May 15, 2024
কলামফিচার ৩

জলবায়ুর পরিবর্তন: নারীর ক্ষতি, নারীর সংগ্রাম

সুমাইয়া সেতু ।। জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত বিষয়, কারণ এর প্রভাবে মানুষের জীবন দিনকে দিন বিপন্ন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের প্রভাব নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উপর পড়লেও নারীদের উপর পড়ে অনেকাংশে বেশি। তাই এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও হয় নারীরাই বেশি। সারা বিশ্বে জলবায়ুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে আমাদের পরিবেশবাদীরা। এই লড়াইয়ে একটা বড় অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছে নারীরা।

সারা বিশ্বে বর্তমানে সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ পরিচিত। জলবায়ু কর্মী গ্রেটা মাত্র ১৫ বছর বয়সেই নেমেছিল রাজপথে। গোটা ইউরোপের ছাত্ররা তার নেতৃত্ব মেনেছিল সেই সময়ে। থানবার্গ খুবই মনোযোগী এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।  কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করেন নি তিনি, যখন সমস্ত রাজনৈতিক কর্মী এবং মিডিয়া আপোস করার নতুন নতুন ফর্মুলা তৈরি করছিল, তখন থানবার্গ লড়াই করেছেন দৃঢ়ভাবে।

সারাবিশ্বে নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিল্প কারখানা তৈরি করে যখন পুঁজিবাদীরা লাভবান হচ্ছিল তখন গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গত হচ্ছিল মারাত্মকভাবে; সেই দিকে খেয়াল নেই এইসব কারখানার মালিক পুঁজিবাদীদের। তাদের খেয়াল শুধুই মুনাফার দিকে। অপর দিকে এই গ্রিনহাউজ গ্যাস প্রকৃতিতে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করছে, মানুষের জীবন হচ্ছে বিপর্যস্ত। বর্তমান সময়ে আমরা বাংলাদেশের আবহাওয়ার দিকে তাকালে দেখতে পাবো কি অস্বাভাবিক গরম অনুভূত হচ্ছে। অন্যান্য দেশেও তীব্র তাবদাহ চলে বিভিন্ন সময়ে। অগ্নিকাণ্ডে বিভিন্ন দেশে গাছগুলোতে আগুন ধরে পুড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় ২০% মানুষ এমন এলাকায় বাস করে যেগুলি ইতিমধ্যেই ১.৫ ডিগ্রির উপরে উষ্ণতা অনুভব করেছে।

এই সব অবস্থায় যারাই মানুষের পক্ষে কথা বলেছে তাদের বিরুদ্ধেই চক্রান্ত হয়েছে নানাবিধ, থানবার্গকেও অসংখ্য সমালোচকের লক্ষ্যবস্তু হতে হয়েছে, কেউ  কেউ তার সকল লড়াই সংগ্রামকে নিজের স্বার্থে বলে তাকে ছোট করার চেষ্টা করেছে, তাকে এনজিও-র দালাল হিসেবে মূর্তিমান করার চেষ্টা করেছে, যাতে সে ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু থানবার্গ মনে করে যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা হল একটি গণআন্দোলনকে তিনি প্রচার করতে সাহায্য করেছেন। আন্দোলন গড়ে তোলা তার একার কাজ না, এটি লাখো মানুষের কাজ। শুধু থানবার্গ নয়, সারাবিশ্বে নারীদের আজ নিজ প্রয়োজনেই এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গতভাবে আন্দোলন করতে হচ্ছে। দেশে দেশে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলা মোটেও সহজ কাজ নয়। আমরা যদি আমাদের দেশের সুন্দরবনের দিকে তাকাই, দেখবো, সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে সেই অঞ্চলের মানুষের জীবন কিভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে, এমনকি বাংলাদেশের ফুসফুসখ্যাত সুন্দরবন ধ্বংস হলে আমাদের পরিবেশ কতোটা হুমকির মুখে পরবে তা যে কেউ অনুমান করতে পারে।

শুধু সুন্দরবন নয়, একের পর এক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে বিভিন্ন জেলার পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে। নদীগুলোতে কলকারখানার বর্জ্য পড়ে নর্দমায় পরিনত হচ্ছে, এ সংক্রান্ত নীতিমালার প্রয়োগ নেই কোথাও। বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি করে নিজ দেশের পরিবেশের ক্ষতি করছে ক্ষমতায় থাকা দলগুলো। এই যে কর্পোরেট কোম্পানির দাসে পরিনত হয় আমাদের দেশ পরিচালনাকারী সরকার, তার একমাত্র কারণ হলো মুনাফা, পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। এই দানব কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে অনেক পরিবেশবাদীকে জীবনও দিতে হয়েছে। ফিলিপাইনে কয়লাবিরোধী কর্মী গ্লোরিয়ার কথা আমরা স্মরণ করি। একজন তৃণমূল সংগঠক গ্লোরিয়া সমুদ্রের তীরে শিপইয়ার্ডের কয়লা স্টোরেজ সুবিধার বিরুদ্ধে সত্য প্রকাশ করেছিল।  সেখানে খোলা-বাতাসে কয়লা সংরক্ষণ করায় কালো ধুলোয় এলাকার সবকিছু ঢেকে দিয়েছিল, যার প্রভাব ছিল মারাত্মক। তীব্র শ্বাসকষ্টে কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। গ্লোরিয়া লড়েছিল এসবের বিরুদ্ধে, লড়েছিল তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে। ২০১৬ সালের ১লা জুলাই তাকে হত্যা করা হয়। শুধু গ্লোরিয়া নয়, ফিলিপাইনে ধ্বংসাত্মক খনন, ও অবৈধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরো অনেক পরিবেশবাদীকে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। ফিলিপাইনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরিবেশবাদী হত্যার ঘটনা ঘটেছে। অনেক আদিবাসী, যারা তাদের নিজের জমি রক্ষার জন্যে লড়াই করেছে তাদেরকেও হত্যা করা হয়েছে। মূলধারার মিডিয়ায় কেবলমাত্র বাজারমুখী উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে সংগঠিত মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার ঘটনা প্রচার করা হয়। যেগুলি শোষণের হাতিয়ারকেই শক্তিশালী করে পাশাপাশি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার প্রতিশ্রুতিও দেয় জনগনকে যাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। এতো আয়োজনের পরেও কিছু সাহসী মানুষ সমস্যার মূলে যান এবং সমাধানের পথ খোঁজেন।

জলবায়ু পরিবর্তন সবাইকে একইভাবে প্রভাবিত করে না।  জলবায়ুর পরিবর্তিত অবস্থার জন্য যারা সবচেয়ে কম দায়ী তারাই এর প্রাথমিক প্রভাবের খেসারত সব চেয়ে বেশি বহন করে। জাতিসংঘ এটিকে জলবায়ু বর্ণ বিদ্বেষ হিসাবে বর্ণনা করে। যারা অর্থনৈতিকভাবে ধনী তারা জলবায়ুর খারাপ প্রভাব থেকে নিজেদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলেও যারা দরিদ্র তারা আরো দরিদ্রতার দিকে ধাবিত হয় এবং শারিরীক ও মানসিকভাবে তারা শেষ হতে থাকে। বিশ্বের মোট দরিদ্রদের ৭০% নারী। দরিদ্রতার এই হার দেখে সহজেই অনুমেয় হয় যে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া নারীদের জন্যেই সবচেয়ে কঠিন। অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বস্তুগত সম্পদের অভাব নারীদের দুর্বলতা আরো বাড়ায়, তাই যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। শিশু, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীদের উপর নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। নারীরা তাদের সামান্য সম্পদ হারিয়ে তখন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও যথেষ্ট নারীবান্ধব নয়। সেখানেও নানা রকমের সহিংসতার শিকার হতে হয় নারীদের। সেখানে অপরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের ঘটনাও আমরা দেখতে পাই।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে পুরুষরা শহরে চলে যায় কাজের জন্যে সেখানে তারা নতুন জীবন শুরু করে কিন্তু নারীদের পরিবার ছেড়ে কোথাও যাওয়ার সুযোগ থাকে না, বরং পরিবারের সকলের দায়িত্ব তখন নারীদের একাই সামলাতে হয়। নতুন করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠাও অনেক কষ্টকর ব্যাপার। আমাদের দেশের মতো নামমাত্র উন্নয়নশীল দেশে প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যায়, যা কিনা মানুষের জীবনের জন্যে অশনি সংকেত নিয়ে আসে। এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্যের উপর যে  প্রভাবগুলি দেখায় দেয় তা নিয়ে খুব একটা আলোচনাও হয় না। এসব প্রভাবে যা যা অবনতি হয় তার বেশিরভাগই নারীদের সম্মুখীন হতে হয়, যেহেতু নারীরা পরিবারের শিশু এবং বয়স্কদের সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব বহন করে, তাই ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি পরিচালনা করার দায়িত্ব তাদের উপর বর্তায়। উপরন্তু, তাদের পারিবারিক দায়িত্বের কারণে, তাদের আয় এবং বৈষয়িক সম্পদের অভাবের কারণে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম মাইগ্রেট করতে সক্ষম হয় এবং পুরুষরা যখন কাজের সন্ধানে চলে যায় তখন সকল দায়িত্ব নারীদের হয়।

সারা পৃথিবীতে নারীদের একটা বড় অংশ কৃষিকাজের সাথে জড়িত, যারা উৎপাদন না করলে মানুষকে না খেয়ে মরতে হবে। বৈশ্বিক কৃষি কর্মশক্তিতে ৪৩% নারী জড়িত। বন্যা, খরায় এই সব কাজে ব্যঘাত ঘটে। ফলে মানুষকে অপুষ্টি ও অনাহারে দিন যাপন করতে হয়। আরো একটি বড় সংকট ভোগ করে নিরাপদ পানির। এই নিরাপদ পানির অভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করে নারীরা, তাদের বিশেষ কিছু সময়ে যেমন ঋতুস্রাবে, এবং গর্ভবতী মহিলারা প্রকৃত স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারে না নিরাপদ পানির অভাবে। আমরা দেখেছি কিছুদিন আগে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা নিরাপদ পানির অভাবে তাদের ঋতুস্রাব বন্ধ করে রেখেছিল পিল বা জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ সেবন করে। কারণ সেইসব অঞ্চলের পানি লবনাক্ত হয়ে যাওয়ায় নারীরা চায়না যে তাদের ঋতুস্রাবের কাপড় ওই লবনাক্ত পানি দিয়ে ধোয়া হোক, কারণ লবনাক্ত পানিতে ধোয়া কাপড় ব্যবহার করে ইতিমধ্যে সেই অঞ্চলের অনেকের জরায়ুর সমস্যা হয়ে গেছে। আর ভালো পানি পাওয়ার জন্য যতটুকু গভীরে টিউবওয়েল বসানো দরকার সেটা বসানোর  টাকা বা সামর্থ্যও তাদের নেই। পুকুর বা অন্য উপায়ে তারা সেই সব কাপড় ধুতে পারে না সামাজিক কারণে। অথচ এই পিল খেয়ে পিরিয়ড বন্ধ করে রাখার কারণে তাদের স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে কনডম বা পিল দেওয়া হলেও কম দামে স্যানিটারি প্যাড দেওয়ার কোন ব্যবস্থা করা হয় নি, যদি হতো তাহলে এমন সিদ্ধান্ত আর নারীদের নিতে হতো না। দেশে দেশে জলবায়ু পরিবর্তনে নারীদের উপর প্রভাবকে আলাদা করে সেটির সমাধান করার প্রতি যথেষ্ট উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায় ক্ষমতায় থাকা শাসকদের। বরং পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করে তাদেরকে জীবন দিয়ে লড়াই অব্যাহত রাখতে হয়। জলবায়ুর পরিবর্তনে যেহেতু নারীকেই সব চেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করতে হয় তাই এই লড়াইয়ের তাৎপর্যও নারীদের কাছে অনেক।

জলবায়ুর এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম আসলে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি অংশ এই পরিবেশ আন্দোলন। কারণ পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলেই রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ, যারা দেশে দেশে কর্পোরেট কোম্পানি স্থাপন করে, যারা নামে বেনামে চুক্তি করে বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপন করে, সেই দেশের পরিবেশ ধ্বংস করে, তারা সাম্রাজ্যবাদী। আর নিজ দেশের স্বার্থ চিন্তা না করে নিজেদের পকেট ভারি করার জন্যে শাসক শ্রেণি এই সকল চুক্তি স্বাক্ষর করে রাতের আঁধারে। এইসব শাসকের বিরুদ্ধে একটা সুস্থ পৃথিবীর লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে অবিরাম। পরিবেশ বাঁচলে আমরাও বাঁচবো, নয়তো একদিন আর বাসযোগ্য থাকবে না এই পৃথিবী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *