May 19, 2024
কলামফিচার ২

পুরুষের সেবাদাসী নারী; নারীর সেবায় কে?

আঞ্জুমান রোজী ।। নারীকে জন্মের পরেই বুঝিয়ে দেয়া হয়, শিখিয়ে দেয়া হয় নারী কী, নারী কে, এই পৃথিবীতে নারীর কী করণীয় এবং কেন এই পৃথিবীতে সে এসেছে! মূলত নারীর জন্মই হয় পুরুষের সেবা করার জন্য। নারীর নিজেকে জানার এবং বোঝার বিষয়টা ব্যপৃত থাকে অর্থাৎ তার সমস্তটা জুড়ে থাকে একটা পুরুষ; যে পুরুষ দ্বারা সমাজ-সংসার-পরিবার নিয়ন্ত্রিত। সেই পুরুষকে আরাম আয়েস, সুখ দিতে যা যা করণীয় তা-ই শিখিয়ে, পড়িয়ে, বুঝিয়ে একটা মেয়েকে বড় করে তোলা হয়। তার অনেকটা মা, দাদী, খালা, ফুফুদের কাছ থেকেও দেখে দেখে শিখে নেয়। ঘর গৃহস্থালি কাজ থেকে শুরু করে পুরুষের চাহিদা মোতাবেক সবকিছু সরবরাহ করা এবং সেই মোতাবেক নারীকে প্রতিমুহূর্তে প্রস্তুত থাকা; তার সবটুকুই নারীর পাঠ্যশিক্ষার বাইরে প্র্যাকটিকাল শিক্ষার আওতার মধ্যে থাকে। একাডেমিক শিক্ষা যা-ই হোক না কেন, নারীর জীবনে এ ধরনের বাস্তব শিক্ষা বাধ্যতামূলক অর্থাৎ একটা পুরুষের শরীর-মন-মানসিকতার চাহিদা পূরণ করাই হলো নারীর মূল শিক্ষা। বিয়ে বা প্রেমের ক্ষেত্রেও পুরুষের মনের মতো একজন নারী হতে হবে এবং সেই নারীকে পুরুষের মনের মতো করেই নিজেকে উপস্থাপন ও পরিচালনা করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, সন্তানধারণ করবে কি করবে না, তার জন্য পুরুষের সিদ্ধান্তের উপর নারীকে অপেক্ষা করতে হয়। যুগ যুগ ধরেই  নারীর প্রতি এমন অমানবিক ব্যবস্থা চলে আসছে। সেটা সামাজিক বিধিব্যবস্থাই হোক আর ধর্মীয় অনুশাসন হোক, নারীকে তারমধ্যে আষ্টেপৃষ্টে বেধে রেখেছে। অর্থাৎ নারী হচ্ছে গিয়ে পুরুষের সেবাদাসী।

ছোটকাল থেকেই লক্ষ্য করে এসেছি, আমার আম্মা ঘর গৃহস্থালির কাজে সবসময় ব্যস্ত থাকতেন। আমাদের পাঁচ ভাইবোনের দেখভাল, রান্নাবান্না, ঘর সাজানো, সেলাইফোঁড়াই, অতিথি আপ্যায়নের পাশাপাশি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতেন আব্বার বিষয়। অর্থাৎ আব্বাকে সুখি কিম্বা খুশি রাখার সমস্ত দায়দায়িত্ব পালন করার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। এর কতকটায় আম্মার আনন্দও ছিল। আবার কখনো কখনো  বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যেতেন। কারণ, সেখানে আম্মার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। আমার আম্মা একজন স্মার্ট নারী ছিলেন। মাধ্যমিক শিক্ষা পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর মাধ্যমিক পাস করার পর খুব ইচ্ছে ছিল আরো পড়ার। কিন্তু পারেন নি। কারণ শশুর বাড়ির অনুমতি ছিল না। তবে আম্মা প্রচুর বই পড়তেন, নজরুলগীতি ভালোবাসতেন, মুভি দেখতেন আর বাসার ডেকরেশনে নতুনত্ব আনার জন্য সবসময় চেষ্টা করতেন। আমার আম্মা একজন আধুনিক মনের মানুষ হয়েও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামনে কখনোই নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। সবসময় লক্ষ্য করেছি অন্যের সেবা করে জীবনটা শেষ করে দিলেন। এমন চিত্র বাঙালির ঘরে ঘরে। হুমায়ুন আজাদের ‘আমাদের মা’ নামে একটি কবিতা আছে, যেখানে বাঙালির ঘরে ঘরে নারীর শাশ্বত রূপ ফুটে উঠেছে।

নারীকে সারাক্ষণ উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হয় এই ভেবে যে কীভাবে ঘরের পুরুষের মন জুগিয়ে চলবেন। আর পুরুষ সেই সুযোগটা কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে ছাড়েন। এতে তো আরাম। তাই না! এই আরাম কে ছাড়তে চায়? তার উপর কর্তৃত্বের একটা ব্যাপার আছে, যেটা পুরুষকে মানসিক তৃপ্তি এনে দেয়। যে তৃপ্তিতে নিজেকে রাজা-বাদশাহ, নবাব ভাবতে শুরু করে। নারীকে মনে করে তার হুকুমের দাসী। চাহিবামাত্রই সব হাজির হবে। এমন অবস্থান কে ছাড়তে চায়? এই আরাম আয়েস যাতে না ছাড়তে হয়, তার জন্য জন্ম থেকে একটা মেয়েকে সেভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করে। এখন মেয়েটি যত বড় বিদ্বানই হোক না কেন, যত বড় মেধায় মননশীলতায় এগিয়ে থাকুক না কেন, ব্যক্তিত্ববান হোক না কেন, তাকে মাথা নিচু করে পুরুষতান্ত্রিক অর্থাৎ সামাজিক বিধিব্যবস্থা মেনে নিতেই হবে এবং পুরুষের সেবাদাসী, তাবেদারী করে বাঁচতে হবে।

সময় বদলেছে। কিন্তু এখনো আমরা নারীকে সেই সেবাদাসী রূপেই দেখে আসছি। যদি সম্মান বিশ্বাস এবং ভালোবাসা একে অপরের প্রতি অটুট থাকে, সেক্ষেত্রে পরস্পরকে সেবা দিতে কোনো আপত্তি নেই। সমস্যাটা বাধে যখন নারীকে সেবা দিতে বাধ্য করে এবং পুরুষ সেটা একপাক্ষিকভাবে পেতে চায়। পুরুষ যখন তার মনমতো কিছু না পায়, তখন নারীর জীবনে কী পরিমাণে আযাব নেমে আসে তা বলে শেষ করা যাবে না। এজন্য কত কত নারীকে বলীও হতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, বিভিন্ন পেশাতে নারী পেশাদারীত্বের সাক্ষর রাখছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক মর্যাদায় নারীও কোন অংশে কম নয়; তারপরও খেয়াল করলে দেখা যাবে এ সমস্ত নারীর পারিবারিক জীবন মোটেও সুখকর নয়। নারী যতই মাথা উঁচু করে নিজের অবস্থান ঠিক করে চলুক না কেন, তাকে কোনো না কোনো পুরুষের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হয়; হয় সেই ব্যক্তি বাবা, না-হয় ভাই, নাহলে স্বামী কিংবা পুত্র। ঘরে ঘরে এসব পুরুষের মন জুগিয়ে তারপর একটা নারী তার নিজের কথা ভাবেন। আমি এখনো সেসব নারীর আহাজারি শুনি।

পুরুষটা যখন ঘরে ফিরে আসে তখন সে ধরেই নেয় তারজন্য সবকিছু প্রস্তুত কিংবা তৈরি আছে; তার খাওয়া, ঘুম, কাপড়চোপড় এবং  বিশ্রামের সব আয়োজন ঠিকঠাক আছে। সেই পুরুষটিও জন্ম থেকে বড় বড় হতে হতে বুঝে নেয় কোনো না কোনো নারী তাকে সেবা করবে, সেই নারী হতে পারে মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যা। কোনো না কোনো নারীকে একটা পুরুষের জন্য সমাজ বরাদ্দ করে রেখেছে। পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক এই বিধিব্যবস্থাকে আবার ধর্মীয় অনুশাসন সীলমোহরকৃত করেছে। যাতে নারী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পুরুষ-সেবায় নিয়োজিত থাকে, নাহলে তারা দোজখবাসী হবে। নারীকে পুরুষের ক্রীড়নক করে রাখার জন্য যতসব অমানবিক ব্যবস্থা। নারীও চায় তাকেও কেউ একজন সেবা করুক। আবার যতটুকুই না নারী সেবা পায় তার সবটুকু ধরে নেয়া হয় দয়া এবং করুণা হিসেবে, কারণ অতটুকুও নারীর পাওয়ার অধিকার নাই বা সেটা পুরুষের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। যত দায়িত্ব তার সবটুকুই হলো নারীর যা শুধু পুরুষের সেবা করা।

এখনো দেখি পুরুষটি ঘরে ঢুকে ফ্রেস হয়ে পায়ের উপর পা রেখে পেপার পড়বে, না-হয় টিভি দেখবে, নাহলে ডাইনিং টেবিলে বসে চায়ের অর্ডার করবে। ভালোবাসার টানে স্বামীদের প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আর স্ত্রীর  বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। স্বামীকে সেটা বুঝতে হবে। শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের সুবিধা আদায়ের কথা ভাবলে হবে না। সংসারে শান্তির জন্য উভয় পক্ষকেই ভাবতে হবে। ঘর সংসার স্বামী স্ত্রী দুজনের। স্ত্রী তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে সংসারের চাহিদা পূরণ করে সবকিছু  ঠিকঠাক করে রাখতে। সেক্ষেত্রে স্বামী পুরুষটি যখন ঘরে ফিরে আসেন তখন তাকেও মাথায় রাখা উচিৎ সংসারে তারও কিছু করার আছে। একতরফা একজনের উপর সবকিছু চাপিয়ে দেয়ার মধ্যে কোনো মহত্ত নেই। বিশেষ করে কর্মজীবী নারীদের এখনো সংসারের সমস্ত দায়িত্ব পালন করে কাজে যেতে হয়। আবার ফিরে এসে রান্না করে স্বামী সন্তানদের খাবার দিতে হয়। নারীর সকাল থেকে রাত অবধি এই একটানা কাজ করে যাওয়া কি পুরুষের চোখে পড়ে না! আর পড়লেই বা কী! এসব তো নারীর কাজ, পুরুষ কেন করবে? এটাকেই বলে পুরুষতান্ত্রিকতা। যেসমস্ত নারী শুধু ঘরসংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাদের বিষয়টাও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিৎ। কারণ সেই নারীটি সংসার ঠিকমতো করছে বলে স্বামী পুরুষটি ঘরে এসে তার চাহিদামাত্র সবকিছু রেডিমেড পাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে নারীটির প্রতি স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিৎ সম্মানের এবং কৃতজ্ঞতার। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর বিপরীত চিত্র দেখতে পাই। অর্থাৎ নারী সর্বাবস্থায় পুরুষের একজন বাধ্যগত সেবাদাসীই হয়ে থাকে।

আমার লেখার বিষয়বস্তু এবং প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ। পশ্চিমা দেশে এর চিত্র ভিন্ন। এখানের নারীরা নিজের ব্যাপারে  যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো অধিকাংশ নারী সেই অন্ধকার যুগেই পড়ে আছে। এসমস্ত মেয়েদের প্রকৃত জীবন শুরু হয় বিয়ের পর। সেই জীবন কত প্রকার এবং কী কী তা অক্ষরে অক্ষরে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেয়। নির্মমতার শেষ পর্যায়ে থাকে মেয়েদের বিবাহিত জীবন। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে পুরুষের এই মানসিকতা চিরতরে বিলীন করে দিতে নারীকেই বেশি সোচ্চার হতে হবে। সময় অনেক গড়িয়েছে। নারী বুঝে গেছে কী তার অধিকার। এখন নারীকে সেটা তার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। এই পৃথিবীটা নারী-পুরুষ সকলের এবং সমান সমান। কেউ কারোর অধীন নয়, আবার প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জন্য। নারীর দায়িত্ব এখন পুরুষকে বুঝিয়ে দেয়া যে জগত সংসারের সমস্ত কাজ অর্ধেক তোমার, অর্ধেক আমার। সেটা ঘর কিংবা অফিস, যে যেখানেই থাকি না কেন সব সমান সমান। ঘর গৃহস্থালির কাজও নারী-পুরুষের জন্য সমান। কেউ কারোর অপেক্ষা না করে কাজটা করে ফেলা। নিজের চা নিজে বানানো, সাথে অন্যদেরকেও সার্ভ করার মানসিকতা পুরুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে। পুরুষের মধ্যে কর্তৃত্বের ভাবটা ভেঙ্গে দিতে হবে। পুরুষকে বুঝাতে হবে তাদের অবস্থান শুধু বন্ধুর মতো, এর বেশি কিছু নয়। মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে নারী পুরুষ উভয়কেই সমদৃষ্টিতে মূল্যায়ন করার মানসিকতা রাখতে হবে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *