December 23, 2024
কলাম

ট্রাম্পের জয়; হেরে গেল নারীর প্রজনন স্বাধীনতা?

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আপনি যদি আমেরিকার নির্বাচনী প্রচারণা অনুসরণ  করে থাকেন তাইলে নিশ্চয়ই দেখেছেন যে কমলা হ্যারিস তাঁর বক্তৃতায় নারীর প্রজনন অধিকারের কথা বলতেন এবং বলতেন যে রো বনাম ওয়েড মামলার সিদ্ধান্ত তিনি ফিরিয়ে আনবেন। এই রো বনাম ওয়েড এর সিদ্ধান্তটা কী ছিল সেটা আরেকবার মনে করিয়ে দিই। ১৯৭০ সনে টেক্সাসের নোরমা ম্যাককরভি নামে একজন গর্ভবতী নারী ডালাসের এটর্নি জেনারেলের বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছে। সেই মামলায় তিনি দাবি করেন যে টেক্সাস রাজ্যের গর্ভপাতবিরোধী আইন তার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করছে বিধায় এইসব আইন অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে হবে। এই মামলাটি চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে। ১৯৭৩ সনে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট এই ঐতিহাসিক রায়ে ঘোষণা করে যে গর্ভপাত বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নারীর একটি সাংবিধানিক অধিকার এবং এর ভিত্তিতে গোটা আমেরিকার অনেকগুলি গর্ভপাতবিরোধী আইনকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেওয়া হয়। নিরাপত্তার কারণে পরিচয় গোপন রাখার জন্যে নোরমা ম্যাককরভির নাম আড়াল করে জেন রো ছদ্মনামে মামলাটি নিবন্ধিত হয়েছিল। এইজন্যে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তটি রো বনাম ওয়েড নামেই পরিচিত। সুপ্রিম কোর্টের নয়জন বিচারকের মধ্যে সাতজন ছিল রায়ের পক্ষে আর দুইজন ছিল বিপক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবশ্য নারীর এই অধিকারটিকে নিরঙ্কুশ অধিকার বলা হয়নি, কিছু কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক সীমাবদ্ধতা স্বীকার করা হয়েছিল সেই রায়ে।

আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের এই রায়টা সারা পৃথিবীর জন্যেই একটা যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। এই রায়ের গুরুত্ব কেবল আমেরিকার নারীদের গর্ভপাতের অধিকারের মধ্যে সীমিত ছিল না। এই রায়ের ফলে নারীর ‘আমার দেহ আমার সিদ্ধান্ত’ নীতিটারও একটি স্বীকৃতি পাওয়া যায়। আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে সত্তরের দশকের সেই সময়টাতে নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গ ছিল তুঙ্গে। নারীবাদী আন্দোলনের ফলে যে সচেতনতা তৈরি হয়েছিল সেই চেতনা যে এই রায়ের পেছনে কাজ করেছে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। ১৯৭৩ সনের সেই রায়ের পর থেকে এইটাই ছিল আমেরিকার আইন যে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত বা সন্তান জন্মদান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রাথমিকভাবে একজন নারীরই থাকবে, কেবল কিছু সীমিত ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা আমেরিকার রাজ্যসমূহ গর্ভপাত নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারবে। সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার সকলেই সানন্দে মেনে নেয়নি। রক্ষণশীল যারা, পিতৃতন্ত্রের পক্ষের লোকজন যারা, ওরা কিন্তু সবসময়ই এই রায়ের বিপক্ষে ছিল। রিপাবলিকান পার্টি যেহেতু রক্ষণশীলদের পার্টি, ওরা প্রাথমিকভাবে সবসময়ই নিজের শরীরের উপর নারীর অধিকার বা নারীর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে এসেছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগে এই সিদ্ধান্ত বাতিল বা পরিবর্তনের জন্যে কেউ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আপনারা চেনেন। তিনি যে একজন মেল শভিনিস্ট ও মিসোজিনিস্ট এই নিয়ে তো কোনো সংশয় নেই আর কি।  এই ভদ্রলোক এর আগেরবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর একরকম ঘোষণা দিয়েই সুপ্রিম কোর্টে এমন কয়েকজন বিচারক নিয়োগ দেয় যারা সুযোগ পাওয়া মাত্রই রো বনাম ওয়েড মামলার সিদ্ধান্ত পাল্টে দেবে। সেই সুযোগও ওদের সামনে আসে কিছুদিনের মধ্যেই – ডবস বনাম জ্যাকসন নারী স্বাস্থ্য সংস্থা (Dobbs v. Jackson Women’s Health Organization) মামলায়। এই মামলায় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট রো বনাম ওয়েড মামলার সিদ্ধান্ত উল্টে দিয়ে নয়া সিদ্ধান্ত দেয়। এই নয়া রায়ে ৬-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠটায় সুপ্রিম কোর্ট নারীর গর্ভপাতের সিদ্ধান্তের অধিকার কেড়ে নেয় এবং রাজ্যগুলিকে ক্ষমতা দিয়ে দেয় গর্ভপাত নিয়ন্ত্রণে আইন করার ও প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করার। রায়টা হয় ২০২২ সনে, ততদিনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর প্রেসিডেন্ট নাই। কিন্তু ট্রাম্পের নিয়োগকৃত জজরা তো রয়ে গেছেন। ওরাই এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন। কমলা হ্যারিস নির্বাচনী প্রচারণায় যে প্রজনন অধিকার পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি করেছিলেন, এটা হচ্ছে সেই রো বনাম ওয়েড সিদ্ধান্তে ফেরত যাওয়ার প্রতিশ্রুতি। এখন যেহেতু কমলা হ্যারিস হেরে গেলেন, নারীদের সেই অধিকারটি পুনরুদ্ধারের কাজটি পিছিয়ে গেল আবার কতদিনের জন্যে কে জানে!

নারীর নিজের দেহের উপর নিজের মালিকান তথা নিজের দেহের উপর নারীর সার্বভৌমত্ব এবং তারই অংশ হিসাবে নারীর প্রজনন অধিকার এবং প্রয়োজনে গর্ভপাতের অধিকার আদায়ের জন্যে বিশ্বব্যাপী নারীকে সংগ্রাম করতে হয়েছে বহু বছর ধরে। ষাটের দশকে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে ওষুধ সহজলভ্য হওয়া শুরু হলেও গর্ভপাতের উপর আইনগত প্রতিবন্ধকতা তখনো দূর হয়নি। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সহজলভ্য করার জন্যেও নারীকেই আন্দোলন করতে হয়েছে এবং ইউরোপে ও আমেরিকায় তার পরেও নিরাপদ গর্ভপাতের কোনো ব্যবস্থা ইউরোপে বা আমেরিকায় নারীর জন্যে সহজলভ্য ছিল না। আমেরিকার নারীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭৩ সনের রো বনাম ওয়েড মামলার রায়ের জন্যে। এর আগে পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কয়েকটা কারণ ছাড়া (ধর্ষণ বা ইনসেস্ট থেকে গর্ভধারণ ইত্যাদি) গর্ভপাত করানো নারীর জন্যে অপরাধ হিসাবেই বিবেচিত হতো এবং অনেক নারীর এজন্য কারাবাস হয়েছে, শাস্তি পেতে হয়েছে। রো বনাম ওয়েড মামলায় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে রায় দেওয়ার পরেও গর্ভপাত সুবিধা চট করে নারীর জন্যে সহজলভ্য হয়ে যায়নি বা সমাজের সব অংশ রায়টি সহজে মেনে নেয়নি।

রো বনাম ওয়েড রায়ের বিরুদ্ধে আমেরিকার ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলি – রোমান ক্যাথলিক ও মরমনরা বিশেষ করে, দীর্ঘদিন ধরে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও রায় বাতিলের চেষ্টা জারি রাখে। রোমান ক্যাথলিক চার্চ নিয়মিত সভা সমিতি করে, ধর্মীয় প্রচারণা করে, এমনকি ভ্যাটিকান থেকে পোপের ফতোয়া এনে সেটা আমেরিকায় প্রচার করে নানাভাবে আমেরিকার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে যেন রো বনাম ওয়েড মোকদ্দমার রায় পাল্টে দেওয়া যায়। ধর্মীয় গ্রুপগুলির সাথে আমেরিকার দক্ষিনপন্থী রাজনীতিবিদরাও যোগ দেয় এবং আমেরিকার রাজনৈতিক ভাষায় আরেকটি কথা যুক্ত হয়ে যায় একসময় – ‘প্রো লাইফ’ নামে। প্রো-লাইফ বা জীবনের পক্ষে কথাটার ওরা অর্থ করে গর্ভপাত বিরোধিতা হিসাবে। এখানে বলতেই হয় যে ইউরোপ এই ব্যাপারে আমেরিকার চেয়ে খানিকটা অগ্রসর ছিল সবসময়ই, বিশেষ করে ফ্রান্সের রাজনীতিবিদ এবং জনগণ নারীর অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আমেরিকার তুলনায় সবসময়ই অগ্রসর ছিল। ইউরোপে গর্ভপাতের অধিকার সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করার ফলে খৃস্ট ধর্মের নানা অংশের লোকজনও ধীরে ধীরে নারীর অধিকার মেনে নিতে থাকে আর তার প্রভাব আমেরিকাতেও গিয়ে পড়ে। কিন্তু আমেরিকায় দক্ষিনপন্থী রাজনীতিবিদরা গর্ভপাতের নিষিদ্ধের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সেই প্রচেষ্টারই চুড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে ২০২২ সনে সুপ্রিম কোর্টে রো বনাম ওয়েড বাতিল হওয়া।

