November 21, 2024
ফিচার ১কলামফিচার ২

নারীর ক্ষমতায়ন: বিচ্ছিন্ন ভাবনা  

ক্যামেলিয়া আলম ।। ২০২০ সালের একটা ঘটনা মনে আছে আপনাদের? যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সহকারী ভূমি কমিশনার একজন নারী প্রবীণ কয়েকজন ব্যক্তিকে কানে ধরে শাস্তি দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে প্রকাশ করলে তীব্রভাবে নিন্দিত হন , এর জেরে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন।

কয়েকদিন আগের আরেক খবর, কাজের মেয়েকে দীর্ঘ সময় নির্যাতন করেছে এক শিল্পী। বাচ্চাটিকে মেরে তার দাঁত পর্যন্ত ফেলে দিয়েছে। আরেক দিন কক্সবাজারে এক মেয়ের পোশাক নিয়ে এক দল পুরুষের পাশাপাশি এক নারীকে খুব বিকৃত মুখে নির্যাতন চালাতে দেখি ফেসবুকে। তাছাড়া অনেক পরিবারে দেখি বউ স্বামীর পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার হয় শাশুড়ি-ননদদের, আবার শাশুড়ি-শ্বশুড়ও বহু ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয় পুত্রবধূর। আমার নিজের অভিজ্ঞতাও বহু সময় দেখেছি, কোনো অফিসে কাজের জন্য গেলে চেয়ারে বসা অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকা নারীটি একই ক্ষমতায় থাকা পুরুষটির চাইতে বেশি কর্তৃত্ব দেখায়।

এমন এক বিষয় নিয়ে লিখছি এজন্য যে, বাংলাদেশ সবেমাত্র ক্ষমতায়নের সূচকে অগ্রগতিতে পা রাখছে। এই হাঁটি হাঁটি পা রাখার যুগে নারীর এখন এতো বেশি সতর্কতা প্রয়োজন যে, কোনো ভুলেই নারী যেন পা পিছলে না পড়ে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা যখন করছে, জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ, শিক্ষায় লিঙ্গসমতা আনার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কোর শান্তিবৃক্ষ, গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ডসহ আরও বহু বহু অর্জন যখন এদেশের নারীরা অর্জন করছে, তখন ক্ষমতায়নকে কোনোভাবেই বিতর্কিত করতে দেয়া যাবে না।

গত বছরের এক চমকপ্রদ খবর দেই, হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করা ডব্লিউ ই এফ (বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম) জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে বিশ্বের  এক নাম্বারে উঠে এসেছিল বাংলাদেশের নাম। তাদের তখনকার হিসাবে, নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে ৪৮তম অবস্থানে বাংলাদেশ। নারী উন্নয়নে সার্বিক সূচকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত ২৪টি দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পরই দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থান ছিল বাংলাদেশের।

বাংলাদেশে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নারী নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার ইতিহাস আছে। বিজ্ঞান, শিক্ষা, খেলাধুলায় বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশের নারীদের উত্থান অভূতপূর্ব। পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে নারীর সবচেয়ে বড় লড়াই বিনির্মাণের। বিনির্মাণের এই সময়ে নারীর ক্ষমতা অপব্যবহার আর পুরুষতান্ত্রিক রীতিনীতির বাইরে এসে নতুন ব্যবস্থা উদ্ভাবন জরুরি। পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেম থেকে কেন সরে আসতে চাইছে পৃথিবী? কারণ এই সিস্টেম জন্ম দিয়েছে অমানবিক পৃথিবী। যেখানে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। নারীরা যদি একই পথ নেয়, তাহলে পতন অবশ্যম্ভাবী।

এমন এক সময়ে নারীদের এহেন আচরণ নারীর ক্ষমতায়নে যাওয়ার পথকে থমকে দেবেই। নারীদের এই আচরণগুলোর কারণ খুঁজতে গিয়ে এক ধরণের মানসিক রোগের সাথে মিল পেলাম যার নাম ডিলিউশন ডিসঅর্ডার বা বিভ্রান্তিকর ব্যাধি। এই রোগে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অটল থাকেন যে তিনি জ্ঞানে গুণে সম্পদে অন্যদের থেকে সেরা। অন্যদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণাবোধ, নিচু মনে করার প্রবণতা তাকে ধীরে ধীরে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর পেছনে সঠিক কারণ অজানা। তবে মনোবিজ্ঞানীদের অনেকে মনে করেন যে, জেনেটিক্স, মস্তিস্কের রসায়ন- নিউরোট্রান্সমিটারে ভারসাম্যহীনতা, স্ট্রেসফুল জীবনের ঘটনা, ট্রমা, ড্রাগ বা অ্যালকোহলের অপব্যবহার, স্নায়বিক রোগ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, সাংস্কৃতিক কারণ ইত্যাদির ফলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাইকোথেরাপি ও প্রয়োজনবোধে ঔষধ এ রোগকে নিরাময় করতে পারে। তবে এর চাইতেও বড় প্রয়োজন, বিষয়টি বোঝা। পরিবারের আর নিজের।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে বারেবারেই ডাইনি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা আছে। গণিতজ্ঞ হাইপেশিয়ার সিঙ্গেল জীবন বেছে নেয়া, সাহসী চলাফেরা, জ্ঞান, সর্বোপরি রাজপুতের সাথে বন্ধুতাকে কেন্দ্র করে পুরোহিতের দল তাকে হত্যা করেছে। মধ্যযুগে হাজার হাজার মুক্তচিন্তার নারীকে লুসিফার আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফ্রান্সে যে নারী শত শত নারীকে নিয়ে প্রাসাদ আক্রমণ করে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছে প্রজাতান্ত্রিক সরকার আমলে, নারী-পুরুষের সমতা চাইতে গেলে সেই অলিম্প জে গুতজেকেই গ্যালোটিনে হত্যা করা হয়েছে। ফলে নারীর অর্জনকে ধ্বংস করার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন আছে।

বাংলাদেশের মতোন অগ্রগামী দেশের নারীর ক্ষমতায়নকে এখন কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেয়া যাবে না। কারণ ক্ষুদ্র দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন অত্যন্ত জটিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে টিকে থাকার মতোন শক্তি ক্ষুদ্র দেশগুলোর কখনও থাকে না। অর্থনীতির অবস্থাও থাকে টালমাটাল। আর বর্তমানে প্রমাণিত সত্য যে, সেই দেশগুলোই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে এগিয়ে যে দেশগুলোতে নারী-পুরুষ পাবলিক সেক্টরে সমানভাবে কাজ করছে। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ভিডিও দেখার সাইট ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী সুসান ওজস্কি, সোশ্যাল এন্টারপ্রিনিয়ার এবং ক্রস সেক্টর পার্টনারশিপভিত্তিক কাজে বিশেষ দক্ষ ম্যারিয়ানা ইস্কান্দার উন্মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া পরিচালনাকারী সংস্থা উইকিমিডিয়ার সিইও, জনপ্রিয় উন্মুক্ত লাইসেন্স ক্রিয়েটিভ কমন্স-এর সিইও ক্যাথেরিন স্থিলার, জনপ্রিয় গ্রাফিকস টেমপ্লেটস, ওয়েবসাইট থিমস, ছবি, ভিডিও, অডিও ইত্যাদি কেনা-বেচার মার্কেটপ্লেস এনভাটো’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক চায়ান তাঈদ; জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেইসবুকের  চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ। নারীর কাজ করার অসামান্য এই সক্ষমতাকে, শক্তিকে কোনোভাবেই ধ্বংস হতে দেয়া যাবে না।

নারীর ক্ষমতায়ন হোক পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে। শিক্ষা-জ্ঞান-দক্ষতা-সিদ্ধান্তগ্রহণের সক্ষমতা দিয়ে দৃঢ়ভাবে পরিচালিত হোক নারীর ক্ষমতা। বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত গতিতে চলুক।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *