বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
সৈয়দ মাহমুদ।। জন্মের পর থেকেই আমাদের সমাজে সাধারণভাবে আমরা যা দেখি তা হল, মায়েরা সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করছেন। গৃহস্থালী কাজ ও ছেলেপুলে মানুষ করাই তাদের মুখ্য দায়িত্ব। এটি এক ধরণের বাধ্যবাধকতা, এভাবেই চলে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। ঘরের বাইরে যাবার সময় কোথায় নারীর? আবার এই দায়িত্ব পালনের পরও কি এই সমাজ তার কাজটাকে সম্মানের কাজ বলে গণ্য করছে?
সামাজিক স্বীকৃতিহীন একটি কাজ নিয়ে নারীকে কাটাতে হয় তার পুরোটা জীবন। প্রশ্নটিও সে কারণে এভাবে করা হয় যে, “আপনি কি চাকুরি করেন নাকি গৃহবধু?” পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুটি মায়ের অপার স্নেহে বেড়ে উঠতে উঠতে দেখছে তার মা একটা মূল্যহীন কাজে নিয়োজিত, পান থেকে চুন খসলেই যেখানে নিগ্রহ অবধারিত। ঠিক একই কারণে নারী শিশুটি পরিবারে নানা ভাবে বঞ্চিত হতে থাকে। যেহেতু সে বড় হয়ে সেই মূল্যহীন কাজ- সংসারের দায়িত্বে নিয়োজিত হবে তাই তার জন্য ভাল খারারটা নয়, বেশি লেখা পড়া দরকার নেই বরং তাকে পাকা গৃহিনী হিসেবে তৈরি করাটাই যুক্তিযুক্ত।
পরিবার থেকে আমরা পাই ধর্ম। সেই ধর্মীয় শিক্ষায় নারীকে যেভাবে মূল্যায়ণ করা হয়েছে সে ভাবেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। প্রসঙ্গত বলতেই হয় ধর্মে নারীর সত্যিকার আসন কোনটি তা খুঁজে বের করা অত্যন্ত দূরহ কর্ম। স্বয়ং ঈশ্বর কী বলছেন আর পঁয়ত্রিশ লক্ষ হাদিস প্রনেতারা কে কি বলছেন তার মীমাংসা করতে গেলে পঁয়ত্রিশ লক্ষ না হলেও পঁয়ত্রিশ হাজার বছর ব্যয় করতে হবে। তাই সেই দুরূহ কর্মে ব্যাপৃত না হয়ে বরং আমাদের মস্তিস্ক সেভাবেই বিষয়টি গ্রহণ করছে, প্রতিনিয়ত আমাদের কানে যা প্রবেশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। স্বল্প শিক্ষিত ও কুশিক্ষিত তথাকথিত আলেমসমাজখ্যাত লেবাসী মওলানা মসজিদে এবং ওয়াজ মাহফিলে যন্ত্রণাদায়ক চিৎকারে যেভাবে নারীকে নিচু নোংরা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, তার প্রভাবে আমাদের মননে নারী সম্পর্কে এক ধরণের নেগটিভ অ্যাটিচিউড তৈরি হতে বাধ্য।
একটি ছোট দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। মৌলানা সাহেব নারী নিগৃহীত হওয়ার কারণ বর্ণানা করছেন- যে যুবতী নারী আটসাট পোশাক পরে রাস্তায় বের হল, তার প্রতি যখন আমার যুবক ভাইদের দৃষ্টি পড়ে তখন তাদের একটু চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটতেই পারে।
এমন কথা শোনার পর ওনার যুবক ভাইয়েরা রাস্তায় দেখা যুবতী নারীকে উত্যক্ত করবে না কি ধর্ষণ করতে উৎসাহী হবে তা একবার তিনি ভেবে দেখলেন না। তিনি বললেন না যে, হে আমার যুবক ভাইয়েরা তোমরা তোমাদের দৃষ্টিকে সংবরণ কর, তোমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নাও, তোমরা সংযম পালন করো, তোমরা তোমাদের নফস্ কে নিয়ন্ত্রণ করো। এখানে যুবক ভাইয়েরা যে বার্তাটি পেয়ে গেল তা কিন্তু ধর্ম থেকেই উৎসারিত বলে পরিগনিত হয়ে গেল।
রাষ্ট্র আমাদের কী বার্তা দেয়! রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে যে নীতি অনুসৃত হচ্ছে তা কি নারীবান্ধব? রাষ্ট্র কি নারীর প্রতি বৈষম্য মূলক আচরণ করছে না? রাষ্ট্র কি মানুষ হিসেবে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর একদম পরিস্কার, না দিচ্ছে না। কিছু কিছু উদ্যোগ পরিলক্ষিত হলেও তা বাস্তবায়নে ধীর গতি এবং অনীহা স্পষ্টতই দেখা যায়। যিনি বা যারা বাস্তবায়ন করবেন তারাই নারীর প্রতি তাদের দীর্ঘ দিনের চলে আসা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তণ করতে পারেন না। তাই আইন প্রয়োগ বা বাস্তবায়নে তাদের অনীহা। নারী সর্বক্ষেত্রে এতটাই পিছে পড়ে আছে যে তাদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় নিতে গেলে কোটা পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়, যদিও নারী সর্বক্ষেত্রে তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই যে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়া বা বৈষম্যের শিকার হওয়া, এতে করে নারী যে অবস্থানটিতে দাঁড়িয়ে আছে তা সমাজে বসবাসকারীদের মনোজগতে একটা বার্তা দেয়, তা হলো এদের জন্মই হয়েছে সব সময় নিচুতে থাকার জন্য, কেন এরা পুরুষের সমকক্ষ হবে!
বিজ্ঞাপনে নারীকে পন্য হিসেবে অবাধে ব্যবহার করে তাকে অসম্মান করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বহুজাতিক কোম্পানীর তৈরি বিজ্ঞাপন প্রচারে মিডিয়াগুলো বাধ্য হচ্ছে এক রকম টিকে থাকার লড়াই বলে। এখানে কোনো নৈতিকতার প্রশ্ন অবান্তর। পয়সা গুনবে যারা, তারা তো মিডিয়া শাসন করবেই! আর সে যদি হয় বেসরকারী মিডিয়া তবে তে কথাই নেই। এখান থেকেও সমাজে বসবাসকারীদের মনোজগতে একটি বার্তা যায়, নারী তো আসলে ভোগ্য পন্য।
পরিবার, ধর্ম, রাষ্ট্রনীতি এবং বিজ্ঞাপন-এই চারের সমন্বয়ে সমাজে নানাভাবে নারী বঞ্চিত, অবহেলিত, নিগৃহীত, নির্যাতিত এবং পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়। কেননা পুরো সমাজের মনস্তত্ত্বই সে ভাবে গড়ে উঠেছে। এখানে মনস্তত্ত্বই সব থেকে বড় ফ্যাক্টর বা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তাহলে উত্তরণের পথটা কোথায়!
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে মনস্তত্ত্ব ধারণ করে সমাজ গড়ে উঠেছে তার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেই পুরোনো মনস্তত্ত্বকে পরিবর্তন করা। কিছু লোক দেখানো আইন করে বা তার কঠোর প্রয়োগ দেখিয়ে হয়ত সাময়িক কিছু ফললাভ হলেও হতে পারে কিন্তু প্রকৃত অর্থে সুদূর প্রসারী কোন পরিবর্তন আসবে না। এজন্য প্রয়োজন বাস্তব সম্মত কার্যকর উদ্যোগ, সেটি আসলে কি?
প্রথমতঃ শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার সকল স্তরের সিলেবাস হবে নারীবান্ধব। অর্থাৎ সিলেবাস এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা নারী সম্পর্কে কোনো প্রকার নেগেটিভ বার্তা না পায়, যেখানে নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে শ্রেনিভেদ করা হবে না বরং মানুষ হিসেবে সকলের মর্যাদা সমুন্নত করার গাইড লাইন থাকবে। ধর্মীও শিক্ষায়ও নারীর প্রতি বিরূপ এবং অবমাননাকর নির্দেশিকাপ্রত্যাহার করে মর্যাদাসম্পন্ন কন্টেন্ট অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর এই উদ্যোগের মাধ্যমে সুদূরপ্রসারী ফললাভ সম্ভব।
দ্বিতীয়তঃ ভাবতে হবে, চলমান পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করা যায়। বর্তমান নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দরকার নানা উদ্যোগ।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে যে সকল সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম চলমান রয়েছে সেগুলো যাতে শুধু লোক দেখানো শ্লোগানসর্বস্ব না হয়ে সত্যিকার কার্যকর পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে সে জন্য রাষ্ট্রের একটি সমন্বিত কর্মসূচী থাকতে হবে। এই কর্মসূচীর আওতা বা পরিধি বাড়িয়ে তাকে নিয়ে যেতে হবে পারিবারিক পর্যায় পর্যন্ত, প্রতিটি পরিবারে যেন সেই বার্তা লো পৌঁছানো যায়।
যে সব শিথিল আইন বলবৎ আছে সেগুলোকে কঠোর এবং যুগপোযোগী করতে হবে এবং সকল ফাঁক-ফোকর বন্ধ করতে হবে।
মসজিদ-মাদ্রাসা সহ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বা ওয়াজ মাহফিলে যেন নারীর প্রতি বিষোদগার না হয় বা ধর্মের অপব্যাখ্যা, ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নারীর মর্যাদাহানির চেষ্টা না হয় এজন্য কঠোর আইন প্রনয়ন এবং তার বাস্তবানুগ প্রয়োগ করতে হবে।
নারীকে পন্য হিসেবে যাতে ব্যবহার না করা হয় এজন্য বিজ্ঞাপন নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে এবং তা মেনে চলতে সিংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে বাধ্য করাতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়াতে ধর্মের নামে নারীর সম্মানহানিকর যেসব কন্টেন্ট আপলোড করা হয়ে থাকে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এমন কাজ না হয় তার ব্যবস্থাসহ শাস্তির বিধান করতে হবে।
এমন একটি সমাজ তো শিক্ষিত বিবেকবান মানুষ মাত্রই কাম্য যে সমাজে নর আর নারী হেঁটে যাবে হাত ধরে। যেখানে কিশোরী বা তরুনী রাস্তায় টিজের শিকার হবেনা, নিগ্রহের শিকার হবেনা বা চলতি পথে ধর্ষণের শিকার হবে না। যে সমাজে কর্মক্ষেত্রে নারী সম্মানের সাথে কাজ করে যেতে পারবে, চলন্ত বাসে নারীকে দেখলে একজন পুরুষ সম্মানের সাথে তার আসন ছেড়ে দেবে আর পরিবারে নারীর সম্মান হবে যথার্থ।
এখন কথা হচ্ছে, যে স্বপ্নের সমাজের কথা বলছি, সেখানে যেতে হলে যে রাস্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার তা অনুধাবন করে বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে?
সৈয়দ মাহমুদ: লেখক ও গল্পকার
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের কলাম বিভাগে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]