এখন যখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কমলা হ্যারিস হেরে গেলেন, এখন আমেরিকার নারীদের জন্যে প্রজনন স্বাধীনতা পুনঃরুদ্ধার করার সংগ্রামটা আরও কঠিন হয়ে গেল এবং দৃশ্যত সেই অধিকার আর নিকট ভবিষ্যতে যে আদায় হবে সেকথা আর বলা যাচ্ছে না। প্রথমত কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট না হওয়ায় তার পক্ষে বা ডেমোক্রেটদের পক্ষে এই কাজটি করা সম্ভব হবে না, দ্বিতীয়ত যেহেতু এই ইস্যুটি নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের একটি বড় ইস্যু ছিল, ডেমোক্রেটদের হারের ফলে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হবে যে নারীর প্রজনন স্বাধীনতার দাবিটিও জনগণের ভোটে হেরে গেছে। আমেরিকার নারীদের জন্যে সংগ্রাম আরও দীর্ঘ হয়ে গেল। আশার কথা হচ্ছে যে, নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলের পর কমলা হ্যারিস নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে যে বক্তৃতা করেছেন সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে ‘‘নির্বাচনে পরাজয়ের ফলাফল মেনে নিচ্ছি, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমাদের যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামেও আমরা পরাজয় মেনে নিলাম। আমাদের সংগ্রাম ঠিকই অব্যাহত থাকবে।” প্রজনন স্বাধীনতার জন্যে আমেরিকার নারীদের সংগ্রাম অবশ্যই অব্যাহত থাকবে।

এবং এবারের সংগ্রামটি আগের দফার সংগ্রামের মত অতোটা কঠিন হবে না। কেননা রো বনাম ওয়েড মামলায় যখন রায় হয় সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। পৃথিবীর অনেক দেশের আইনেই নারীর প্রজনন স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে পরিস্থিতি এখনো নারীর জন্যে সম্পূর্ণ সন্তোষজনক না হলেও বলতেই হয় যে পরিস্থিতি সত্তরের দশকের চেয়ে অনেক অগ্রসর তো বটেই। ইউরোপ তো এদিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। ইউরোপের সর্বত্রই মোটামুটিভাবে নারীর প্রজনন স্বাধীনতা স্বীকৃত। আর ফ্রান্স তো সকলের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। ২০২৪ সনের ৮ই মার্চ তারিখে ফরাসি পার্লামেন্ট ওদের সংবিধান সংশোধন করে গর্ভপাতের অধিকারকে একটি মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে ওদের সংবিধানে যুক্ত করে নিয়েছে। ভাবতে পারেন! নারীর শরীরের উপর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে ফ্রান্সে আজ গর্ভপাতের অধিকার একটি মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার।

না, আমেরিকার নারীদের জন্যেও এই নির্বাচনে হেরে যাওয়া এটা কোনো ‍চুড়ান্ত পরাজয় নয়। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে কোনো ব্যাটল আপনি যেমন জিততে পারেন তেমন আবার কিছু ব্যাটল হারতেও পারেন। এইসব একেকটা খণ্ডযুদ্ধে হেরে গেলেও সেটা চুড়ান্ত পরাজয় নয়। আমেরিকার নারীদের জন্যে আজকের এই পরাজয় একটি খণ্ডযুদ্ধে পরাজয় বটে, কিন্তু লড়াই তো অব্যাহত আছেই- নারীকে তো লড়াই অব্যাহত রাখতেই হয়, নারীর লড়াই চাইলেই থামিয়ে দেওয়া যায়না – আজ নয়তো কাল নয়তো পরশু নারীর বিজয় অনিবার্য।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *