September 20, 2024
কলামফিচার ২

পুরুষের কাজ আসলে কোনটি?

উম্মে ফারহানা।। আপনার রান্নাঘরে তিনটা ছাঁকনি- একটা চায়ের, একটা দুধের, আরেকটা ভাজা তেল ছেঁকে নেবার জন্য। এমন কি কখনো হয়েছে যে রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন দুধের ছাঁকনি দিয়ে চা কিংবা তেলের ছাঁকনি দিয়ে দুধ ছেঁকে রেখেছে কেউ? অথবা তিনটা হ্যান্ডটাওয়েলের মধ্যে সবচেয়ে গাঢ় রঙের যেটি দিয়ে আপনি কিচেন কাউন্টার মোছেন সেটি দিয়ে কেউ ডাইনিং টেবিল মুছতে গেল, আর আপনি হাহা করে উঠতেই আকাশ থেকে পড়লো? অথবা ধোয়া বাসন মোছার হালকা রঙের হ্যান্ডটাওয়েল দিয়ে চুলার পাশে পড়া হলুদ আর তেল মুছে ফেললো, জিজ্ঞেস করলে এমন একটা ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি? আপনার সাধের নন স্টিক ফ্রাইং প্যান স্টিলউল দিয়ে ঘষে তার টেফলন কোটিঙের দফা রফা করে দিয়েছে কেউ কখনো? কিংবা সুজির হালুয়া আর পায়েস বানাবার সসপ্যানে ফ্রিজ থেকে বের করা বিফ ভিন্দালু গরম করার জন্য বসিয়ে দিয়েছে? রুটি সেঁকার স্কিলেটে ডিম পোচ করে ফেলা কিংবা রঙ চা বানাবার পাত্রে দুধ চা বানিয়ে ফেলা, পর্দা বিছানার চাদরের জন্য রাখা কড়া ডিটারজেন্ট দিয়ে পরনের কাপড় ধুয়ে ফেলা, কাপড় ধোয়ার গামলায় সবজি ঢেলে দেওয়া কিংবা রান্নাঘরে সবজি ধোয়ার জন্য রাখা গামলায় আন্ডার গার্মেন্টস ভিজিয়ে দেওয়া? হয় এসব?

যদি না হয়ে থাকে তাহলে আপনার সৌভাগ্য বলতে হবে। কিন্তু বাসার কাজে যখন পুরুষেরা ‘সাহায্য’ করেন তখন উল্লিখিত ঘটনাগুলো নিত্তনৈমিত্তিক হয়ে যায়। এই ‘সাহায্য’ শব্দটা শুনলেও হাসি পায় আমার। যেন ঘরটা পুরুষের ঘর নয়, ঘরের কাজ পুরুষের নিজের কাজ নয়, অন্যের কাজে উনি ‘সাহায্য’ করছেন। বাড়িতে বেড়াতে আসা অতিথি কাজে হাত লাগালে সেটিকে সাহায্য বলা যায়, কিন্তু পরিবারের সদস্য যখন বাসার কাজ করেন সেটিকে ‘সাহায্য’ বলতে আমি নারাজ।

আমার আম্মা কোন ছেলেকে তার রান্না ঘরে ঢুকতে দিতেন না। আম্মার ধারণা ছেলেরা এসব পারে না, চা বানিয়ে চিনির বয়াম খোলা রাখে, পিঁপড়া ধরে যায়, ডিম ভাজি করতে একগাদা তেল ঢালে, একটা ছয়ছত্রখান অবস্থা করে, সেগুলো গোছানো আরেক হ্যাপা, এরচেয়ে বাবা, তোরা দূরে থাক। কিন্তু আমাদের প্রজন্মের চাকুরিজীবী নারীদের অধিকাংশের এমন রান্না ঘরে রাজত্ব করার অবকাশটুকু নেই। আমাদের মা খালাদের অনেকেই চাকরিবাকরি করতেন, তবুও রান্নাঘরকে মিনি জেনানা বানিয়ে রাখতেন, হয়তো এই বিশ্বাস থেকে যে এই কাজগুলো পুরুষের কাজ নয়।

