May 15, 2024
কলামফিচার ৩

কন্যা সন্তানের জন্য কেন “দায়গ্রস্ত” হতে হবে?

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।। কিশোর বেলায় ক্লাসের ছেলেরা পড়া না পারলে আমাদের এক শিক্ষক তাদেরকে লজ্জা দিতে বলতেন, “মেয়েদের  না হয় লেখাপড়া কম করলে ক্ষতি নেই, কারো না কারো গলায় ঝুলে পড়তে পারলে বাপ-মায়ের টেনশন শেষ! কিন্তু ব্যাটাছেলের তো মাফ নেই। লেখাপড়া না করলে বউ খাওয়াবি কী করে?”

“গলায় ঝুলে পড়া”, “বউ খাওয়ানো”, “বউ পেটানো” – এদেশে বহুলপ্রচলিত ঘটনা ও কথাবার্তা। যার যার পারিপার্শ্বিকতা অনুযায়ী আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশী, শিক্ষক এমনকি মা – বাবার মুখ থেকেও এ শব্দগুলো  উচ্চারিত হতে শুনে থাকি আমরা।

বিয়ে হলেই মেয়ের বাবা – মায়ের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি লাভ হয় – পুরুষতন্ত্রের সিক্স প্যাক (six pack) প্রদর্শনের সুবিধার্থে এই সমস্ত বস্তাপচা বিষয়বস্তু সন্তর্পণে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কন্যাদায়, কন্যাদায়গ্রস্ত, কন্যাদান শব্দগুলো অবলীলায় ব্যবহার হয়ে আসছে। পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে মা – বাবাকে “পুত্রদায়গ্রস্ত” হতে না হলেও কন্যার ক্ষেত্রে “কন্যাদায়গ্রস্ত” কথাটি স্বাভাবিকভাবেই উচ্চারিত হতে শোনা যায়।

“কন্যাদায়গ্রস্ত” শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো – কন্যা পাত্রস্থ করণের দায়িত্ব পীড়িত, বিবাহযোগ্যা কন্যার জন্য চিন্তাগ্রস্ত, বিবাহযোগ্যা কন্যার জন্য চিন্তাগ্রস্ত পিতা বা অভিভাবক।

অর্থাৎ কন্যা সন্তান থাকলেই দায়গ্রস্ত হবার প্রসঙ্গ চলে আসছে এবং কন্যার পিতা বা অভিভাবককে “বিবাহযোগ্যা  কন্যার জন্য চিন্তাগ্রস্ত” হতে হচ্ছে। যেন কন্যাসন্তান এক বিশাল বোঝা, ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই শান্তি! এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, অভিধানে পিতা এবং অভিভাবকের কথা বলা হলেও মাতার কথা উল্লেখ নেই। মাতার অভিভাবকত্ব স্বীকারে আজো বোধ করি আমরা স্বচ্ছন্দ নই।

বিয়ের সময় কন্যাকে সম্প্রদান করতে হয়, তুলে দিতে হয় বর তথা পুরুষের হাতে। কনে বিদায় করা হয় “পরের ঘরে”, যে পরের ঘরই তার আপন বলে সে আজন্ম শুনে এসেছে কারো না কারো মুখে। কাল, যুগ, সময় পাল্টালেও সমাজে প্রচলিত কথাগুলো এখনো উবে যায়নি, পুরুষতন্ত্রের ছত্রছায়ায় আজো লালিতপালিত এই সকল ধ্যানধারণা।

“মেয়েদের জন্মই হয়েছে একদিন পরের ঘরে যাবে বলে”, “মেয়ে তো একদিন না একদিন পরের ঘরে যাবেই”, “স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঠিকানা” – বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনার – আমার আশেপাশে কাউকে কোনোদিন এমন কথা বলতে শোনেননি? এর সাথে মারাত্মকভাবে যা মগজে গেঁথে দেয়া হয় তা হলো, যত অনাচারই জীবনের উপর নেমে আসুক পুরুষ মানুষের চারিত্রিক দোষত্রুটি আড়ালে রেখে, গোপন করে, গায়ে হাত তোলা মেনে নিয়ে, অপমান সয়ে মুখ বুজে সংসার টিকিয়ে রাখা। সন্তান থাকলে তো কথাই নেই, মাটি কামড়ে পড়ে থাকো। এ এক অমোঘ মন্ত্রণা।

