এদেশের পুরুষ নারীকে অথর্ব করে রাখতে চায়!
আঞ্জুমান রোজী।। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীরা যে পরিমাণ পরিশ্রম করে সক্রিয় ভূমিকা রেখে যাচ্ছে, সেই পরিমাণ ভূমিকা কি পুরুষ নারীর পাশে থেকে রাখছে? রাখছে না। এটা সত্য যে, নারীমুক্তি আন্দোলনের শুরু থেকে পুরোধা হিসেবে কিছু পুরুষের নাম অবশ্যই আসে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই প্রশ্ন করি , বর্তমান সময়ে পুরুষের সেই অর্থে কোনো ভূমিকা কি লক্ষ্য করা যায়? করা যায়না। যদিও নামমাত্র কিছু পুরুষ নারীবাদী ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করছে, তবে তাদেরকেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষগুলো দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়, হতে হয় ধিকৃত। আমার বক্তব্য অধিকাংশ পুরুষ নিয়ে, যারা নারীকে দুর্বল দেখতে ভালোবাসে। ভালোবাসে নারীকে অধীনস্থ এবং করায়ত্ত করে রাখতে। নারী শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভর করে চলবে এটাই অনেক পুরুষের খায়েশ।
যে সমস্ত নারীরা এখনো পরাধীন জীবনযাপন করে; যেমন, বাবা, স্বামী, ছেলের উপর নির্ভর করে চলে, তাদের উদ্দেশ্যেই আমার এই লেখা। আমাদের মতো গুটি কয়েক নারী যারা অধিকার সচেতন , তাদের নিয়ে কিন্তু এই সমাজ না। অধিকাংশ নারীই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কষাঘাতে জর্জরিত। আমার আশেপাশে এমন নারীই বেশি যারা পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এদের অনেকেই সমাজ, সংসার আর সন্তানের কথা চিন্তা করে সব অত্যাচার মাথা পেতে নেয়। এসব নারী উচ্চশিক্ষিত হলেই কি, আর পদমর্যাদায় ভালো উপার্জনক্ষম হলেই কি, সব অবস্থাতেই নারী অপদস্থ আর হেয় হচ্ছ। নারীকে রাখা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে। উন্নতবিশ্বে নারীপুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা পেলেও উন্নয়নশীল দেশে এখনো নারীর অবস্থা মানবেতর পর্যায়ে আছে।
নারী দুর্বল থাকলে পুরুষের অনেক ক্ষেত্রে সুবিধা হয় বৈকি। বিশেষ করে সেক্সচুয়াল ডিজায়ার ইচ্ছে মতো ফুলফিল করতে পারে। এটা পুরুষের প্রাকৃতিক স্বভাব কিনা জানি না। তবে তাদের মানসিকতাটা এমন যে ক্ষমতার কর্তৃত্ব দেখানোই হল মোদ্দাকথা। আর এই ক্ষমতার কারণে পুরুষের বহুগামী স্বভাবটাও অনেকাংশে প্রকাশ পায়। তখন তাদের স্বার্থ সুবিধা আদায়ের জন্য নারীর কোনো ভূমিকাই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনা। নারীকে সর্বাবস্থায় দুর্বল দেখতে পছন্দ করে। নারীও দুর্বল চিত্তে পুরুষের আচরণ মেনে নেয়। ভেবে নেয়, এটাই সত্য এবং এখানেই আছে প্রকৃত ভালোবাসার আশ্রয়। আসলে কি তাই? পুরুষের অসুর ভূমিকার কাছে নারীর কোনো ভূমিকাই থাকেনা কেন?
নারী দুর্বল হলে পুরুষের আরো অনেকদিক থেকে সুবিধা আছে। নারীকে একজন পুরুষের সেবাদাসী করে রাখা যায়। তার ইচ্ছের হুকুমে নারীকে চালাতে পারে। এমন আয়েশী অনুভূতি রেখে কোন পুরুষ চাইবে নারী মানুষ হয়ে উঠুক! পুরুষ দ্বারা প্রবর্তিত, নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত ধর্ম ও সামাজিক প্রথা, নারীকে বন্দী করে রেখেছে। পুরুষের এমন কি দায় পড়েছে, তাদেরই বানানো বন্দিদশা থেকে নারীকে মুক্ত করে! নারী যত অবলা হয়ে থাকবে ততই পুরুষের লাভ। এই হিসাবটা পুরুষ ভালোমতো জানে বলেই, নারীকে অধীনস্থ করে রাখতে ভালোবাসে। তাছাড়া অধিকাংশ পুরুষ দুর্বল, বুদ্ধিহীন নারীকেই বেশি পছন্দ করে। এতে নারীকে ব্যবহার করতে সুবিধা হয় বৈকি !
পুরুষ মাত্রই যৌন লিপ্সায় আক্রান্ত জীব। যার কারণে বেশিরভাগ পুরুষ কখনই স্থির নয়। বলতে গেলে, এটা তাদের স্বভাবজাত বিষয়। তাছাড়া তাদের অস্থিরতার সঙ্গে যদি থাকে ক্ষমতার আস্ফালন, তাহলে তো ধরাকে সরা জ্ঞান করে বসে। এখানে হয়তো বলবেন, বর্তমান সময়ে এমন নারীও অনেক আছে। সেক্ষেত্রে যুগযুগ ধরে পুরুষের ব্যভিচার সবচেয়ে বেশি। পুরুষ দ্বারা আক্রান্ত নারীর আত্মাহুতির সংখ্যাও কম নয়। এসব দেখে বিবেকবান সমাজ কখনো কখনো কেঁপেও ওঠে। কিন্তু, তারপর! পুরুষ কি সেই অর্থে কোনো জোরদার ভূমিকা রাখছে? না রাখছে না। কারণ, এতে পুরুষের পুরুষালী অহংকার কিছুটা হলেও যে খর্ব হয়।
একটা বিষয় লক্ষ্য করেন, একজন নারী যখন কোন পুরুষ দ্বারা লাঞ্চিত হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, তখন কি অন্য পুরুষ নারীটির পাশে এসে দাঁড়ায়? ক্ষেত্র বিশেষে দাঁড়ায়না। আর যদিও দাঁড়ায় তা সামাজিক চাপে পড়েই দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে নারীটি যদি কোনো পুরুষের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করে তখন নারীটিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিজের করায়ত্ত করে ফেলে। আর নিপীড়নকারী পুরুষটিকে বাইরের হাওয়া খেতে সুবিধা করে দেয়৷ কারণ, মনে মনে এই পুরুষটিও যে এমন। তাই, যারা বাস্তবে বিবেকের তাড়নায় এমন কাজ যখন করতে পারেনা তখন মনের খায়েশ মনে রেখে অন্যপুরুষের কুকর্মকে সমর্থন দিয়ে যায়। যার ফলে দেখা যাচ্ছে, নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে এসমস্ত পুরুষ অবচেতনেই কি, চেতনেই কি মনে মনে বিরূপভাব প্রকাশ করে যাচ্ছে।
আরো একটা বিষয়, যখন নারীরা সোচ্চার হচ্ছে , প্রতিবাদ করছে বা তেড়ে উঠছে, তখন সেই নারীটি হয়ে যাচ্ছে সব পুরুষের চক্ষুশূল । এক পুরুষের বিরূপ আচরণের বিরুদ্ধে এক নারী প্রতিবাদ করলে অন্য পুরুষগুলো ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়। দূরে সরে গিয়ে সেই কুলাঙ্গার পুরুষটাকে সঙ্গ দেবে। সেইসাথে নারীটির পিছনে কুৎসা রটাতে শুরু করে। অনেকটা দলবদ্ধ কাকের স্বভাবের মতো। এতেই কি বোঝা যায়না , সব পুরুষের মানসিকতা এক! হ্যাঁ, এসব ক্ষেত্রে কোনো কোনো পুরুষ নারীর পক্ষ নিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এদের সংখ্যা কত? বলতে গেলে এক শতকরা একভাগও না। তাছাড়া প্রতিবাদী নারীকে কোনো পুরুষ সেভাবে পছন্দও করেনা। পুরুষের কাছে নারী হবে নরম কোমল আবাল প্রকৃতির।
একজন শিক্ষিত সচেতন নারী বোঝে এবং জানে কিভাবে নিজেকে পরিচালনা করতে হয়। সেইসাথে যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও সক্ষম হয়। বর্তমান শিক্ষিত নারী সমাজ এই বিষয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ফেলেছে৷ তারজন্য নারীকে কী পরিমান ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, আর কী পরিমাণ যুদ্ধ করতে হয়েছে তা একমাত্র ভুক্তভোগী নারীমাত্রই জানে৷ কিন্তু সব নারী কি পারছে এই পথ অতিক্রম করতে? এখনো অধিকাংশ নারী সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতার মধ্যে পড়ে আছে। এদেরকে পুরুষের বিষাক্ত ছোবল থেকে তুলেও আনা যাচ্ছেনা। কারণ, সব অবস্থায় পুরুষের মানসিকতা একইরকম বলে।
যে দেশে রিক্সাওয়ালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের দেখিয়ে তার শিশ্ন নাড়াচাড়া করে, যে দেশে মজনুর মতো পুরুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণ করার সাহস রাখতে পারে, সে দেশের পুরুষের মানসিকতা কোন লেভেলে ওঠানামা করে তা মাপা হয়ে যায়। কারণ, সব পুরুষের মানসিকতা একইরকম বলে ঐ সমস্ত পুরুষ নারীর অবস্থান ভ্রূক্ষেপ করে গায়ে হাত দেয়ার দুঃসাহস দেখায়। এসব বিষয়ের প্রতিকার করা যেতো যদি সব পুরুষ সোচ্চার হতো। অথচ, পুরুষ ধরেই নেয় এটা পুরুষের ধর্ম, পুরুষ এমন করবেই। এমন কথাও পুরুষের কাছ থেকে শুনেছি, নারী কিভাবে নিজেকে সামলাবে সেটা নারীর ব্যাপার৷ পুরুষের কাজ পুরুষ করবেই৷ একটা সমাজের মানসিকতা যদি এমন হয় তাহলে নারী মুক্তি আসবে কেমন করে?
যে দেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই হচ্ছে নারী, সেখানে নারীর সমস্যা একমাত্র নারীর থাকে কেমন করে? যেখানে নারীকে কেন্দ্র করে পরিবারের সবকিছু আবর্তিত। সন্তান জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটা ধাপেই নারীকে প্রয়োজন হয়। অথচ এই নারীকেই পুরুষশাসিত সমাজ অচল, অথর্ব, অবলা করে রাখতে চায়। পুরুষগুলো উন্নতির কথা বলছে চারদিকে, প্রগতির কথা বলছে জোরেশোরে, কিন্তু নারীকে এগুতে দিবেনা। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে সমাজ সংসার রাষ্ট্র চলে কি করে। চলছে যে না, তাতো হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। নারীকে যতদিন পুরুষ তার নিজের হাতের মুঠোয় রাখার মানসিকতা বর্জন না করবে অর্থাৎ ক্রীড়নক বানিয়ে না রাখবে, ততদিন নারীর মুক্তিও আসবে না। শক্ত আইনের কঠিন প্রয়োগে হয়তো নারী নির্যাতন কিছুটা হলেও দমন করা সম্ভব। কিন্তু প্রতিটি পুরুষ যতদিন নারীর পাশে এসে না দাঁড়াবে, নারীমুক্তির আন্দোলনে সামিল না হবে ততদিন কোনো সমস্যার সমাধান দেওয়াও সম্ভব নয়।
আঞ্জুমান রোজী: কথাসাহিত্যিক
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]
আরও পড়ুন- নারীবাদ শব্দে কিছু মানুষের এত বিদ্বেষ কেন?