কিন্তু আমরা সেসব বিশ্বাস করি না, করলেও এই শ্রমবিভাজন অনুসরণ করার লাক্সারি আমাদের অনেকের নেই। কিন্তু উপরের যে ঘটনাগুলোর কথা বললাম, সেটিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আমার নিজস্ব ব্যাখ্যাটা বলি- অধিকাংশ পুরুষ (আমি জেনারেলাইজ করছি না, অফিস থেকে ফিরে এসে গৃহিণী স্ত্রীকে রান্না করে খাওয়ান, পরের দিনের নাশতার জন্য রুটি বানিয়ে রাখেন, বাসন মেজে গুছিয়ে রাখেন এমন পুরুষ আমার আত্মীয়পরিজনদের মধ্যেই আছেন) তাদের স্ত্রীদের কাজে ‘সাহায্য’ করাটাকে বিরাট মহানুভবতা বলে ভাবেন। করে দিচ্ছেন এই না বলে অনেক, ধন্যবাদ জানানো উচিৎ তাদের, আবার কোন ন্যাকড়া দিয়ে কী মোছা হলো, কোন ছাঁকনি দিয়ে কী ছাঁকা হলো, কোন চামচ দিয়ে কী নাড়া যাবে আর কী যাবেনা- এত ভ্যানতারা কেন? এহেন নাক উঁচু মনোভাব নিয়ে কাজে ‘সাহায্য’করতে আসার ফলে এটা হয়। নাহলে বলুন তো, ওনারা কি নিজেদের পার্টিতে যাবার পোশাক আর বন্ধুদের আড্ডাতে যাবার ক্যাজুয়াল শার্ট, অফিসে যাবার কোলন আর শপিংয়ে যাবার বডি স্প্রে আলাদা করে রাখেন না? ওনারা কি মোবাইল ফোনের চার্জার আর ট্যাবের চার্জারে গুলিয়ে ফেলেন? নিজেদের বই, ক্যমেরা, ঘড়ি, নোটবুক, কলম, গাড়ি বা বাইকের চাবি, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড- এসব সামলে রাখা, গুছিয়ে রাখা এসব তো পারেন তারা। তাহলে ঘরের বা রান্নাঘরের কাজে তাদের অর্গানাইজেশন পাওয়ার কোথায় যায়? ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন তখন, ভাবেন – এটা এমন কোন ‘সিরিয়াস’ ব্যাপার নয়।

আমার দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা হলো, উপরে উপরে যতই প্রগতিশীল আর মুক্ত মানসিকতার হন না কেন, ভেতরে অনেক পুরুষই খুব গোঁড়া আর প্রাচীনপন্থী। ‘কালেকটিভ আনকনশাস’ বলে যে ব্যাপারটি আছে তা তাকে বাধা দেয় কোন নারীর নির্দেশনা মানতে। রান্নাঘরের বা বাসার যে কাজটি সাধারণত নারীরা করেন, যে দায়িত্বটি ‘নারীর কাজ’ বলে তিনি ধরে নিয়েছেন, সেটি যখন তাকে করতে হয়, তিনি নিজের অজান্তেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, একটু মনোযোগ দিলেই যেটা ধরে ফেলতে পারতেন সেটা ইচ্ছে করেই ধরতে চাননা। অনেক উন্নত কম্পিউটার, সাউন্ড ইকুইপমেন্ট, জটিল প্রযুক্তির ভিডিও ক্যমেরা চালিয়ে অভ্যস্ত হলেও সামান্য ওয়াশিং মেশিন বা মাইক্রোওয়েভ ওভেন চালাবার টেকনিকটুকু তিনি আয়ত্ব করতে পারেন না।
না পারার চেয়ে বর কারণ হলো না চাওয়া। আপনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ন্যাকড়া বা হাতা বা বয়াম ব্যবহার করতে তাঁর কোথায় যেন লাগে।

আপনি যদি কর্মজীবী নারী হয়ে থাকেন এবং অফিসে পিয়ন জাতীয় কর্মচারীদের দিয়ে আপনাকে কোন কাজ করাতে হয়, দেখবেন তারা দোকানে যাওয়ার মতন কাজে যতটা উৎসাহী, চা বানিয়ে দেওয়ার মতন কাজে ততটা নন। যদি বানিয়ে দিতেই হয়, পুরুষদের চা পরিবেশন করার সময় তাদের যতটা মনোযোগ, নারীদের পরিবেশন করার সময় ততটা নেই। আমি ব্যাপারটি লক্ষ্য করতাম না, কিন্তু আমার এক সহকর্মী একদিন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, ডর্মের ওয়াচম্যান নারী শিক্ষকদের যাতায়াতের সময় অন্য দিকে চেয়ে দাঁত খোঁচাতে থাকে, সালাম যাতে দিতে না হয় সেজন্য মোবাইল ফোন টেপে অথচ পুরুষ শিক্ষকেরা গেলে টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়, পারলে মিলিটারি কায়দায় মাটিতে পা ঠুকে স্যালুট দিয়ে ফেলে। সেই পুরুষ শিক্ষক নব্য নিযুক্ত লেকচারার আর আমি পাঁচ বছর ধরে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, তবুও।

এখন আপনি বলতে পারেন, অর্ধশিক্ষিত দারোয়ান বা পিয়নের সঙ্গে আমরা আমাদের মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষিত পুরুষসঙ্গী কিংবা সহকর্মীদের তুলনা কেন করছি। আলবত করবো, কেননা নারীদের নির্দেশ মেনে না নিতে পারার ক্ষেত্রে, নারীদের নিম্নগোত্রের ভাবা কিংবা সম্মান দিতে না পারার সময়, সকল পুরুষ যাকে বলে ভাই-ভাই। তাই নারীদের নির্দেশনা মানার ক্ষেত্রে তাদের অনীহাও সকল শ্রেণিপেশায় একই রকম।
প্রফেসর ডক্টর রায়হান শরিফ ফেইসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছেন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাসায় থাকা পুরুষদের নিয়ে। বোঝার সুবিধার্থে স্যারের পোস্টটি হুবুহু তুলে দিলাম।

“বাসার পুরুষ সদস্যদের নাকি বাসায় আটকে রাখা যাচ্ছে না। জরুরী কাজে বাইরে যাবেন তারা অবশ্যই। এই সময়ে কিছু অ-জরুরী কাজে তাদের রুচিবোধ গড়ে তুলতে পারেন। বুয়া ছুটিতে যেহেতু ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট রেডি করে সার্ভ করতে উৎসাহ দিন তাদের। সবার খাবার শেষ হলে প্লেট-গ্লাস ধুয়ে রাখতে মোটিভেট করুন এক কাপ চা দিয়ে। এরপর ওয়াশিং মেশিনে কিছু কাপড় ঢোকাতে তাদের ইন্সপায়ার করুন। বেলা ১১ টার দিকে দুপুর ও রাতের রান্না একবারে করে ফেলতে বলেন। ১২ টা থেকে ১ টা অব্ধি তাদের টিভি, ফেসবুকে দাপাদাপি করতে দিন।

আর বললাম না। বাকীগুলো আপনারা বলেন।”

এই পোস্ট দেখে প্রথম আমার মনে যা এসেছে তা হলো বাঙালি পুরুষদের মধ্যে ঘরের কাজ সম্পর্কে নাকউঁচু যে ধারণা আছে, স্যার যাকে ব্যঙ্গ করে বলছিলেন ‘অ- জরুরি’, সেগুলো নেহাত মেয়েদের কাজ, কিছু হলেই তারা যে অন্য পুরুষকে অপমান করার জন্য বলেন ‘তাহলে চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকো’, ঘরের কাজগুলোকে যে তারা শুধুই ‘নারীর কাজ’ বলে ভাবেন, তাহলে তাদের কাজ, অর্থাৎ পুরুষের কাজ কোনগুলো? ডাক্তারি, মাস্টারি, ইঞ্জিনিয়ারিং? সেগুলো তো মেয়েরা করছেন। রাজনীতি? মন্ত্রিত্ব? দেশ পরিচালনা? সেগুলোও তো মেয়েরা করছেন। খেলাধুলা? দেশের জন্য স্বর্ণপদক জিতে আনা? পাহাড়ে চড়া? সেগুলোও তো মেয়েরা করছেন। গবেষণা? আন্দোলন? শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি? গল্প উপন্যাস গান কবিতা লেখা? সেগুলোও কি মেয়েরা করছেন না?

তাহলে পুরুষের কাজ আসলে কোনটি?
এই প্রশ্নের জবাবটি আমি দেই?

পুরুষের কাজ হলো সবকিছুতে বেটাগিরি দেখানো। এছাড়া শুধুই ‘পুরুষের কাজ’ বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।

উম্মে ফারহানা: শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]