May 16, 2024
কলামফিচার ২

মুসলিম নারীদের বাঁচার পথ কে তৈরি করবে?

জান্নাতুল মাওয়া।। গত বছর (২০১৯), ২০ জুন, বিশ্ব সার্ফিং দিবসে ঢাকায় একটা নতুন সিনেমার ট্রেইলার মুক্তি পেল। সেখানে আমরা দেখতে পেলাম বাংলাদেশের কক্সবাজারের আয়শা নামের এক মেয়ে তার প্রিয় সার্ফিং খেলায় অংশ নেবার জন্য পরিবার এবং সমাজের সাথে লড়াই করছে। এই গল্পটি যে মেয়েটির জীবন থেকে ধার করা হয়েছে সেই মেয়েটির একটা সাক্ষাৎকার দেখতে পাই পরে; যেখানে সে বলছে সমুদ্র তার কত প্রিয়, ঢেউয়ের সাথে যখন সে ভেসে ভেসে বেড়াতো তখন তার মনের যত কষ্ট আছে সব চলে যেত। যে কোন কাজে আমরা যখন প্যাশনেট হয়ে পড়ি তখনই আমাদের মধ্যে এই অনুভূতিগুলো তৈরি হয়। এটা কারো শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া অনুভূতি নয়। চলচ্চিত্রের ট্রেইলারটি মূলত শুরু হয় বিদেশি এক ট্যুরিস্টের ক্যামরার চোখ দিয়ে। সেই চোখে আমরা দেখতে পাই একটা মেয়ে ঢেউ কেটে কেটে এগোচ্ছে, মাঝে মাঝে বিশাল ঢেউয়ের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে আবার ভেসে উঠছে।

পরে ইউটিউবে পিবিএস নিউজ নামে এক সংবাদ সংস্থার করা একটা ভিডিও দেখি। সেই ভিডিওতে সাংবাদিক মেয়েদের সার্ফিং বিষয়ে স্থানীয় ইমামের মত নিতে যান। ইমাম সাহেব বলেন, মেয়েদের সার্ফিংকে আমি ভালো চোখে দেখিনা। মেয়েরা তো ঢেকেঢুকে চলার কথা ছেলেরা যেন তাকে না দেখতে পায়। মেয়েরা শ্রদ্ধার পাত্র তাই তাদের খোলামেলা চলা উচিত না। সমুদ্রে সার্ফিং করতে গেলে প্রচুর লোক তাদেরকে দেখতে পায় যেটা গুনাহের কাজ এবং ভালো না। সেই ভিডিওতে সার্ফার মেয়েরা বাদে আর যত নারীকে সমুদ্র সৈকতে দেখানো হয় তারা সবাই ছিলো বোরকা পরা এবং সাংবাদিক বলেন, বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থীদের ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে এই মেয়েরাও তাদের রক্ষণশীল মুসলিম প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নানানরকম বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছেন।

সংবাদটি থেকে আরো জানা যায় মেয়েদের নিয়ে সার্ফিংয়ের আয়োজন করেছে আমেরিকার এক মিশনারি যার নাম ‘সার্ফিং দ্য নেশন’। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে আমরা সংবাদটি দেখলাম কলোনিয়ালিস্ট চোখ দিয়ে। এদিকে মেয়েদের সার্ফিং করা যে সঠিক কাজ নয় সেকথা কিন্ত বললেন, স্থানীয় ইমাম সাহেব। সংবাদটি যদি পশ্চিমের একটি সংবাদ সংস্থা তুলে নাও আনতো তবুও ঘটনাটি সেখানে ঘটছিল। অবশ্যই আমরা অত্যন্ত সচেতনভাবে জানি কলোনিয়ালিস্টরা প্রতিনিয়ত এসব গল্প তুলে ধ’রে যে কোন দেশে হুটহাট করে তাদের সৈন্য সামন্ত লটবহর নিয়ে ঢুকে পড়াটাকে জায়েজ করার চেষ্টা করে। আর তাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধীরা প্রাণপনে বলতে চাইছেন, এসব সাম্রাজ্যবাদীদের প্রোপাগান্ডা। এই তর্কযুদ্ধে আমি প্রাণপনে নিজের আদর্শগত অবস্থানটা মজবুত করার চেষ্টা করছি। আমি যখন এই সংবাদ দেখি, অপ্রয়োজনীয় প্রোপাগান্ডার অংশটা যেমন আমার চোখ এড়ায় না, তেমনি চোখ এড়ায় না একটা মেয়ের সংগ্রামের অংশটাও।

একটা রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে বড় হবার কারনে আমি আমার নিজের গন্ডির মেয়েদের গল্প জানি যাদের কেউ কেউ প্রচন্ড মেধাবী হওয়ার পরেও নিজেদের পছন্দমতো বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে পারেনি। কারন তাদের অভিভাবকরা মনে করেছেন তার ধর্ম তাকে যেকোন বিষয় নিয়ে পড়ার অনুমতি দেয়না, তার ধর্ম অনুযায়ী নারী হিসেবে তাকে বেশ কিছু বাড়তি বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে।

আমি আমার ফুপুদের গল্প জানি যাদেরকে একদিন স্কুলে পিটিরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে আমার উচ্চশিক্ষিত শ্রদ্ধেয় দাদাজান স্কুল থেকে নিয়ে এসেছিলেন এবং আর কখনো সেমুখো করেননি। তারপর এই ঘটনার প্রায় চল্লিশ বছর পরে এসেও আমার ফুপুকে দেখেছি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে। একদিন আমাদের বাসায় একটা ধর্মীয় বই দেখে ফুপু বলেছিলেন, আহারে বাংলাটা ভালো করে পড়তে পারলেও তো ধর্মটা ভালো করে শিখতে পারতাম। এই যে এইসব ছোট ছোট গল্পগুলো, এসব কিন্তু কোন পশ্চিমের সাংবাদিকের প্রোপাগান্ডা নয়। এসব আমাদেরই যাপিত জীবনের অংশ। যারা জীবনকে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন তাদের মনেই এই গল্পগুলো গাঁথা হয়ে থাকে। একইসাথে আমি এও জানি  এ যুগে এসে আমার পরিবারেরই অনেক মেয়ে সেসব বিধিনিষেধের দেয়াল ভেঙেছে এবং তাদের ধার্মিক অভিভাবকদের সাহায্যেই তারা সেটা করেছে।

নারীর অবস্থান প্রসঙ্গটি বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতসহ বৈশ্বিক রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। যেহেতু আগেই বলেছি উপনিবেশবাদীরা নিজেদের কর্মকাণ্ডকে জায়েজ করতে এমন একটা ধারণা সবাইকে দিয়ে থাকেন যে তারাই দখলকৃত অঞ্চলগুলোর নারীদের ত্রাণকর্তা। অন্যদিকে যারা নিজেদের উপনিবেশবাদবিরোধী মনে করেন তারা সবার আগে নারীর পোশাক আশাকসহ অন্যান্য বিষয়কে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে বলে থাকেন যে এখনকার নারীরা পশ্চিমা সভ্যতার অনুকরণ করছে। মজার বিষয় হলো, পুরুষরা নির্দ্বিধায় শার্ট প্যান্টালুন, জিন্স, হাফপ্যান্ট ইত্যাদি পরে ঘুরে বেড়াতে পারেন। তাকে কেউ পশ্চিমা সভ্যতার দাস বলে চিহ্নিত করেনা। খুবই হালকা একটা উদাহরণ দিলাম। কিন্তু এ থেকেই বোঝা উচিত কিভাবে নারীর অবস্থানকে দু’পক্ষই ব্যবহার করছেন। বর্তমান মুসলিম সমাজের দিকে তাকালেই আমরা খুব পরিষ্কারভাবে এটা দেখতে পাই। এই সমাজে যারা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন তাদের সমস্ত চেষ্টাই পুরুষকেন্দ্রিক।

আরেকটা ছোট উদাহরন দেই, খুব সম্প্রতি একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। সেখানে কিছুসংখ্যক আলেম মাদ্রাসার ছাত্রদের বইমেলায় আসতে উৎসাহিত করলেন। তারা দলবেঁধে বইমেলায় আসলেন। পোস্ট লিবারেল চিন্তাবিদরা অনেক আনন্দিত হলেন। অথচ এই উদ্যোগের কোথাও মাদ্রাসার ছাত্রদের নারী অংশটিকে দেখতে পেলাম না। একজন নারীবাদি হিসেবে আমি এই উদ্যোগকে প্রাণখুলে প্রশংসা করতে পারলাম না। আমাদের পুরুষ চিন্তাবিদেরা হয়তো এই ঘটনাকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি, কিন্ত আমার কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ। যতদিন নারীদেরকে বাদ দিয়ে সংস্কারপন্থীরা এগিয়ে যেতে চাইবেন ততদিন তাদের এগোনোটা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে।

একটা লম্বা সময় ধরে কলোনাইজড থাকা একটা অঞ্চলের মুসলিম নারী হিসেবে নারীবাদি চিন্তাগুলো নিয়ে কথা বলার সময় অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলতে হয় আমাদেরকে। এ যেন পুলসেরাতের ওপর হাঁটা। এখন জ্ঞানতত্ত্বের জগতে বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করার বিষয়টাকে খুব গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।  মানুষের মাথার মধ্যে জমে থাকা কলোনিয়ালিস্ট চিন্তাগুলোকে ভেঙে ফেলার দিকে বেশ জোর দেয়া হচ্ছে। এখন আমরা প্রতিনিয়ত পশ্চিমের কলোনিয়ালিস্ট চিন্তার বাইরে এসে নতুন চিন্তার জগত তৈরি করতে চাইছি।  তেমনি একটা সময়ে ফেমিনিজম বা নারীবাদ, যার উৎপত্তি হয়েছিলো পশ্চিমের নারীদের হাত ধরে তাকে অনেকেই পশ্চিমা ধারণা বলে মেরুকরণ করে ফেলতে চাইতে পারেন। তাই এখন আমাদের  অঞ্চলের নারীবাদিদের প্রথম কাজ হবে নিজেদের গল্প বলে যাওয়া, আশপাশের গল্পগুলোকে তুলে ধরা। যেই গল্পগুলো আমাদের নিজস্ব। আমাদের নিজেদের মুখ থুবড়ে পড়ার গল্প, এবং তারপর আমাদের নিজেদেরই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। আর যারা সত্যিকারের উপনিবাশবাদবিরোধিতা এবং পোস্ট লিবারেলিজমের চর্চা করতে চান তাদের উচিত হবে নিজ নিজ অঞ্চলের নারীর অবস্থার বিষয়ে সচেতন হওয়া।

লিলা লঘুদ নামের একজন উপনিবেশবাদবিরোধী চিন্তাবিদ তার একটি বইয়ের শিরোনামের মাধ্যমেই জিজ্ঞেস করেছেন, “মুসলিম নারীদেরকে কি বাঁচানোর দরকার আছে?”  আমার উত্তর হলো, মুসলিম নারীদেরকে বাইরের কেউ এসে বাঁচানোর দরকার নাই, তবে তাদের বাঁচার দরকার আছে আর সেই বাঁচার পথটা আমরা নিজেরাই তৈরি করবো। অন্য কেউ এসে ঠিক করে দেবেনা আমাদের বাঁচার তরিকা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]