September 20, 2024
কলাম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যৌনসহিংসতা, কমফোর্ট উওম্যানের কান্না

যেকোন যুদ্ধ বা আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় গণহত্যা, নির্যাতন, লুন্ঠনের পাশাপাশি ধর্ষণ ও নারীর ওপর অত্যাচার চলে বিরাট আকারে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, প্রতিটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেই নারী ও শিশু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাবার পর তাদের প্রতিই দেখানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি অবহেলা, এমনকি ধর্ষণ অপরাধের শাস্তিও হয়নি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। বিশ্বজুড়ে নানা সময়ে যুদ্ধে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ঘটনা, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এর বিচার, অপরাধের গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক অবস্থান নিয়ে গবেষক হাসান মোরশেদের তিন পর্বের ধারাবাহিক ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের জন্য।

আজ পড়ুন এর প্রথম পর্ব।।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পরাজিত শক্তির বিচার করার জন্য গঠিত হয় ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল মুলত যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করে এবং যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করে; কিন্তু এই ট্রায়ালে জেনোসাইডকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি, একটা রায়ও ঘোষিত হয়নি জেনোসাইডের শাস্তি হিসাবে। এছাড়া ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে সবচেয়ে ক্ষতের জায়গা হলো- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নারীদের বিরুদ্ধে যে যৌনসহিংসতা ঘটেছে সেই বিষয়টা একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া। ন্যুরেমবার্গের পর টোকিও ট্রাইব্যুনালেও নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার কোন উল্লেখ নেই, অপরাধ হিসাবে গন্য করা হয়নি।

অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নারীদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সব যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে নাৎসীরা তাদের অধিকৃত ইউরোপের দেশগুলোতে, পরে অ্যালাইড ফোর্স, বিশেষ করে সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ পাওয়া যায়। জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের দখলকৃত অঞ্চলে যৌন সহিংসতার ব্যাপক প্রমাণ পাওয়া গেছে, ট্রাইব্যুনালে যা গুরুত্ব পায়নি।

১৯৩৯ এর সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ড দখলের পর থেকেই জার্মান সেনাবাহিনী ও নাৎসীদের নিজস্ব বাহিনী এসএস পোলিশ নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা শুরু করে। লিভিউ শহরের একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আক্রমন করে ৩২ জন নারীকে ধর্ষনের পর হত্যা করে জার্মানরা। একজন খ্রীষ্টান যাজক এই ঘটনার প্রতিবাদ জানালে তাকেও গুলি করে হত্যা করে।
সুইস রেডক্রস মিশনের গাড়িচালক ফ্রাঞ্চ মেভিক একটা ঘটনার উল্লেখ করেছেন তার লেখায়- অধিকৃত ওয়ারশ এ জার্মান সৈনিকরা ১৫ থেকে ২৫ বছরের প্রতিটি নারীর শরীরে হাত দিত। তিনি দেখলেন দুজন নারীকে তারা ধরলো। প্রথম জন একটু বয়স্ক। জিজ্ঞেস করলো- কী চাই? নারী উত্তর দিলেন- রুটি স্যার। সৈনিকটি অশ্লীলভাবে হেসে জবাব দিলো- এই শরীর দিয়ে রুটি পাওয়া যাবেনা। তারপর তরুনীটির কাছে এগিয়ে তার কোট খুলে শরীর হাতিয়ে  আরো অশ্লীলভাবে বললো- এই শরীরের বিনিময়ে রুটি পাওয়া যাবে।

অধিকৃত সোভিয়েত অঞ্চলে হাজার হাজার নারী ডাক্তার, সেবিকা ও ওয়ারফিল্ডের নারী কর্মীগন ধর্ষণের শিকার হন এবং প্রায়ক্ষেত্রেই ধর্ষণ শেষে তাদের হত্যা করা হয়। সুসান ব্রাউনমিলার তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, জার্মানরা ধর্ষণকে ব্যবহার করেছে ‘ Weapon of Terror’ হিসাবে। ধারনা করা হয় জার্মানদের ধর্ষণের শিকার সোভিয়েত নারীদের গর্ভে কমপক্ষে ১০ লক্ষ শিশু জন্ম নেয়।

ধর্ষণ ছাড়াও জার্মান মিলিটারি ক্যাম্পগুলোর ভেতরে বা আশেপাশে পতিতালয় তৈরি করা হয়। সৈন্যদের জন্য প্রতি সপ্তাহে একবার করে পতিতালয় যাওয়ার নিয়ম করে দেয়া হয় এবং এ জন্য আলাদা ভাতাও দেয়া হয়। ধরে নেয়া হয় যৌনভাবে তৃপ্ত সৈনিকরা যুদ্ধের মাঠে আরো বেশি কার্যকর থাকবে। পতিতালয়ের একজন নারীকে সর্ব্বোচ্চ ৩২ জন পুরুষকে সঙ্গ দিতে হতো।  মিলিটারি ক্যাম্পের পতিতালয়গুলোতে নিয়মিত সরবরাহের জন্য নারীদের ‘কিডন্যাপ’ করে নিয়ে আসা হতো।

১৯৪১ এর ৩মে তারিখে প্রবাসী পোল্যান্ড সরকারের এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয় মিলিটারি ক্যাম্পের পতিতালয়গুলোর জন্য প্রতিদিন অসংখ্য নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পনেরো ও তদুর্ধ্ব  নারীদের জোরপূর্বক শ্রমের জন্য পোল্যান্ড থেকে জার্মান পাঠানো হয়, সেখানেও তারা ধর্ষণের শিকার হন।
জার্মানরা নিজেদের মিলিটারি ক্যাম্প ছাড়াও বন্দী শিবিরগুলোতে পতিতালয় স্থাপন করতো যেখানে বন্দী নারীদেরকেই পতিতা হিসাবে রাখা হতো। বন্দী পুরুষদের কাছ থেকে আরো বেশি শ্রম আদায় করার জন্য তাদের যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য এ আয়োজন।
বন্দীপুরুষদের মধ্যে যারা সমকামী ছিলো তাদের সপ্তাহে একদিন পতিতালয়ে যাওয়া বাধ্য করা হয় যেনো তারা ‘সুস্থ’ হয়ে উঠে। এটি সরাসরি হেনরিক হিমলারের নির্দেশ ছিলো।

এদিকে জাপানের রাজকীয় সৈনিকরা তাদের অধিকৃত অঞ্চলে অগনিত নারীকে যৌনদাসত্বে বাধ্য করে- এই নারীরা পরিচিত হয়ে উঠেন কমফোর্ট ওম্যান নামে। রক্ষনশীল জাপানী ইতিহাসবিদদের মতে কমফোর্ট ওম্যানদের সংখ্যা ২০,০০০ এর মত, কিন্তু অন্যদের মতে সাড়ে তিন থেকে চার লক্ষ নারীকে বাধ্য করা হয়েছিল।
বার্মা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়, তাইওয়ান, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ, পর্তুগীজ তিমুর এসব অঞ্চলে জাপানীরা তাদের ‘কমফোর্ট জোন’ গঠন করে। এসব জোনে কোরিয়া, চীন ও ফিলিপাইন থেকে নারীদের ধরে আনা হয়- অপহরন অথবা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে। পরে তাদেরকে যৌন দাসত্বে বাধ্য করা হয়।

ইউরোপজুড়ে  নারীদের বিরুদ্ধে জার্মান নাৎসীদের যৌন সহিংসতার যেমন বিচার হয়নি ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে, তেমনি টোকিও ট্রাইবুনালে অনুচ্চারিত রয়ে গেছে ‘কমফোর্ট ওম্যান’ নামে এশিয়ান নারীদের আর্তনাদ।

ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে জেনোসাইডকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসাবে গন্য করে এই অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য জোরালো চেষ্টা করছিলেন রাফায়েল লেমকিন। লেমকিন একজন পোলিশ ইহুদী, পেশায় আইনজীবী এবং শিক্ষক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পোল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত হন এবং ১৯৪২ সালে লেখেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ “Axis Rule in Occupied Europe”। এই গ্রন্থেই তিনি ‘জেনোসাইড’ নামে নতুন ধারণা,  এক অপরাধের কথা উল্লেখ করেন।

গ্রীক Genos শব্দের অর্থ গোত্র/গোষ্ঠী/গ্রুপ আর cide মানে কিলিং। রাফায়েল লেমকিন নতুন ধারনা, নতুন শব্দের জন্ম দিলেন Genocide। এই শব্দটি একটি প্রতিবাদ- ইউরোপ দখল করে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে সবকিছুকে জার্মানাইজড করে ফেলার মহাপরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

লেমকিন বললেন- অধিকৃত অঞ্চলে যারা নিগৃহীত হচ্ছে, বন্দী শিবিরে মারা যাচ্ছে, গ্যাস চেম্বারে বা গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে তারা তাদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের জন্য জার্মানদের শিকার হচ্ছেনা বরং তাদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যই হচ্ছে।  তারা নৃশংসতার শিকার হচ্ছে, কারন তারা ইহুদী, পোলিশ, স্লোভেনিক, রাশান বলেই। এই সত্য অস্বীকার করা অন্যায় হবে।
তিনি আরো বললেন- সবকিছুকে জার্মানাইজড করার মহাপরিকল্পনা থেকে এই নৃশংসতা, এটি পূর্ব পরিকল্পিত এবং পদ্ধতিগত। জাতি, ধর্ম ও নৃতাত্বিক গ্রুপগুলোকে সমূলে ধ্বংস করার জন্যই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, সংস্কৃতির উপর আঘাত, সম্পদ পাচার, ক্ষুধা রোগভোগ কিংবা অন্য কোনভাবে গণহারে হত্যার মতো কাজগুলো করা হচ্ছে।
লেমকিনের প্রবল অনুরোধ সত্ত্বেও ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল জেনোসাইডকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি, জেনোসাইডের অপরাধে কোন বিচারের রায় ঘোষণা করেনি।

হাল না ছেড়ে লেমকিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার অনুরোধ জানাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বর ৯, ১৯৪৮ জাতিসংঘের সাধারন সভায় গৃহীত হলো “Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide”,  আধুনিক পৃথিবীতে মানবাধিকারের প্রথম  চুক্তিনামা।

আর্টিকেল এক জেনোসাইডকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসাবে স্বীকৃতি দিলো- “যুদ্ধ কিংবা শান্তিকালীন যে সময়েই সংগঠিত হোক, জেনোসাইড আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে গণ্য হবে। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতো শুধু যুদ্ধকালীন সময়ের অপরাধই অপরাধ নয়।” [আর্টিকেল ১]

জেনোসাইডের সংজ্ঞা ও উদাহরন আসলো আর্টিকেল দুইয়ে-

“কোন  জনগোষ্ঠীকে তার জাতি/ গোত্র/ নৃতাত্বিক/ ধর্মীয়- এই চারটি পরিচয়ের কোন একটির জন্য যদি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করে ফেলার উদ্দেশ্য কিছু করা হয় তাহলে সেটা জেনোসাইড।

যেমন – উক্ত গোষ্ঠীর মানুষদের মেরে ফেলা/মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা/উদ্দেশ্যমূলক ৎভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যেন এই গোষ্ঠীর মানুষেরা জীবনধারনে অক্ষম হয়ে পড়ে/ গোষ্ঠীর ভেতর সন্তান জন্ম না হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করা/এই গোষ্ঠীর সন্তানদের জোর করে অন্য গোষ্ঠীতে স্থানান্তর ইত্যাদি।” [আর্টিকেল ২]

চলবে… 

দ্বিতীয় পর্ব- রুয়ান্ডা ও বসনিয়া যুদ্ধের নৃশংস যৌন নির্যাতন এবং শাস্তি

তৃতীয় পর্ব- ৭১’র যৌন সহিংসতা: ট্রাইব্যুনালে কবে আলাদা গুরুত্ব পাবে?