নারীর ক্ষমতায়নের বৈশ্বিক ডামাডোলের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি কেন কুসংস্কার আর পিছিয়ে থাকবার প্রলাপ বকছি? প্রলাপ বকছি কারণ বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা, এদিকে আমাদের মগজের কোনো অগ্রগতি নেই।

আজো আমরা পড়ে আছি মাটি কামড়ে সংসার করার থিওরিতে। পুরুষ সঙ্গীর স্বেচ্ছাচারিতায়, পারিবারিক নির্যাতনে বীতশ্রদ্ধ, জর্জরিত, ছারখার হয়ে যাক জীবন!

ভেঙে যাক কন্যাদের মন, মেরুদণ্ড কিংবা কেরিয়ারের স্বপ্ন! জীবন হুমকির সম্মুখীন হোক, আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিক! পরিশেষে লাশ হয়ে ফিরুক মেয়েগুলো! তবু শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সন্তানের মুখ চেয়ে নতুবা মা – বাবার মুখ চেয়ে সংসারটা বাঁচাতে চেয়েছিলো মেয়েটা। আহা! কান্নার আড়ালে কী এক আত্মতৃপ্তি! কী মান রক্ষা হয় সন্তানের মুখ চেয়ে? মা – বাবার মুখ চেয়ে? যদি জীবনই না রক্ষা পেলো? সন্তান আর মা – বাবার চিন্তার কথা বলে ফাঁদটা পাতে আসলে তথাকথিত আত্মীয় স্বজন পরিবেষ্টিত সমাজ যা কিনা মেয়ে, সন্তান, মা – বাবা প্রত্যেকের জীবনে অহেতুক নাক গলিয়ে নাজেহাল করে ছাড়ে। তাদের ভয়েই কন্যাদায়গ্রস্ত হয় বাবা – মা, তাদের কাছে মুখ দেখানোর ভয়েই অশান্তি আর অত্যাচারের সংসারে জীবন শংকা নিয়ে সংসারের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার প্রয়োজন পড়ে কন্যাদের।

এই করোনাকালে আমার কিশোরী কন্যাদ্বয়ের সমবয়সী একাধিক কন্যাকে বিয়ে দিয়ে কন্যাদায় মুক্ত হয়েছে তাদের অভিভাবকেরা। গ্রামেগঞ্জে, অজপাড়াগাঁয়ে নয়, খোদ ঢাকা শহরের নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে ঘটেছে এমন বাল্যবিয়ের ঘটনা।

পরের ঘরকে আপন করে নেবার, শ্বশুরালয়ে মানিয়ে চলার ভারী মন্ত্র জপতে জপতে কন্যারা বিদায় নিয়েছে।

“দায়মুক্ত” করেছে বাবা – মাকে! শিক্ষা আর প্রযুক্তির উৎকর্ষে বাস করেও কেন শহুরে জীবনেও বাল্যবিয়েকে “না” বলতে পারছি না আমরা?

কন্যা সন্তানের জন্য কেন “দায়গ্রস্ত” হতে হবে? “পরের ঘর”কে আপন করে নিতে হবে আর জন্ম থেকে যে পরিবারে আদর – যত্নে বেড়ে উঠেছে, সেই পরিবারে নিজের দুঃখ ভাগাভাগি করবার কোনো জায়গা থাকবে না? বিয়ে ভেঙে গেলে কেন ফিরে আসবার পথ থাকবে না কন্যাদের? বিয়ে ভাঙলে মুখ থাকবে না অথচ অসুস্থ, প্রাণ এবং মান হানিকর সম্পর্ক টিকে থাকলে মুখ রক্ষা হবে কেন?

চলুন না, প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজতে চেষ্টা করি!

কন্যারা লাশ হয়ে ফেরার আগেই জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকা থেকে উদ্ধার পেতে ওদের প্রতি হাতটা বাড়াই। নিজেকে আপন ভাবতে সাহায্য করি।

কন্যাদের আত্মমর্যাদা “পরের ঘরের মাটিতে” ধূলিসাৎ না করার শিক্ষা দেই।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *