করোনাকাল শেষে পৃথিবীকে ফিরতে হবে নারীশক্তির কাছে
শারমিন শামস্।। করোনাকাল কবে শেষ হবে, জানা নেই আমাদের। যার যার ঘরে দিনের পর দিন বন্দিত্ব মেনে নিয়ে আমরা অপেক্ষা করছি মুক্তির। মেনে নিচ্ছি নানা মানসিক কষ্ট, গৃহকলহ, আর্থিক ক্ষতি, পেশাগত টালমাটাল অনিশ্চয়তা। ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা ভাবনা আমাদের মনকে অস্থির বিপর্যস্ত করছে। তবু মেনে নিতেই হয়। নিজের স্বার্থে, পৃথিবীর স্বার্থে। এই বন্দিত্বেই মুক্তির মন্ত্র লুকিয়ে আছে।
আর যারা কাজ করছেন, চিকিৎসা দিচ্ছেন, সেবা দিচ্ছেন, পাহাড়া দিচ্ছেন, সাহায্য করছেন, পৃথিবীকে গতিশীল রাখতে যাদের থামার উপায় নেই, তারা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসছেন, তারা ঝুঁকি নিচ্ছেন। একদিন আমাদের সবার মিলিত প্রয়াসে নতুন পৃথিবী জেগে উঠবে। কেমন হবে সেই নতুন পৃথিবী?
করোনাকে আমি নিছক একটি ভাইরাস ভাবি না আর। আমাদের জীবনে করোনা এসেছে কালের আয়না হয়ে। করোনা আমাদের বাধ্য করেছে আমাদের নিজেদের দিকে তাকাতে। করোনা আমাদের বাধ্য করছে ভাবতে। যে যুদ্ধবাজ, প্রকৃতিবিরুদ্ধ, প্রাণির প্রতি নিষ্ঠুর, লোভী, ভোগী, চাহিদাবাজ মানবজাতিতে আমরা পরিনত হয়েছি, নিজেদের সেই নষ্ট আত্মার দিকে ফিরে তাকাতে আমাদের বাধ্য করেছে এই ক্ষুদ্র ভাইরাস।
শুধু কি তাই? করোনা মোকাবেলা করতে গিয়ে আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়েছে এক চিরন্তর সত্য। কী সেটা?
সেটি হল- নারীর শক্তি। শেষ পর্যন্ত পৃথিবীকে ফিরতে হবে নারীর কাছে। নারীর শক্তি, ক্ষমতা, দক্ষতা ও যোগ্যতার কাছে। যে নারীকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঊনমানুষ করে রাখা হয়েছিল, যাকে পুরুষের পদানত, অধীনস্ত করে রেখে তার সকল সক্ষমতাকে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল, সেই নারীই এখন পৃথিবীর এই চরমতম দুর্যোগে সবচেয়ে যোগ্য মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। করোনা মোকাবেলার সবচেয়ে সফল ও শক্তিশালী সৈনিকেরা নারী। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুঃসময়ে পুুরুষের তর্জন গর্জন অসার প্রমাণ করে নারীর ক্ষমতা উজ্জ্বল হয়ে সবাইকে আশার আলো দেখাচ্ছে।
এই মুহুর্তে সবচেয়ে আলোচিত নামটি সারা গিলবার্ট। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। এর আগে তিনি পৃথিবীকে বাঁচিয়েছিলেন ইবোলা ভাইরাস থেকে। এখন লড়ছেন করোনার বিরুদ্ধে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকিনোলোজি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর সারা গিলবার্টের তৈরি ChAdOx1 এবং ChAdOx2 এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে মানুষের শরীরে। আর এখানেও আবার সেই নারীই। প্রথম ভ্যাকসিনটি শরীরে নেয়া সেই মানুষটিও একজন নারী। তার নাম এলিসা গ্রানাতো। অক্সফোর্ডের নতুন ভ্যাকসিন প্রথম তার শরীরে দেয়া হয়েছে। শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে তাকে দেয়া হবে করোনাভাইরাস। ভ্যাকসিন কাজ না করলে তার মৃত্যুও হতে পারে। সারা পৃথিবীর কোটি মানুষের জন্য এলিসা এই ঝুঁকি মাথা পেতে নিয়েছেন। ভাবতে পারেন?
সারা দুনিয়াই তো লড়ছে। সবচেয়ে সামনের সারিতে আছেন যারা তারা চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী। আর এদের একটি বিরাট অংশ নারী। বিশেষ করে নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। জীবন তুচ্ছ করে মানুষকে সারিয়ে তোলার ব্রত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে, দিনরাত একাকার করে মানুষের জন্য হাসিমুখে কাজ করছেন তারা।
সারা পৃথিবীই লড়াইরত। দেশে দেশে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানরা নিচ্ছেন নানা ব্যবস্থা। নানান নির্দেশনা দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচাবার যুদ্ধ করছে সরকারগুলো। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জনবান্ধব উপায়ে করোনা মোকাবেলা করছে কোন দেশগুলো?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। যেসব দেশে নারী আছেন সরকারপ্রধান হিসেবে, সেইসব দেশ দারুনভাবে করোনাভাইরাসজনিত দুর্যোগ মোকাবেলা করছে। পুরুষ সরকারপ্রধানদের চেয়ে নারী সরকারপ্রধানরা সফল। পুরো বিশ্ব আজ দেখছে সেটি। দ্রুতগতিতে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে তারা পুরুষ প্রধানদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। এসব দেশে করোনার কারণে ক্ষয়ক্ষতি কম।
জার্মানিতে আক্রান্ত ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫৩ এবং মারা গেছে ৩ হাজার ৮০৪। সুস্থ হয়েছেন ৭৭ হাজার। আক্রান্ত ও মৃতের এই পরিসংখ্যান ইউরোপের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক কম। জার্মান চ্যান্সেলর কোয়ান্টাম রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। তিনি অন্য যে কোনো ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে দক্ষতার সঙ্গে এই করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছেন।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিকা আর্ডেন বিশ্বব্যপি করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনায় এসেছেন। তিনি ১৯ মার্চ দেশের সবগুলো সীমানা বন্ধ করে দেন এবং ২৩ মার্চ থেকে দেশব্যাপী চার সপ্তাহের লক ডাউন ঘোষণা করেন। সেখানে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪০১ জন আক্রান্ত ও নয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন, তার সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের জন্য ফিনল্যান্ডে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার অনেক কম। পঞ্চান্ন লাখ জনসংখ্যার ফিনল্যান্ডে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ২৩৭ জন আক্রান্ত ও মারা গেছেন ৭২ জন।
আইসল্যান্ডে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ১ হাজার ৭২৭, মারা গেছে ৮ আর সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ৭৭ জন। আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্যাটরিন ইয়াকবসদথ একদম শুরুতেই ক্ষিপ্রগতিতে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্তদের খুঁজে বের করা) ও সন্দেহভাজন আক্রান্তদের কোয়ারেনটাইন করার ফলে সেদেশে আক্তান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ মার্চের শুরুর দিকে দুই সপ্তাহের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। পরে দুই দফা বাড়িয়ে এটি ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত নেওয়া হয়। সেখানে জরুরি অবস্থা তুলে নিলেও জনগণকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
ডেনমার্কের আক্রান্ত ও মৃত্যহার কম রাখা সম্ভব হয়েছে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে। প্রধানমন্ত্রী মেট ফ্রেডরিকসেন সম্প্রতি জরুরি অবস্থা শিথিল করলেও মার্চের শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন শ্রমিকদের বেতনের ৭৫ শতাংশ সরকার থেকে দেওয়া হবে।
এছাড়াও আরও কিছু দেশ রয়েছে যেগুলোর নারী সরকারপ্রধানরা করোনা পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। মাত্র ৪২ হাজার জনসংখ্যার ছোট্ট ক্যারিবিয়ান দ্বিপ সিন্ট মার্টিনের প্রধানমন্ত্রী সিলভেরিয়া ইয়াকবস বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন। দুই সপ্তাহের জন্য সেখানকার নাগরিকদের একদমই জনসমাগম বন্ধ করে দেন। জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, ‘ঘরে যদি রুটি না থাকে তাহলে ক্র্যাকার্স জাতীয় বিস্কিট খান, সিরিয়াল বা ওটস খান। তবু ঘরে থাকুন।’
পুরুষের চেয়ে নারীর সংবেদনশীলতা ভাল। ধৈর্য ও স্থিতিও তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্যপক্ষে পুরুষের কঠোর, কঠিন ও যুদ্ধবাজ সত্ত্বাটি বেশি ক্রিয়াশীল। আজ তো এটাই প্রমাণিত যে আমরা একটি যুদ্ধপ্রবণ, অস্ত্রশস্ত্রে ভরপুর পৃথিবী বানিয়েছিলাম। অন্যপক্ষে অবহেলা করেছি প্রাণপ্রকৃতিকে। নিজেদের শরীর ও মনের স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিইনি। একটি যান্ত্রিক নষ্ট পৃথিবীর দায় কিন্তু সবটাই সেইসব সরকার প্রধানদের, যারা বছরের পর বছর জুড়ে ক্ষমতার লোভে পৃথিবীতে যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছেন, বাণিজ্যের লোভে পরিবেশ ধ্বংস করেছেন , মানুষের উপরে যারা স্থান দিয়েছেন আধিপত্য আর অর্থকড়িকে। আর দুর্ভাগ্যবশত সেইসব প্রধানদের সবাই পুরুষ। পুরুষ তার পৌরুষের অহংকারে সারা পৃথিবীকে একটি উন্মাদ বাসস্থান বানিয়ে ছেড়েছে। আর আজ এই বিপদের দিনে নারীর সংবেদনশীলতা, নারীর ক্ষমতা, নারীর তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা এবং নারীর জনমানুষপ্রবণ চিন্তাধারা আমাদের উদ্ধার পাবার পথ দেখাচ্ছে।
করোনার পরে নতুন যে পৃথিবী, সেটি তাই হবে নারীর ক্ষমতা ও শক্তিমত্তাকে উর্ধ্বে তুলে ধরবার পৃথিবী। নারীকে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের স্থানটি ফিরিয়ে দেবার পৃথিবী। নারীকে তার দক্ষতা দেখাতে দেবার পৃথিবী।
করোনা চলে যাবে। কিন্তু প্রত্যাশা করি, রেখে যাবে একটি সুন্দর বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানবজাতিকে, যারা জীবনের তাগিদেই এবার নিজেদের নষ্ট চরিত্রের দিকে তাকিয়ে আত্মশুদ্ধির পথে হাঁটবে।
ভালবাসা ও শুভকামনা সকলের জন্যে।