November 1, 2024
কলামফিচার ৩

ট্যাবু ভেঙ্গে, সাহস বুকে রাজনীতিটাই করতে হবে নারীকে

সুমাইয়া সেতু ।। আমাদের দেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে আলাপ করলে সব চেয়ে বেশি যে কথাটি শুনতে হয় তা হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, স্পিকার নারী। এই সবই হচ্ছে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের একমাত্র নিদর্শন। অথচ যদি আমরা প্রকৃত সত্যটা উপলব্ধি করি দেখবো যে রাজনীতিতে এতো এতো প্রধান নারী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে নি তারা। বরং নারীর প্রতি নিপীড়ন আরো বেড়েই চলেছে দিনকে দিন।

আমাদের দেশের মন্ত্রী পরিষদের ৪৮ জন সদস্যের মধ্যে ৫ জন নারী, সরাসরি নির্বাচিত জাতীয় সংসদে ১৯ জন আর সংরক্ষিত আসনে ৫০ জন নারী। এই যে সংরক্ষিত নারী আসন, এই আসনে যারা নির্বাচিত হয় তারা আসলে জনগনের প্রতিনিধি হয়ে নির্বাচিত হয় না, তাদেরকে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচিত করে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখানে যোগ্য নারীরা আসতে পারে না। উল্টো বিভিন্ন পুরুষ নেতাদের আত্মীয়- স্বজন দিয়ে এই আসনগুলো পূর্ন করা হয়, যারা সংসদে এসে তাদের পরিবারের স্বার্থ হাসিল করতে ব্যস্ত থাকে। তাই নারীদের প্রকৃত সমস্যা আমাদের সংসদে উঠে আসে না।

পেশী শক্তি, টাকার খেলা,সামাজিক ট্যাবুর বেড়াজাল পেরিয়ে রাজনীতি করা কতটা কঠিন কাজ তা কেবল নারীরাই জানে। রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ না বাড়লে বা দলগুলোর সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর মতামতের সুযোগ তৈরি না হলে এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের কথা বলা হলেও সেই কথা কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। বাস্তবে সেই লক্ষ্যপূরনের কোনো ইচ্ছাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা যায় না। এই ৩৩ শতাংশের বাধ্যবাধকতার সময় শেষ হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে যে এর পরিবর্তন করতে চায় অনেকেই, তুলে দিতে চায় এই নিয়ম যা কিনা ধর্মীয় দলগুলোর দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরনের সিদ্ধান্ত হবে। নারীরা পিছিয়ে পড়বে আরো কয়েক ধাপ। এমনকি বামপন্থী দলগুলোও তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। দলের ভেতরে নারী বান্ধব পরিবেশ না থাকায় অনেক কর্মী রাজনীতি থেকে ঝরে গেছে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার লোকজন এই দলগুলো পরিচালিত করে বলে মুখে যতই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলুক কার্যত তারা নারীকে ছোট করেই দেখে সর্বক্ষেত্রে, কিছু মানুষ সংরক্ষিত আসনে নারীকে দেখতে চাইলেও সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করার জায়গা নারীকে দেয় না।

আমরা তাই দেখি যে রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি আসনে নারীদের মনোনয়ন দিতে চায় না। আবার তাদের নির্বাচনের কাজ সবচেয়ে বেশি করে নারীরা, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় তারাই নির্বাচনের ক্যাম্পিং করে বেড়ায় নেতার পক্ষে। তার মানে নারীকে তারা নিজেদের স্বার্থে ঠিকই ব্যবহার করছে কিন্তু তার প্রাপ্য অধিকারটুকু তাকে দিতে নারাজ। সংরক্ষিত আসনে একজন নারীর ৩টি করে আসনের দায়িত্ব থাকে। আসলে কার্যত তাকে কোনো দায়িত্বই দেওয়া হয় না। কোনো কাজ করার সুযোগও দেওয়া হয় না। প্রতিটি আসনে আলাদা পুরুষ প্রতিনিধি থাকে যারা সব কিছু নিজের মতো করে চালায়। আমাদের দেশের নারীবাদীরাসহ অনেক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে নারীদের সরাসরি আসনে নির্বাচন করার অধিকারের জন্যে লড়াই করছে। কিন্তু একটা বড় আন্দোলন তারা সংগঠিত করতে পারছে না।

সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে নারী রাজনীতি থেকে পিছিয়ে পড়েছে তার সামাজিক অবস্থানের কারণে। এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে কোনো নারী রাজনীতি করলেই তাকে খারাপ মেয়ে বলে আখ্যায়িত করে মানুষ। রাস্তায় মাথা সোজা করে আমাদের সমাজে কয় জন নারী হাঁটার সুযোগ পায়? ছোটবেলা থেকে নিজের অধিকার সম্পর্কে যাতে জানতে না পারে, সমাজ সেই ব্যবস্থাই করে রাখে সর্বক্ষেত্রে। কারণ নারী যদি তার অধিকার জেনে যায় এবং সেই অধিকারের জন্যে লড়াই করে, এক মুহূর্ত সময় লাগবে না এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে। তাই খুবই সুকৌশলে নারীকে বন্দী করে রাখা হয় চার দেয়ালে। শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। কারণ মানুষ যত পড়বে যত জানবে তত এই সব নির্দেশ কম মানবে।

যে সমাজে নারীকে বলা হয় আস্তে কথা বলতে, সেই সমাজের নারী কী করে রাজপথে স্লোগান দেবে? যেখানে বলা হয় মাথা নিচু করে হাঁটতে সেখানে কী করে পুলিশের উদ্ধত রাইফেলের মুখে মাথা উঁচু করে নারী দাঁড়াবে! রাস্তায় বের হলেই পোশাকের দোষ ধরা এখানকার মানুষের অভ্যাস, একের পর এক ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলোর একটারও বিচার হয় না আমাদের রাষ্ট্রে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এখানে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার ফলে অপরাধীরা ভয় পায় না, বরং টাকা আর ক্ষমতা থাকলে যেকোনো অপরাধ তারা করতে পারে। ধর্ষণের মতো ঘটনা আমাদের সমাজে নারীকেই ছোট করে, মানুষের সম্ভ্রমের মতো শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয় ধর্ষণের সাথে। তাই কেউ ধর্ষিত হলে তার সম্ভ্রম হারিয়ে যায় এই তথাকথিত সমাজে। প্রতি মুহূর্তে নারী এখানে শুধুই একজন শরীরসর্বস্ব প্রাণী, যার কোনো বুদ্ধি থাকতে নেই, নেই কোনো কথা বলার অধিকার।

আমাদের দেশে ধর্মীয় প্রচার প্রচারণায়, ওয়াজ-মাহফিলে হরহামেশা নারীকে অপমান করে বক্তব্য দেওয়া হয়। নারীর শিক্ষার অধিকার তারা কেড়ে নিতে চায়, কর্মক্ষেত্রে নারীকে তারা দেখতে চায় না। অপবিত্র হিসেবে তারা নারীকে ছোট ছোট ছেলেগুলোর সামনে তুলে ধরে। নারীদের রাজনীতি করা হারাম এই ফতোয়া দেওয়া হুজুররা বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। দেখার কেউ নেই। অথচ এই দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই একজন নারী। তবুও ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে এই সকল অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন ক্ষমতাবানরা। নারীর প্রতি অবমাননার কোনো বিচার করতে পারেন না, কারণ ভোটের রাজনীতিতে সকল মৌলবাদী শক্তির ভোট তাদের প্রয়োজন।

