November 21, 2024
সম্পাদকীয়

পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি পুরুষকে বুঝতে হবে

পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই মানে নারীর পক্ষে আর পুরুষের বিপক্ষে কথা বলা না। মনে রাখতে হবে পুরুষতন্ত্র একটি সিস্টেম, যা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সিস্টেমের প্রধান দর্শন লিঙ্গগত কারণে মানুষের ভেতরে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা এবং একটি লিঙ্গকে অপর লিঙ্গের উপরে স্থান দেয়া। পুরুষতন্ত্র নির্ধারণ করে দিয়েছে নারী দ্বিতীয় লিঙ্গ আর প্রথম লিঙ্গ হল পুরুষ। তাই পুরুষ নারীকে শাসন করতে পারবে। নারী হবে দাস। তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করবে পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।

পুরুষতন্ত্র পুরুষকে সুবিধা দিচ্ছে। এই সিস্টেমে পুরুষ সুবিধাভোগী। নারী নিচুতলার মানুষ। নারীবাদের লড়াই এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে,  পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। কারণ পুরুষও এই সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। পুরুষকে নারীর মালিক করা হয়েছে, তাকে শোষকের ভূমিকায় অভ্যস্ত করা হয়েছে- এর সবই করছে পুরুষতন্ত্র। একইভাবে নারীও শোষিত ও নিয়ন্ত্রিত হতে হতে অভ্যস্ত হয়েছে। নিভৃতে থাকতে থাকতে সেও মেনে নিয়েছে- এটাই জীবন। এই অভ্যস্ততা পিতৃতন্ত্রের দেয়া।

আমাদের বেড়ে ওঠা সামাজিক। আমরা জন্মগতভাবে নারী পুরুষ সিস্টেম নিয়ে জন্মাই না। আমাদের বেড়ে ওঠার ভেতর দিয়ে আমাদের তৈরি করা হয় লৈঙ্গিক চিন্তাচেতনা দিয়ে, অভ্যাস দিয়ে।

পিতৃতন্ত্রে পুরুষও সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাকে থাকতে হয় প্রধান রোজগারকারীর ভূমিকায়। তাকে নিতে হয় সব দায়িত্বের সিংহভাগ। কঠিন জটিল কাজগুলো তাকে দিয়ে করানো হয়। তাকে শারীরিকভাবে শক্তিশালী হতে বাধ্য করা হয়। মানসিকভাবে তাকে কঠিন কঠোর হয়ে উঠতে বলা হয়। এসব করতে না পারলে তাকে লজ্জা দেয়া হয়। নিগৃহীত করা হয় সমাজে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ শুধু নারীর জন্য নয়, পুরুষের জন্যও অভিশাপ বিশেষ।

সমস্যা হচ্ছে, পুরুষকে ভুল বোঝানো হয় যে, এই যে সে এভাবে বেড়ে উঠেছে, এটা প্রাকৃতিক। অথচ সত্য এই যে, এটি প্রাকৃতিক তো নয়ই, বরং এই বেড়ে ওঠা, অভ্যস্ততা, এটি সামাজিক। সমাজ তাকে এভাবে তৈরি করেছে। পুরুষ এই সিস্টেমের বাইরে যেতে পারে না। আবার এই সিস্টেমের কারণেই যে সে বাড়তি বোঝা বয়ে চলেছে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি, এই সিস্টেমই যে তার ভেতরের আবেগ অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করছে, এই সিস্টেমই যে তার প্রকৃত সত্ত্বাকে পরোয়া না করে সম্পূর্ণ অন্য একটি কঠিন মানুষে পরিনত করছে, সেটি সে উপলব্ধি করতে পারেনা। সে হয়ে ওঠে একটি নকল মানুষ, যাকে সমাজ পুরুষ বলে ডাকে, যাকে সমাজ অপর সব লিঙ্গের মালিক হিসেবে চিহ্নিত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত করে।

পুরুষতন্ত্রের এই নোংরা রাজনীতিটি পুরুষকে বুঝতে হবে। নারীকেও বুঝতে হবে। পুরুষতন্ত্র একটি ভারসাম্যহীন ব্যবস্থা যা কখনো মঙ্গল বয়ে আনে না। না নারীর জন্য না পুরুষের জন্য। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই তাই একা নারীর নয়, একা পুরুষেরও নয়। সব লিঙ্গের সব মানুষের লড়াই- একটি সমতাপূর্ণ সুন্দর পৃথিবীর জন্য এই সংগ্রাম সব মানুষের।

ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *