May 16, 2024
নারী'র খবরবিদেশফিচার ৩

ন্যাড়া মাথা, ডায়াপার আর পিল: করোনা যুদ্ধে এক নার্সের অভিজ্ঞতা

চীনের হুবেই প্রদেশের একজন নারী স্বাস্থ্যকর্মী নার্স ঝাং ওয়েনডেন। পেশাগত কারণে তাকে করোনা যুদ্ধে সামিল হতে হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঝাং ওয়েনডেনের সাক্ষাৎকারমূলক একটি লেখা প্রকাশ করে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সেটি ভাবানুবাদ করেছেন লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট ফাহমি ইলা।। 

‘চীনে প্রথমসারির নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ঋতুস্রাব একটি পেশাগত ঝুঁকিতে পরিনত হয়েছে’

২৭ বছর বয়সী নার্স ঝাং ওয়েনডেন যেদিন হাসপাতাল থেকে নোটিশ পেয়েছিলেন, সেদিন তিনি পরিবারের সাথে চীনা নববর্ষ উৎযাপন করছিলেন। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের যুদ্ধে অন্য সবার মত সামিল হবার জন্য তার কাছে নির্দেশ আসে। মিস ঝাং হুবেই (Hubei) প্রদেশের হুয়ানগ্যাং (Huanggang) শহরে বাস করেন এবং এ শহরেই মূলত করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি। ঝাং যেদিন হাসপাতালের নোটিশ পান তার ঠিক দু’দিন আগেই ভাইরাসটি যেন না ছড়ায় সেজন্য এই শহরটিকে লকড ডাউন করা হয়। মিস ঝাং যখন হাসপাতালে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন ঝাংয়ের মা পাশে বসে নীরবে কাঁদছিলেন।

মিস ঝাং জানান হাসপাতালে একজন নারী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা ছিলো চরম যন্ত্রণাদায়ক। অন্যান্য সহকর্মীদের মত মিস ঝাং স্যুটের নিচে ঘাম শুষে নেয়ার কাপড় পরতে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হন। তারা মেনে নেন যে তাদের পর্যাপ্ত পরিমানে মাস্কও নেই। কিভাবে একটা প্রতিরক্ষামূলক স্যুট পরে আবার দ্রুততম সময়ে খুলে ফেলা যায় তা তাদের শিখে নিতে হয়েছে দ্রুততম সময়ে।

ব্যক্তিগত হাইজিন রক্ষা ও সুবিধার জন্য হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইন জোনে কর্মরত অবস্থায় মিস ঝাং তার চুল কেটে ফেলেন। (খোলা চুলের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে ভেবে এবং দ্রুতসময়ে মাথায় মেডিক্যাল ক্যাপ পরার সুবিধার্থে চীনের প্রায় সব নার্স, ডাক্তাররা তাদের চুল কেটে ছোট করে ফেলেন এবং কেউ কেউ একদমই ছেটে ফেলেন)। উল্লেখ্য, মিস ঝাং ত্রিশ দিনের অ্যাসাইনমেন্টে হাসপাতালে এই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। যেসব নারীকর্মীরা রোগীদের সেবা দেয়ার সুবিধার্থে তাদের মাথার চুল ছেটে ফেলেন, তাদেরকে চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়া করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ‘সবচেয়ে সুন্দর যোদ্ধা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। মিস ঝাং বলেন, কোন এক দোকানে যাবার পর তাকে একজন ‘হ্যান্ডসাম’ বলে ডাক দেন। উল্লেখ্য, হাসপাতাল তাদের এই চুল কাটার জন্য অর্থ দিয়েছে।

মিস ঝাং জানান, তার এবং অন্যান্য নারীকর্মীদের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তটি এসেছিল যখন তারা তাদের উর্ধ্বতনদের কাছে ঋতুস্রাবের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং ট্যাম্পুনের জন্য অনুরোধ করেছিল। সাহায্য চাওয়ার পর উর্ধ্বতনেরা (যারা প্রায় সবাই পুরুষ) তাচ্ছিল্য করে বলেছিল যে তাদের কাজের প্রতি শৃংখলা ও নিষ্ঠার যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে! সে সময়ে, শহর কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন জিনিসই শহরে ঢুকতে পারতো না। ফলে নারীদের ঋতুস্রাবের জন্য ব্যবহৃত এই পণ্যগুলো হাতে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এ রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঋতুস্রাবের দিন যত ঘনিয়ে আসছিল, মিস ঝাংয়ের নিষ্ঠা ও মনোবল তত ভেঙ্গে পড়ছিল।

মিস ঝাং বলেন, তাদের অনুরোধের ভিত্তিতে হাসপাতালের উর্ধ্বতনদের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা আসলেই তাদের নার্ভে মারাত্মক আঘাত করে। যদিও কাজের পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ এটাই প্রথম ছিল না। বহু নারীকর্মী জানায় যে তাদের বাথরুমে যাবার জন্যও পর্যাপ্ত সময় ছিল না। একদল ভলান্টিয়ার নোটিশ পাঠাবার মাধ্যমে ৫০০ নারীকর্মীর জন্য ২০০০ এডাল্ট ডায়াপারের বন্দোবস্ত করে যাতে তাদের বাথরুমে যাবার সময়টুকু বেঁচে যায় এবং এই সময়টুকু যেন তারা রোগী দেখবার কাজে লাগাতে পারে। এরকম অবস্থায় প্রতিরক্ষা স্যুটের ভেতর ঋতুস্রাবের সাথে একা একা মোকাবিলা করাটা সত্যি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়! অনেক নারীকর্মী এই সময়টায় শুধুমাত্র তাদের ঋতুস্রাব বন্ধ রাখবার জন্য জন্মনিরোধক পিল খাওয়া শুরু করেন।

হুবাই প্রদেশের নার্স ও ডাক্তাররা আরো মাস্কের জন্য আবেদন করেন, বহু স্বাস্থ্যকর্মী করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে শুরু করে এবং অনেকে তাদের সামনেই মারা যায়। এরকম জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দিনের পর দিন তাদের কাজ করে যেতে হয়েছে।

মিস ঝাং জানান ‘আমি সবসময় সংক্রমিত হবার ভয় পেতাম এবং সে সময়ে আমার পরিবারকে খুব অনুভব করতাম’। বর্তমানে মিস ঝাংয়ের অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হয়েছে, তিনি একটি হোটেলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে আছেন এবং ১৪ দিন শেষ হলে বোঝা যাবে তিনিও ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন কিনা। সেরকম না হলে পরবর্তীতে তিনি নিজ পরিবারে ফেরত যেতে পারবেন।

এখন সবকিছু শেষ হয়েছে, মিস ঝাং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কবে তার পরিবারের সাথে দেখা করবেন, একটা লম্বা স্নান শেষে মায়ের হাতের রান্না খাবেন। তার মা  অ্যাসাইনমেন্ট চলাকালীন সময়ে তিনটি অকেশনে তার জন্য আলু গাজরের ডিশ, ভেড়ার কাবাব, ডিমের কারি, স্যুপ বানিয়েছিলেন। মা খাবারগুলো বাড়ির বাইরে নিরাপদ দূরত্বে কোন ফুটপাতে রেখে আসতেন। মিস ঝাং সেগুলোকে সেখান থেকে নিয়ে যেতেন এবং তার মা বাড়ির ভেতর থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকতেন সন্তানকে এক পলক দেখবার আশায়।

মিস ঝাং তার বিয়ের জন্যেও অপেক্ষা করছেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিয়েতে তিনি উইগ বা পরচুলা পরবেন। তিনি বিয়ের পোশাকের জন্য সঞ্চয় করেছিলেন, কিন্তু এখনও পছন্দ করার সুযোগ পাননি। মিস ঝাং বেশ উৎফুল্ল আছেন, বিশেষ করে যখন তিনি তার বাগদত্তের সাথে কথা বলেন। তাদের বিয়ের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ এপ্রিল। ঝাং বলেন- ‘আমি আশাবাদী, আমাকে আর এ ব্যাপারে দেরী করতে হবে না।’