May 15, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নারীর ‘মহান’ পরিচয়, ‘মহৎ’ থাকার লোভ

লামিয়া ইসলাম ।। নারীবাদ নারীকে মহান করে তোলার, বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কোনো তত্ত্ব নয়। বরং নারীকে তার প্রাপ্য সমধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার যে চিন্তা, তার বিরুদ্ধে সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং দার্শনিক তত্ত্ব।

নারীকে শুধুমাত্র নারী বলেই পড়াশোনা করতে দেওয়া হয়না, বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়, ধর্ষণ করা হয়, যৌতুক দিতে হয়, জামাইয়ের মাইর খেয়েও আত্মসম্মানবোধ ভুলে তার সাথে থাকতে হয়, পছন্দ মতো পোশাক পরতে পারে না, ঘুরতে পারে না ইত্যাদি বঞ্চিত জায়গাগুলো মোটামুটি আমাদের জানাই। এ বিষয়গুলো ধরতে পারাও মোটামুটি সহজ।

কিন্তু নারীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার পাশাপাশি, মহান করে তোলাও যে পুরুষতান্ত্রিকতারই এক রাজনীতি সেটা ধরতে পারাটা একটু কষ্টকর। এ কারণেই এই ধূর্ত রাজনীতির কবলে অনেকেই আটকে পড়ে সহজে।

সহানুভূতির নামে নারীকে আটকে রাখা, শোষণ করা, দুর্বল-অবলা প্রমাণ করা সহজ। চাকুরিজীবী নারীদের অলরাউন্ডার প্রমাণ করার এক  প্রবণতা আছে সমাজে। অলরাউন্ডার বলতে বোঝানো হয় কর্মজীবী নারীটি সংসার, রান্নাবান্না, বাচ্চাকাচ্চা সব সামলিয়ে চাকরি বা ব্যবসাও সামলাচ্ছে। খালিচোখে মনে হবে বিষয়টা বেশ সরল, সুন্দর প্রশংসা। কিন্তু এর মাঝেই লুকিয়ে থাকে বিশাল রাজনীতি। যার জেরে নারীর প্রধান ও প্রাথমিক কাজ যে সংসার তা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। মানে সংসারের কাজ, বাচ্চা পালন নারীর জন্য অবশ্যকর্তব্য কিন্তু পুরুষের জন্য তা অপশনাল। অর্থাৎ করলে উত্তম পুরুষ, না করলে জবাবদিহিতা নেই।

নারী যদি অফিসের কাজ শেষে সংসারে তেমন সময় না দিতে পারে তবে আত্মগ্লানিতে ভোগে আদর্শ মা বা আদর্শ বউ হয়ে উঠতে না পারার ব্যার্থতায়। অথচ একজন বাবাকে ভালো বাবা হয়ে উঠবার জন্য এতো কিছু না ভাবলেও চলে। সে অফিসের কাজে টানা একমাস ব্যস্ত থাকলেও দিব্যি ভালো বাবা হয়ে সমাজে নাম রাখতেই পারে নিজের।

অন্যদিকে নারীকে মহৎ দাবী করে “সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে” টাইপ প্রবাদের মধ্যকার লুকিয়ে থাকা রাজনীতি দিয়ে এটা প্রতিষ্ঠিত করা হয় যে নারীরা ভুল করতে পারেনা, নারীরা প্রেমে জড়াতে পারেনা, নারী সবসময়ই সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত। পুরুষ মানুষ ভুল করতেই পারে, তারা তো অন্যায় করবেই – এ ধরনের মানসিকতা তৈরি হয়।

মাতৃত্বকে এমনভাবে মহান করে তোলা হয় যেন কোনো নারী যদি ঘর সংসার না করতে চায় বা বাচ্চা জন্ম না দিতে চায় তাহলে তার জন্ম বৃথা, জগতের সমস্ত দোষ তার, ‘বন্ধ্যা’ ইত্যাদি গালাগালিও দেয়া হয় তাকে আর এসবের মাধ্যমে নারীকে গড়ে তোলা হয়েছে সন্তান জন্মদানের মেশিন স্বরূপ। উল্লেখ্য এখানে কোনোভাবেই সন্তান জন্মদানে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছেনা। কিন্তু স্বাভাবিক জৈবিক বিষয়কে অতিরঞ্জিত ও পবিত্র আখ্যা দিয়ে নারীদের জন্য কিভাবে বাধ্যবাধকতার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে সেই রাজনীতিই বোঝানো হয়েছে।

পুরুষ তার সুবিধামতো নারীকে করেছে দেবী, করেছে বেশ্যা। নারীকে প্রয়োজনে পুরুষ বানিয়েছে মহান, আবার তারাই নারীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অবলা রূপে।
নিজেরাই ছুঁয়ে নারীকে বানিয়েছে কলঙ্কিনী, আবার নিজেরা একাই কর্তৃত্ব স্থাপন করতে এনেছে সতীত্বের সংজ্ঞা।
কখনো চাপিয়েছে বোরখা আবার মিডিয়া কখনো জোর করেই পণ্যায়নের উদ্দেশ্যে পরিয়েছে নানান ধরনের পোশাক। সাজসজ্জা করিয়ে বানিয়েছে মনোরঞ্জনের পণ্য। তাই সাবধান এসব রাজনীতি থেকে।

বায়োলজিক্যাল কিছু তফাত ছাড়া এই সমাজে নারী বা পুরুষ আলাদা কিছু নয়। সিমোন দ্যা বোভোয়ারের মতে, নারী আসলে নারী হয়ে জন্ম নেয় না। বরং নারী হয়ে ওঠে। এই বক্তব্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে মানবীয় বৈশিষ্ট্য, স্বভাব, আচরণ, মান মর্যাদায় নারী পুরুষ একই থাকে। কিন্তু এই সমাজ নারীকে নারী হিসেবে গড়ে তোলে। যা পুরোটাই কালচারাল নর্মস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অভ্যস্ততায় গড়ে ওঠা। বা সামাজিক চাপে ডমিনেটেড হতে হতে আলাদা করে গড়ে তোলা।

যুগের পর যুগ ধরে নারীদের শোষণ করা হচ্ছে শুধু নারী হওয়ার অপরাধে। তা কখনো বা মহান বানিয়ে কখনো বা ভয় দেখিয়ে। যখনই নারী লিখতে, নাচতে, গাইতে, আঁকতে, ঘুরতে, অভিনয় করতে, রিসার্চ করতে চেয়েছে; মহান মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে বারবার আটকে দেওয়া হয়েছে সকল প্রতিভা বিকশিত হওয়ার আগেই। পুরুষকে কখনোই তার কোনো স্বপ্ন বা প্রতিভা বা শখ বিসর্জন দিতে হয়নি পিতৃত্বের জন্য।

তাই মহান হবার লোভ থেকে বের হতে হবে নারীকেই। চোখে চোখ রেখে জবাব দিতে হবে, আমার কোনো ঠেকা নেই দশভূজা হবার বা এক হাতে সব সামলানোর। জামাইয়ের সকল অন্যায় মেনে নিয়েও দাঁতে দাঁত চেপে সংসার রক্ষা করার সকল দায় আমার একার নয়। বাচ্চাকাচ্চা, রান্নাবান্না সব সামলানো উভয়ইয়ের দায়িত্ব, নারীর একার নয়। কারণ আমি নারী মানে নহি আমি অসামান্য দেবী, আবার নহি অবলা বরং আমি নারী মানে আমি স্রেফ তোমার মতোই সাধারণ মানুষ।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *