নারীর ক্ষমতায়ন আসলে কী?
লীনা দিলরুবা।। নারীর ক্ষমতায়ন কোনো একক বিষয় নয়। সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কর্মক্ষেত্রে এমনকি বাড়িতেও নারীর মত প্রকাশ এবং সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা আজ এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সমাজে নিজের পরিচয় সমুন্নত রেখে এবং মানুষের মত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন ও আত্ম-নির্ভরশীলতা যেমন দরকার তেমনি তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্যও এটি অপরিহার্য। সংসারযাপন এবং শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্র তৈরি করতে নারী-পুরুষ উভয়কেই অংশীদারিত্ব এবং অংশহগ্রহণমূলকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। কাজের পরিবেশও এক্ষেত্রে নিরাপদ এবং সুশৃঙ্খল হতে হবে, তা নইলে কর্মক্ষেত্রে অত্যধিক বোঝা চাপানো হলে মেয়েদের ক্ষমতা ও প্রভাবের অভাবের ফলে তাদের জীবন, স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হবে।
এ বিষয়টি লক্ষ্য করার মত যে, বিশ্বের অনেক দেশে নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং নারীদের জ্ঞান, ক্ষমতা এবং প্রায়োগিক বিদ্যাগুলো অন্যদের কাছে প্রায়শই অচেনা থেকে যায়। নারীর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষত যৌনতা এবং প্রজনন ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। যে কোন দেশের জনসংখ্যা কর্মসূচির দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের জন্য যৌনতা বিষয়ে নারীর মতামত গ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, জনসংখ্যা এবং উন্নয়ন কর্মসূচিতে নারীর অংশগ্রহণ যৌক্তিক পর্যায়ে থাকলে সেই কর্মসূচির ফলাফলও ভাল হয়।
বাংলাদেশে কাজের ক্ষেত্রে নারীরা হয়ত অনেকখানিই এগিয়েছে কিন্তু ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই হার খুবই কম। উচ্চপদে চাকুরিরত নারীর সংখ্যা হাতেগোণা। ঠিক এই কারণে নারীরা তাদের যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে হয়ত একটি কাজই করে কিন্তু সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে নিজের মেধা দিয়ে, দক্ষতা দিয়ে এগিয়ে নিতে খুব কম ক্ষেত্রেই সুযোগ পাচ্ছে। ”আমি নারী” এটি হয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা হবার বড় অন্তরায়। পথ ছিল দীর্ঘ এবং কঠিন, স্বাধীনতার আজ ৪৯ বছর চলে গেলেও এখনো কর্মক্ষেত্রে নারীদের সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে পদে পদে পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে, প্রত্যয় রেখে সেই পরীক্ষায় উৎরে গেলেও পুরুষ সহকর্মীর সংশয়, ”একজন নারীর অধীনে কাজ করবো!”
সংসারেও তাই। পূর্বে যেমন বলেছি, প্রজনন এবং যৌনতার সিদ্ধান্তে নারীর মতামত অনেকক্ষেত্রে গৌণ থাকে। আর এসবের কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য থাকে নাজুক। অনেক নারীকে ভঙ্গুর, দুর্বল মন নিয়ে চাকরি করতে হয়। আর এসবের ফলাফল হয় বেশিরভাগ সময় নেতিবাচক। নারীরা পিছিয়ে আসে কাজ থেকে। এ কারণে কাজ থেকে নারীর ঝরে পড়ার হারও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। মানসিকভাবে দৃঢ় একজন নারী শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, পরিবারের জন্যও আশীর্বাদস্বরূপ। নারীরা পরিবারকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নেয়, এ কাজে পুরুষদের চাইতে নারীর ভূমিকা রাখার অবকাশও অনেক বেশি।
ব্যবসাক্ষেত্রে নারীরা বেশ পিছিয়ে আছে। পিতার ব্যবসার উত্তরসূরি সাধারণত পিতার ছেলেরাই হন, মেয়েটিকে ছোটবেলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণে তার কাছে এসব বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হবার কাজটিও অনেকক্ষেত্রে হয় না। তবু বর্তমানে অনেক মেয়ে ব্যবসায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। এটি হচ্ছে ক্ষমতায়নের চিন্তা থেকেই। এখন মেয়েরা নিজের নামে ট্রেড লাইসেন্স করে নানান ধরণের ব্যবসা করার মতো সাহস অর্জন করেছে।
শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। উন্নয়ন প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণের জন্য নারীর যেমন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন, সেই সাথে নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল শিক্ষা। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে লেখা আছে “প্রত্যেকেরই শিক্ষার অধিকার রয়েছে”। দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রার এক অভাবনীয় চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর সেটা হলো প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের হার। যেখানে ১৯৯১ সালে প্রাথমিকে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল ৪৫ শতাংশ, সেখানে ২০১৩ সালের জরিপে মেয়েদের অংশগ্রহণ দাঁড়িয়েছে অর্ধেকেরও বেশি ৫২ শতাংশ।
জেনেভা ভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের সূচকে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মাধ্যমিক শিক্ষায়ও নারীর অংশগ্রহণের সূচকে এই অঞ্চলের প্রথম ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে শিক্ষার হার ৭৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে নারীশিক্ষার হার ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর এই বয়সীদের মধ্যে পুরুষের শিক্ষার হার ৭৪ শতাংশ। এ হিসাবে নারীশিক্ষার হার পুরুষের চেয়ে ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের ভর্তির হার বর্তমানে ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে প্রাথমিকে মেয়েশিশু ভর্তির হার ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ছেলেশিশুদের ভর্তির হার আটকে আছে ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশে।
উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের হার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে, একজন উচ্চশিক্ষিত নারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহজেই অংশগ্রহণ করতে পারে। গবেষণাকর্মসহ সিদ্ধান্তের প্রায়োগিক ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে মেয়েরা বেশি হারে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলে এমডিজির যে লক্ষ্যমাত্রা তার সুফলও আমরা পেতে পারি।
নারীর ক্ষমতায়ন কোনো একক শব্দ নয়, এটি একটি পদক্ষেপের নাম। একটি সমন্বিত উদ্যোগেরও নাম। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য দরকার যুগ যুগ ধরে চলা চিরায়ত ধারণার অবসান। নারীরা শুধু কাজ করবে না তারা সিদ্ধান্তও নেবে– এই ধারণা বাস্তবায়ন করার জন্য মানুষের মানসিকতারও বদল দরকার।
লীনা দিলরুবা: লেখক ও একটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হেড অব বিজনেস হিসেবে কর্মরত
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]