আমরা যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকাই, দেখতে পাবো, এখানেও রয়েছে নারীর প্রতি বৈষম্য। এখানে নেই নারীর সমান অধিকারের কথা, ছোট ক্লাসের বইয়ে থাকে ও- তে ওড়না পরো, হ-তে হিজাব পরলে ভালো বলে। এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানুষ তো সাম্প্রদায়িক হবেই। জেন্ডার শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কোথাও নেই। এই সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর অবদান আমাদের বইগুলোতে তুলে ধরা হয়না। কেন নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ জরুরি সেই আলোচনা আমরা শিখতে পারি না। অথচ এখানকার নারীরাই তো তেভাগা আন্দোলন করেছে, নানকার বিদ্রোহ করেছে, করেছে ভাষা আন্দোলন, ডামি রাইফেল নিয়ে ৭১ এ ছাত্র ইউনিয়নের নারীরা মহড়া দিয়েছে রাজপথে। কিন্তু এই ২০২১ সালে এসে যদি লক্ষ্য করি যে মেয়েটা ধর্ষণের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামে, শাহাবাগে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তার চরিত্র নিয়ে বই লেখা শুরু করে দেয় আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ। সেই মেয়েটাকে যতক্ষন না ‘পতিতা’ বানাতে পারছে ততক্ষনে শান্তি নেই পুরুষতান্ত্রিক এবং মৌলবাদী মানসিকতার লোকজনের। মেয়েটা যখন সব ট্যাবুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শ্লোগান দিয়ে যায় তখন আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা গোষ্ঠির লোকেদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। মেয়েটার চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ শুরু করে দেয়। কখনো নেশাখোর কখনো পতিতা, আরো নানা উপাধিতে ভূষিত করে আমাদের সমাজ। কত নারী যে এই সব অপমান সহ্য করতে না পেরে হারিয়ে গেছে রাজনীতি থেকে তার কোন হিসেব নেই। অথচ এই সব অন্যায়ের কোনো বিচার আমাদের সমাজে নেই, একটা স্বাধীন দেশে এখন আমরা সব চেয়ে বেশি অনিরাপদ। ক্যান্টনমেন্ট থেকে সচিবালয় নারী কোথাও নিরাপদ না। গণপরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, প্রত্যেকটি জায়গায় নারী অনিরাপদ, নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল মাধমে নারীকে অপমান করা। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে এদেশের লেখক, সাংবাদিক, মুক্তমনা মানুষকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। ধর্ষণ, নিপীড়ন কোনো কিছুর বিচার পাওয়া যায় না এই রাষ্ট্রে, তাই স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকাই তো মুশকিল আর রাজনীতি করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যপার।

যদি আমরা অর্থনৈতিক দিকে তাকাই আমরা আমাদের রাষ্ট্রে নারীদেরকে দেখি কাজ করতে কিন্তু সমান মজুরি কি আমরা পেতে দেখি? আবার একটা বড় অংশের নারী যারা গৃহে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে তাদের শ্রমের মূল্য আসলে কোথায়? পুরুষ বাইরে কাজ করলে সে পারিশ্রমিক পায় আর ঘরে এসে বউকে কথা শোনায় যে সে তো আর বাইরে কাজ করে না। অথচ সারা দিন ঘরে যে কাজগুলো একজন নারী করে, তার পারিশ্রমিক যদি সে পেতো সেটাও কোনোভাবে কম হতো না। এই কথা বলতে গেলে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ নারীর সংসার ভেঙে যাবে, এটাই সমাজের বাস্তবতা।

আমাদের দেশে পোশাক শিল্পে যত নারী শ্রমিক কাজ করে তারা যদি কিছু দিন কাজ বন্ধ করে রাখে অচল হয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি। বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরাই কাজ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় শুধুমাত্র সংসার করতে গিয়ে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনোই চায় না যে নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক আর তার মুখের উপরে কথা বলার সাহসটুকু করুক। তাই গৃহে বন্দী থাকা এই অংশের নারীরা কোনোভাবেই রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হতে পারলে কখনোই কোনো মুক্তি অর্জন নারীর পক্ষে সম্ভব না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকারও সে পাবে না যদি অন্যের টাকায় তাকে চলতে হয়। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে হলে তাই অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। পরিবারে যে নারী স্বাবলম্বী, সেই কেবল পরিবারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, তেমনি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও সুযোগ পেতে হলে সব দিক থেকে নারীকে হতে হবে স্বাবলম্বী।

এই সব অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে রাজনীতিটাই করতে হবে নারীকে। কারণ সকল অন্যায় অবিচারের বিচার আদায় করতে হলে সেই সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার নারীকে যেতে হবে এগিয়ে। অন্যথায় পুরুষ তার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা দিয়ে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে যাবে। ননির পুতুল হয়ে বসে থাকা নারী নেত্রীরাও সেই পুরুষতান্ত্রিক সিদ্ধান্তই নেবে সর্বক্ষেত্রে। সামাজিক ট্যাবুর বেড়াজাল ভেঙ্গে, তথাকথিত খারাপ মেয়ে হওয়ার সাহস বুকে নিয়ে নারীকে আসতে হবে রাজনীতিতে। অন্যথায় তার ভাগ্য লিখবে পুরুষতন্ত্র।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *