অ্যাবিউসিভ রিলেশন- হীনমন্যতা যখন আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করে
আফরোজ ন্যান্সি।। এমনটা প্রায়ই দেখা যায় যে, খুব সচেতন, শিক্ষিত, স্বাধীনচেতা মেয়েগুলিই দিনের পর দিন একটা অ্যাবিউসিভ রিলেশনে থেকে সমস্ত নির্যাতন, অন্যায়, অবিচার মেনে নিচ্ছে। বছর পেরিয়ে গেলেও এরা এই অসুস্থ সম্পর্ক থেকে বেরোতে পারছে না। এর কারন কী হতে পারে? যে মেয়ে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, যার মধ্যে সমাজের ভয় নেই, যার আত্মসম্মান এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ প্রবল, সেই মেয়েটাই যখন দিনের পর দিন তার সাথে হয়ে আসা অন্যায় সহ্য করে তা শুনে আমাদের খুব অবাক লাগে। হয়তো রাগও হয় মেয়েটির প্রতি। হয়তো ভাবি মেয়েটাই হিপোক্রেট, মুখে যা বলে তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে পারে না তাই এমন। আসলেই কি তাই ! একটা অসুস্থ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা আসলেই কি এতোটা সহজ!
গত পরশু একটা মুভি দেখতে দেখতে এই কথাগুলি ভাবছিলাম। মুভির শুরুতেই দেখা যায়, প্রেমিকের বাসা থেকে পালিয়ে আসে প্রেমিকা। এক পুলিশের বাসায় লুকিয়ে থাকে। এরপর জানা যায় তার সেই প্রেমিক সুইসাইড করেছে। এর পরপরই শুরু হয় ভুতুড়ে সব কাণ্ড। আসলে মেয়েটির প্রেমিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন এক জ্যাকেট বানায় যা পরলে মানুষ ইনভিজিবল হয়ে যেতে পারে। প্রেমিকটি অদৃশ্য থেকে এমন সব কান্ড করতে থাকে যাতে মনে হতে থাকে মেয়েটি একটি মানসিক রোগী এবং ভয়ঙ্কর খুনী। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে মেয়েটিকে তার বোন-বন্ধু কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারেনা। বোনকে খুনের দায়ে জেলে পাঠানো হয় তাকে। তার প্রেমিক এসব করে যেন মেয়েটি সবার কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে তার কাছেই ফিরতে বাধ্য হয়। এই মুভির শেষটা সুন্দর কিন্তু বাস্তব জীবন সিনেমার মতো সবসময় হ্যাডি এন্ডিং হয়না।
বাস্তবে একটা অসুস্থ সম্পর্ক মানুষের আত্নবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী, ঘাড়ত্যাড়া, আপোষ না করা মেয়েটিরও একটা সময় মনে হতে থাকে “হয়তো সব দোষ আমারই”, “এতোদিন যেহেতু সহ্য করেছি, আর কয়েকটা দিন সময় দিলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে” ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গী তাকে এমনভাবে ট্রিট করতে থাকে যখন মেয়েটির নিজের চোখেই নিজেকে ছোট লাগতে থাকে। নিজেকে অপরাধী কিংবা মানসিক রোগী মনে হতে থাকে। এই মনে হওয়াটা কিন্তু একদিনে হয় না। দিনের পর দিন একজনের লাগাতার চেষ্টার ফলস্বরূপ এই উপলব্ধি তৈরি হয়। আর যেই মুহুর্তে এই উপলব্ধিটা আপনার মধ্যে জন্ম নিলো সেই মুহূর্ত থেকে আপনি একজন পরাজিত মেরুদণ্ডহীন মানুষে পরিনত হয়ে যাচ্ছেন। সব থেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, এই পুরো প্রক্রিয়াটি অনেকটা ক্যান্সারের মতো, যখন আপনি টের পাবেন আপনি আক্রান্ত হয়েছেন ততদিনে আপনার মেরুদণ্ডের আশি শতাংশ খোয়া গেছে।
হীনমন্যতা এমন এক অসুখের নাম যার কোনো চিকিৎসা নেই। একজন ব্যক্তি যখন কাউকে নিয়ন্ত্রণ ও কব্জা করার উদ্দেশ্যে সম্পর্ক তৈরি করে অথবা সম্পর্ক তৈরির পরে সঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা যাদের মধ্যে থাকে তাদের প্রধান ও প্রথম কাজ সঙ্গীর মনে হীনমন্যতার বীজ বুনে দেওয়া, “কী এমন তুমি?” “কী ভাবো তুমি নিজেকে?” ইত্যাদি তুচ্ছার্থক, আপাতদৃষ্টিতে খুবই সামান্য ব্যঙ্গাত্মক কথা থেকে শুরু হয় এই যাত্রা, এরপর যখন সম্পর্ক ভাঙার প্রশ্ন আসে তখন, “তুমি যে সম্পর্ক ভেঙে দিবা তা আমি আগেই জানতাম” “তোমার মতো মেয়েরা শুধু ভাঙ্গতেই পারবে” ‘‘কারো প্রেমিকা/ বৌ হওয়ার যোগ্যতা নাই তোমার” “তোমার মানসিক সমস্যা আছে” “তোমার চারিত্রিক সমস্যা আছে” “মানুষের কাছে বলো দেখবা তোমারেই লোকে থুথু দিবে” ইত্যাদি এবং সর্বোপরি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল “আর করবো না” “আর হবে না” “লাস্ট চান্স চাই” এবং আরেকটা সুযোগ পাওয়ার পরে দ্বিগুন উৎসাহে চলতে থাকে মানুষটাকে মেরুদণ্ডহীন করে ফেলবার এই যাত্রা।
তো একজন মানুষ যখন উপর্যুপরি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই কনফিউজড হয়ে যায় সে। যে প্রেমিক এক মিনিট আগে বলছিলো, “তুমি কারো বৌ হওয়ার যোগ্যতা রাখো না” এক মিনিট পরেই যখন আবার প্রেমিক বলছে, “আসলে তোমার তো দোষ না, তোমার একজন ভালো সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার”, আবার ত্রিশ সেকেন্ড পরে বলছে, “তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার সাথে থাকতে চাই, আমি তো এসব কথা তোমাকে বলতে চাইনা কিন্তু তুমি এমন বিহেভ করো যে ভুল করে বলে ফেলি, আর বলবোনা কখনো”- এই উপর্যুপরি পরিস্থিতিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই ভিক্টিমের নিজেরই মনে হবে যে আমিই হয়তো অপরাধ করছি, আমিই হয়তো খুব বেশি রিঅ্যাক্ট করছি, আমিই মানসিকভাবে স্ট্যাবল না, আমি আরো একটু সহনশীল হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একবার ভাবুন তো, এই উপলব্ধিটা কি আপনার নিজের? নাকি কেউ আপনার ঈশ্বর হয়ে মাথার উপর বসে আপনাকে দিয়ে এটা ভাবাচ্ছে! ভালোবাসার হাওয়াই মিঠাই খেয়ে খেয়ে একটা গোটা জীবন অন্যের হাতে শোষিত হতে থাকার অলিখিত পারমিশানটা নিজেরাই দিচ্ছি নাতো!
যারা বলেন, ‘‘এতোদিন কেন সহ্য করলেন, কেন আগে বেরিয়ে এলেন না’’- তারা কি জানেন বেরিয়ে আসবো কথাটা ভাবার জন্য যতটুকু মানসিক শক্তি দরকার হয় তার পুরোটাই হীনমন্যতা নামক জন্তুটি খেয়ে ফেলে আগেই। আর রইলো পরিবার-আত্মীয়- বন্ধু- সংগঠনের সাহায্য, এ তো অমাবস্যার চাঁদ। এরপরও যখন অবশিষ্ট মানসিক জোরটুকু নিয়ে খুব চেষ্টা, খুব যুদ্ধর পর একার চেষ্টায় মেয়েটি বেরিয়ে এলো তাকে সাধুবাদ। বেশিরভাগই তো আজীবন ভুক্তভোগী হয়ে থাকে এই ভেবে যে সমস্যাটা তার নিজের। জীবনটা যেহেতু মাত্র একবারই পাওয়া যাচ্ছে তাই এর কানায় কানায় উপভোগ করাটা খুব জরুরি। কেউ আপনার কাঁধে ভর করে জীবন উপভোগ করে যাবে আর আপনি কেবল হাঁড়ি-কুড়ি ঠেলে, আলু পেয়াজের হিসেব করে আর ভালো বৌ হয়ে থাকার মধ্যে জীবনের স্বার্থকতা খুঁজবেন এটা নিজের প্রতি নিজের খুব ইনজাস্টিজ হয়ে যায়। পাশাপাশি আপনি যে আদর্শ ধারন করছেন সেই আদর্শের প্রতিও ইনজাস্টিস করা হয়।
যে সম্পর্ক আপনার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়, আপনাকে হীনমন্যতায় ভোগায়, আপনাকে আপনার চোখেই ছোট করে দেখায় সে সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে যতটা সুন্দর দেখাক না কেন, তা থেকে বেরিয়ে আসুন আপনার মেরুদণ্ডে পুরোপুরি ঘুণ ধরে যাবার আগেই। সম্পর্ক তৈরি যতটা সহজ-সুন্দর, অসুস্থ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পথটি ততটাই কুৎসিত এবং জটিল। তাই সবার আগে নিজেকে এই উপলব্ধি দিন, আপনাকে ছোট করে কথা বলার অধিকার কারুর নেই। যে আপনাকে ছোট করে কথা বলে সে কখনোই আপনার ভালো চায় না, সে আপনার কেউ নয়। নিজেকে বলুন, আপনি পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষদের একজন। আত্মবিশ্বাস বাড়ান। সমস্ত অসুন্দরের প্রতিকুলে যুদ্ধ করার মানসিকতা তৈরি করুন। আমি জানি রাতারাতি আপনি তা পারবেন না। নিজেকে সময় দিন, নিজেকে ভালবাসুন। নিজেকে বোঝান, হয়তো আপনি অনেকটা সময় সহ্য করেছেন, তার মানে সারাজীবন সহ্য করে যেতে হবে তা তো নয়! যারা বলে এতদিন কেন করলে না, তাদেরকে পাত্তা দেবেন না। আপনিই কেবল জানেন আপনার জন্যে সঠিক সময় কোনটি। তবে যত দ্রুত বেরিয়ে আসবেন ততই আনন্দে বেঁচে থাকার জন্যে আরেকটা দিন বেশি পাবেন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]