ বানায় তাকে বেশ্যা” এই ধরণের প্রচলিত প্রবাদ তো আছেই। পরকিয়া পুরুষ করলে সেটা নানাভাবে বৈধ। টু শব্দটা করার মত কেউ নাই। কিন্তু একজন নারীর পরকিয়ার কথা প্রকাশ হওয়া মানে একটা হুলুস্থুল আয়োজন। সমাজ কী করে উচ্ছন্নে যাচ্ছে সেটা নিয়ে “বিশিষ্ট বিজ্ঞ গবেষক” পরিসংখ্যান বের করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। তখন এথিক্স মোরাল ডিগনিটি এই সকল ধরণের কথা সামনে আসতে দেখে মনে হয়, বাব্বাহ এত নীতিবান মানুষের দেশে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, শিশু ধর্ষন কী করে হয়?

আবারো উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি “ভিক্টিম ব্লেমিং” নামক কর্মসূচি জোরালো হয়েছে। এবং এই স্রোতে গা ভাসানো লোকের সংখ্যাটাও ভারি। একজন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলো, সাথে সাথে পোষাকের দোষ, চারিত্রিক বিশ্লেষণ টক শো এসবকে টেলিভিশনেও ব্রডকাস্ট করা থেকে পিছু পা হতে দেখা যায় না। যেখানে ধর্ষণ কোনোভাবেই কোনো কারণেই গ্রহনযোগ্য না। ধর্ষণ নির্মূল করতে মানুষের চিন্তাভাবনা যে পরিবর্তন করতে হবে সে বিষয়ে একদমই সাড়া দিতে নারাজ এই ”ভিক্টিম ব্লেমিং” কর্মসূচি। এই সব কার্যকলাপ যে পরবর্তী আরো কয়েক প্রজন্মকে যে ভয়াবহতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে সেটা নিয়ে ভাববে কে? সেই একবিংশ শতাব্দীতে সবাইকে সবাই রিচ করতে পারে সেই অংশে ফিরে যাই। একটা ভিক্টিমের দেয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিচারের আবেদনে কীভাবে মানুষ হাসাহাসি করতে পারে? কীভাবে ভিক্টিমকে তার সাথে হওয়া চরম অবমাননার পর তাকে নিয়ে বাজে কথা বলতে পারে? এটা কি শিক্ষার অভাব? এটা কি বিবেকের অভাব? নাকি এটা কঠিন কোনো মহামারী?

মানবাধিকার লঙ্ঘন কোনো গর্বের বিষয় হওয়ার কথা না। বরং মানবাধিকার লঙ্ঘন যেকোনো দেশের সবচেয়ে করুণ পরিনতির একটা। একটা মানবতার চরম বিপর্যয়কেও আমরা মাটি থেকে তুলে নিয়ে পরম আদরের সাথে যখন বুকে জড়িয়ে তাকে আরো উস্কানিমূলক নীতিনির্ধারনী মন্তব্যে অন্তর্ভুক্ত করছি তখন সেটা বাক স্বাধীনতা’র অংশ কী করে হয়? ব্যক্তিস্বাধীনতা কেন একটা কৌতুকে পরিণত হবে?

যা গ্রহনযোগ্য না সেটা মেনে নিয়ে নিজেদের নীতিবোধকে কলংকিত করে গর্বের সাথে নিজেকে স্পষ্টভাষী বলে দাবি করে বেড়াচ্ছি।

এসব করে হয়তো একদিন ধর্ষক, খুনী,  বোমা হামলাকারী, বিদ্বেষ রটানো লোকদের ডক্টরেট উপাধি দিয়ে দেশটা তাদের হাতে তুলে দিয়ে জনগনও সেই দলের বীর সৈনিক হয়ে চরম অবক্ষয়ের অংশীদার হবে বলেই আশংকা করি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]