May 15, 2024
কলামফিচার ২

ইরানের আন্দোলন কেন আমাদেরও আন্দোলন

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।।

মাআশা আমিনির মৃত্যুর পর একমাস পার হয়ে গেছে। ইরানে নারীদের বিক্ষোভ এখন ছড়িয়ে গেছে দেশের সর্বত্র, স্কুলের মেয়েরা বিক্ষোভ করছে। নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও এখন বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে। সংঘাত হচ্ছে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সাথে। বিক্ষোভকারীদের সাথে সাথে মৃত্যু হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও। মৃত্যুর সংখ্যা এখন একশ ছাড়িয়ে গেছে। ইরানের বাইরেও পৃথিবীর নানা শহরে মানুষ ইরানী নারীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করছে। আমাদের এখানেও ছোট করে হলেও একাধিক কর্মসূচী হয়েছে ইরানের আন্দোলনরত নারীদের সাথে সংহতি জানিয়ে।

বাংলাদেশ থেকে আমরা কি বলতে পারি যে ইরানের নারীদের এই আন্দোলন আমাদের সকলের আন্দোলন? হ্যাঁ, ইরানের নারীদের এই আন্দোলন নানা বিচারেই বাংলাদেশের মানুষেরও আন্দোলন। কেবল বাংলাদেশের নারীদের আন্দোলনই নয়, বাংলাদেশের সকল মানুষের আন্দোলন। কেন এটা বাংলাদেশের সকল মানুষের আন্দোলন সে কথাটা বলার আগে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা একটু বলে নিই।

শুকনো পাতার নূপুর পায়ে একটি অতি জনপ্রিয় নজরুল গীতি। এই গানে নজরুল এক জায়গায় ইরানী বালিকার উপমা ব্যবহার করেছেন, “ইরানী বালিকা যেন মরু-চারিনী/ পল্লীর প্রান্তর-বন মনোহারিণী” ইত্যাদি। মাআশা আমিনির মৃত্যুর পর ওর সব ছবি যখন আমরা দেখতে পেলাম অন্তর্জালে, খবরের কাগজে, টেলিভিশনে তখন মনে হয়েছিল এই কথাটা, ইরানের সংস্কৃতিতে তো নারীদেরকে এইভাবে অবরুদ্ধ করার প্রথা ছিল না। কাজী নজরুল ইসলাম যখন এই গান লেখেন এবং তার পরেও বহু বছর ইরানের নারীরা পূর্ণ প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে, স্বাধীনভাবে সমাজে চলাফেরা করেছে। আশি সনে ঐ খোমেনির অভ্যুত্থানের পর থেকে ইরানের নারীদেরকে অবরুদ্ধ করার আইনগুলি প্রবর্তন করা হয়েছে। অতি সমৃদ্ধ যে হাজার বছরের ইরানী সভ্যতার ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সেখানে নারীদেরকে অবরুদ্ধ করার এইরকম অপপ্রয়াস আগে কখনো ছিল না।

আবার দেখেন, ইরানের নারীরা যখন মাথার হিজাব খুলে কেশ কেটে ফেলে বিক্ষোভ শুরু করে তখন মনে হচ্ছিল যেন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতারই সেইসব প্রফেটিক লাইনগুলিরই মঞ্চায়ন হচ্ছে তেহরান ইস্ফাহান ও শিরাজের রাজপথে, নজরুলের নারী কবিতাটির চারটি লাইন তুলে দিচ্ছি, দেখুন ইরানের আন্দোলন যেন নজরুলের নির্দেশিত পথেই অগ্রসর হচ্ছে।

“চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল

মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল

যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,

দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন, যেথা যত আভরণ”

এই আন্দোলনটা কেন আমাদের সকলের আন্দোলন?

দেখেন, নারীদের এই আন্দোলন তো কেবল মাথার হিজাব খুলে ফেলবার আন্দোলন নয়, এটা তো হচ্ছে অধিকারের আন্দোলন তথা স্বাধীনতার আন্দোলন। মুল কথাটা হচ্ছে যে, একজন নারী মাথায় হিজাব পরবে কি পরবে না সেই সিদ্ধান্তটা কে নেবে? নারী নিজে নেবে নাকি রাষ্ট্র বা সমাজ বা উপর থেকে অন্য কেউ নারীর উপর এই সিদ্ধান্তটা চাপিয়ে দেবে? এটা তো জটিল কোনো প্রশ্ন নয়। এমনকি যারা বলেন যে ‘হিজাব আমার অধিকার’ এই আন্দোলনটা তো ওদেরও প্রাণের আন্দোলন হওয়ার কথা। কেননা অধিকারের কথাটা তো সেইটাই – হিজাব নারীর অধিকার, যে কোনো নারী চাইলে সেটা পরবে, না চাইলে পরবে না। যারা নারীর অধিকারের পক্ষে তারা সকলেই তো এই কথা সমর্থন করবে, যে হ্যাঁ, হিজাব হোক বা বোরকা হোক বা যে কোনো পোশাকই হোক, নারীর পোশাক পছন্দ করা সে তো নারীর অধিকার। নারীকে আপনি কেন বাধ্য করবেন হিজাব পরতে বা না পরতে?

আমাদের দেশের নারীদেরও তো এখন একটা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। একটি গোষ্ঠী ধর্মের নামে নারীদের পোশাক পরিচ্ছদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চাইছে। ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের ঘটনার কথা তো আপনারা জানেন। ঢাকার বাসে ও সড়কেও নারীদেরকে হেনস্তা করা হয়েছে পোশাকের জন্যে। শুধু তাই না। গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলিতে নানারকম প্লাকার্ড ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়েছে যেগুলিতে নারীকে অবরুদ্ধ করার পক্ষে অশ্লীল ও অশালীন সব তর্ক লেখা ছিল। এইসব তর্ক তো নতুন নয়, আমাদের এখানে এমনিতে মানুষের আলাপ আলোচনায় ওয়াজে নসিহতে ও অন্তর্জালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এইসব আপত্তিকর বাজে কথা আমরা শুনে আসছি বেশ কিছুদিন ধরে।

নারীকে অবরুদ্ধ করার জন্যে যেসব কুতর্ক ওরা হাজির করে সেগুলির মূল কথাটা কী? মূল কথাটা হচ্ছে যে নারী তো পূর্ণ মানুষ নয়, নারী হচ্ছে পুরুষের ভোগের বস্তু মাত্র। ভোগের বস্তু তো যত্ন করে রাখতে হয়, ঢেকেঢুকে রাখতে হয়, সুতরাং নারীকেও সেইভাবেই রাখতে হবে। ওদের বিশ্বাস অনুযায়ী নারী তার নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারবে না – নারীর যেন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারই নাই। নারীকে যদি আপনি মানুষই মনে করেন তাইলে তো আপনাকে মানতেই হবে যে নারী নিজেকে কীরকম পোশাকে সজ্জিত করবে সেটা নারীর নিজের ইচ্ছা। এটা ওরা মানবে না। হিজাবের কথাটাই ধরেন, হিজাবকে ওরা নারীর অধিকার মনে করে না, ওরা মনে করে যে হিজাব হচ্ছে পুরুষের অধিকার, পুরুষ নির্দেশ দেবে আর নারী সেটা মানতে বাধ্য। ইরানের আইনেও এর প্রতিফলন পাবেন। এই যে হিজাব আইন আছে সেখানে, সেই আইনে শাস্তির বিধান হচ্ছে যে কোনো নারী যদি ওদের নির্দেশিত পোশাক না পরে তাইলে সেই নারীকে সংশোধানাগারে যেতে হবে, আর নারীটির যে অভিভাবক – তাকে শাস্তি দেওয়া হবে, তোমার কন্যা বা তোমার স্ত্রীকে তুমি কেন হিজাব পরাওনি। মানেটা কী দাঁড়ায়? মানে হচ্ছে যে নারী পুর্নাঙ্গ মানুষ নয়, পুরুষের অধীনে এক প্রকার মানবেতর প্রাণী মাত্র।

আর কেবল নারীর কথাই তো নয়। সকল মানুষের জন্যে পোশাক ছাড়াও অন্য সকল ইস্যুতেই স্বাধীনতা, লিবার্টি, অধিকার এইসব তো জরুরি। সমাজকে যদি আপনি ওদের হাতে তুলে দেন যারা নারীর অধিকার কেড়ে নিয়ে অবরুদ্ধ করবে, তাইলে নারীর অবরোধের সাথে সাথে আরও নানাপ্রকার বিধিনিষেধ আসবে যেগুলি মানুষের বাক চিন্তা ও অন্যান্য সব স্বাধীনতা ও অধিকারকে নানাভাবে খর্ব করবে। রাষ্ট্রকে যদি আপনি একটি থিওক্রেসি বা ধর্মতন্ত্রে রূপান্তর করেন তাইলে তো আর স্বাধীন চিন্তার কোন সুযোগই থাকে না। সেইখানে ধর্মীয় বিধান যেগুলি, সেগুলি তো আপনার পছন্দ বা অপছন্দ করার কোন সুযোগ নাই। এই জন্যে দেখেন ইরানে নারীদের সাথে সাথে পুরুষরাও নেমে এসেছে সব রাস্তায় – ওড়াও দাবি করছে যে – না, মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।

অধিকার তো অধিকারই, আর স্বাধীনতাও একইরকম – আপনার অধিকার যদি লঙ্ঘিত হয় তাইলে সেটাতে কোনো না কোনো রকমভাবে আমার অধিকারও খর্ব হয়। আপনার স্বাধীনতা যদি না থাকে তাইলে সেটা তো আমার স্বাধীনতারও লঙ্ঘন। আপনি আর আমি দুইজন দুই পক্ষে থাকতে পারি, কিন্তু স্বাধীনতা যখন আপনার খর্ব হবে বা আমার খর্ব হবে তখন সেটা দুজনেরই স্বাধীনতাকে খর্ব করে। সেইজন্যে নারীরা যখন অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করে, সেটা প্রকারান্তরে পুরুষেরও আন্দোলন বটে। আর মানুষের অধিকারের সংগ্রাম কখনো কোনো নির্দিষ্ট টেরিটরিতে সীমিত থাকে না, কেননা সকল অধিকারের দাবিই আসলে পৃথিবীর সকল মানুষেরই লিবার্টির সংগ্রাম। সুতরাং ইরানের ঘটনা বা দূর কোন দেশের ঘটনা বলে চুপ করে বসে থাকবার কোনো সুযোগ নাই – ওদের যে শ্লোগান – জিন জিয়ান আজাদি – সেটা আমাদেরও শ্লোগান।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *