May 15, 2024
কলামফিচার ২

রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরি ও ভিক্টিম সাংবাদিক রোজিনা

অ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন ভুইয়া।। রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি চুরির অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে। কিন্তু আইনের বিধানে এই সাংবাদিক পাল্টা নির্যাতন মামলা করতে পারেন। রোজিনা পাল্টা মামলা করতে পারবেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। কারণ তাকে বেআইনিভাবে পাঁচ ঘণ্টা আটক করা হয়েছে। সেখানে মানসিক নির্যাতনও করা হয়েছে।

এই গণমাধ্যমকর্মীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটা সত্য হলেও তাকে পাঁচ ঘণ্টা মন্ত্রণালয়ের আটকে রাখার কোনো আইনি সুযোগ ছিল না। এটি ২০১৩ সালে করা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সোমবার বিকেলে এই গণমাধ্যমকর্মী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে গোপন নথি সরানোর কথিত অভিযোগে আটক হন। বেলা দুইটা ৫৫ মিনিটের দিকে এই ঘটনা ঘটে বলে শাহবাগ থানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। রোজিনাকে থানায় নেয়া হয় রাত সাড়ে আটটার পরে। অর্থাৎ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা তিনি মন্ত্রণালয়েই ছিলেন। পরে রাত ১১টার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করা অভিযোগটি মামলা হিসেবে নিবন্ধন করে রোজিনাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

আমাদের যে জায়গাটা কথা বলা দরকার, সেটা হলো সাংবাদিক রোজিনাকে যে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখলেন, এই আটকে রাখার আইনি এখতিয়ার কেবল সচিব কেন, কারোরই নেই। এই ধরনের কোনো আইনি এখতিয়ারই তাদের ছিল না। তারা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাকে আটক রেখেছেন এবং এটা ফৌজদারি অপরাধ।

২০১৩ সালে হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু নিবারণ আইনে বলা হয়েছে, যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা বা তার অফিস যদি নির্যাতন করে তাহলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর এই নির্যাতন বলতে কেবল শারীরিক নির্যাতন হতে হবে, তা নয়, মানসিক নির্যাতনকেও আইনে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাই সাংবাদিক রোজিনা এদের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার পাওয়ার আইনি অধিকার রাখেন।

আমরা যদি ধরেও নেই যে রোজিনা নথি চুরিও করে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল সাথে সাথে। তাকে পাঁচ ঘণ্টা আটক রাখার কোনো এখতিয়ার তাদের ছিল না। তারা প্রমাণ করতেন, রোজিনা তার বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করতেন। কিন্তু তাকে নির্যাতন যখন করা হলো তিনি নিজে ভিকটিম হয়ে গেলেন। তিনি আর অ্যাকিউজড (অভিযুক্ত) নন। এখন রোজিনা প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করা মামলার এজাহারে বলা হয় বিকেল দুইটা ৫৫ মিনিটে রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে সচিবের একান্ত সচিবের দপ্তরে ঢোকেন। তখন একান্ত সচিব দাপ্তরিক কাজে সচিবের কক্ষে অবস্থান করছিলেন। সে সময় রোজিনা ইসলাম দাপ্তরিক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকানোর পাশাপাশি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তোলেন।

সচিবের দপ্তরে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মিজানুর রহমান খান বিষয়টি দেখতে পেয়ে রোজিনাকে বাধা দেন। আর নির্ধারিত কর্মকর্তার অনুপস্থিতে তিনি ওই কক্ষে কী করছেন, তা জানতে চান। এ সময় রোজিনা নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেন।

অতিরিক্ত সচিব তল্লাশি করে রোজিনার কাছ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাজগপত্র এবং নথির ছবি সংবলিত মোবাইল উদ্ধার করেন। এই সমস্ত অভিযোগ একপেশে কারণ সচিবালয়ের মত নিচ্ছিদ্র নিরাপদ যায়গায় পূর্বানুমতি ছাড়া কেউ নথি বের করে দেখার সুযোগ পাওয়ার কথা না। কেউ হয়তো তাকে অনুমতি দিয়েছেন বা অনুমতি দেবার কথা বলে ফাঁদে ফেলে ফাঁসিয়েছেন। এটাও একটা অপরাধ।

এই অভিযোগ মতে সর্বোচ্চ সাজা কী?

রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে মোট চারটি ধারায়। এগুলো হলো দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারা। এই চারটি ধারায় সর্বোচ্চ সাজা আছে তিন বছর এবং সঙ্গে জরিমানা হতে পারে। দন্ড বিধির ৩৭৯ ধারায় চুরির সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড কিন্তু ৪১১ ধারায় বলা হয়েছে চুরির মাল বলে কেউ জানার পরে সেই মাল যদি অন্যের দখলে দেয় সেটাও একটা অপরাধ। কারণ এটা কেবল আইন প্রয়োগকারি সংস্থা করতে পারে। তাই রোজিনার বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ যারা তার কাছ থেকে মাল ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও এই ধারার বিধান কার্যকর।

অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে-১৯২৩ এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় কিংবা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করে বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে তবে সে অপরাধী হবে।

একই আইনের ৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে যে, নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নক্সা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না।

৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো বিদেশী এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে খবর সংগ্রহ করা যাবে না।

৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো সংবাদ পেয়ে থাকলে সেই সংবাদ প্রকাশ করতে পারবে না। কোনো সংবাদপত্র যদি কোনো গোপন সংবাদ প্রকাশ করে তবে প্রতিবেদক, সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রকাশক অপরাধী হবেন। এসব কাজে সহায়তা করা অপরাধ বলে গণ্য হবে।

এখানে প্রমান সাপেক্ষ যে, সাংবাদিক রোজিনা নিষিদ্ধ এলাকায় গিয়েছিলেন কিনা, নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নক্সা প্রকাশ করে দিতেন কিনা, তার কোন বিদেশি এজেন্ট এর সাথে যোগাযোগ ছিল কিনা, যদি কিছু গোপনীয় বিষয় জেনেও থাকতেন তা প্রকাশ করে দিতেন কিনা।

অ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন ভুইয়া: আইনজীবী জজ কোর্ট, ঢাকা ও কুমিল্লা